ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নৌকাবাসীদের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ২৪ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নৌকাবাসীদের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি

রফিকুল ইসলাম মন্টু: বাংলাদেশের সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে। অন্যদিকে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ স্বাক্ষরকৃত জাতিসংঘের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রেও মানবাধিকারের বিষয়গুলো উল্লেখ রয়েছে। অথচ এ দেশে বসবাসরত উপকূলীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ‘মানতা’ সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা সেই পাঁচটি মৌলিক অধিকার- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা সেবাসমূহেও এদের যেন প্রবেশাধিকার নেই। অনেকের ভোটার তালিকায় নাম ওঠানোর অধিকারটুকুও নিশ্চিত হয়নি। ফলে মানতা সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।  

বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্ররেখা বরাবর ৭১০ কিলোমিটার তটরেখায় জেগে আছে উপকূল অঞ্চল। পূর্বে কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ আর পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূলে রয়েছে হাজারো সংকট। এই জনপদে বারবার হানা দেয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, নদী-ভাঙনসহ বহুমূখী কারণে লণ্ডভণ্ড হয় বসতি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব দুর্যোগের মাত্রা বাড়ছে বলে তথ্য দিচ্ছেন গবেষকরা। মানুষগুলো অধিক কষ্টে ধারদেনা করে কিংবা কঠোর পরিশ্রমে ঘরবাড়ি গুছিয়ে নিলেও তা আবার তছনছ হয়ে যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বহু মানুষকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটতে হয় কাজের সন্ধানে। ফলে হারাতে হয় জীবিকা। এর প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জীবনের প্রতিটি স্তরে। উপকূল অঞ্চলের মোটামুটি সব শ্রেণীর মানুষের ওপরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব পড়ে। তবে এরমধ্যে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এদের মধ্যে বিভিন্ন পেশাজীবী- যেমন মৎস্যজীবী, কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, জলদাস, বেদে, মানতা, দিনমজুরসহ অন্যান্য পেশার মানুষ রয়েছেন।

মাঠ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আয়-রোজগারের সুনির্দিষ্ট পথ না থাকায় প্রান্তিকের এই মানুষগুলোকে কঠোর পরিশ্রম করে দু’বেলা ভাতের সংস্থান করতে হচ্ছে। ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, পণ্যের প্রকৃত দাম না পাওয়া, বাজারজাতকরণের সুব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি কারণে মানুষের জীবিকার সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এইসব কারণে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ এই মানুষগুলো তাদের ছেলেদের স্কুলে না পাঠিয়ে অতিদ্রুত কাজে পাঠিয়ে দেন। মেয়েরা বাইরে কাজে যেতে পারে না বলে তাদের লেখাপড়া কিছুদূর এগোলেও দারিদ্র্যের কারণে তাদেরও অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। এই মানুষগুলো দুর্যোগে দিশেহারা হয়ে পড়ে, স্বাস্থ্য সংকটে বিপথগ্রস্থ হয়। অনেক ধরণের নাগরিক সুবিধার কথা বলা হলেও এদের কাছে তা খুব একটা পৌঁছায় না।

‘মানতা’ এমন একটি সম্প্রদায়, যারা নৌকায় বসবাস করে। জন্ম নৌকায়, বেড়ে ওঠা নৌকায়, বিয়ে নৌকায়, সারাজীবন কাটে নৌকায়, অবশেষে মৃত্যুও হয় নৌকায়। এক সময় এরা ভূ-খণ্ডের বাসিন্দা থাকলেও ক্রমাগত নদীভাঙনে নিঃস্ব হতে হতে এরা এখন নৌকার বাসিন্দা। এক একটি নৌকা এক একটি পরিবার। নৌকার মাঝখানে ঘুমানোর স্থান, পেছনের অংশে রান্নাবান্না আর খাওয়া-দাওয়া এবং সামনের অংশে কাজকর্ম। মানতা সম্প্রদায়ের জীবিকা মাছধরা। পরিবারের সকলে মিলে নদীতে যায়; মাছধরা শেষে আবার কিনারে নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে আসে। এরা দল বেঁধে বিভিন্ন এলাকায় বাস করে। নৌকা জীবনে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করার কথা চিন্তাও করা যায় না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও একই দশা। অসুখ হলে ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না। ঘরে ঘরে রোগবালাই লেগেই থাকে। পয়ঃনিস্কাশনের ব্যবস্থা নেই। নদীর পানি ব্যবহার হয় সব কাজে। পরিবার পরিকল্পনা কী এরা জানে না। সরকারের উন্নয়ন বার্তাগুলো এদের কাছে পৌঁছায় না। এদের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিচু। এ অবস্থায় এই সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর মাঝে সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোনমতেই সম্ভব নয়।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরকারের নানামূখী উদ্যোগ থাকলেও মানতা সম্প্রদায়ের নাগরিকদের কাছে খুব একটা পৌঁছাচ্ছে না। নৌকায় বসবাসের কারণে এরা মূলধারা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। ভূ-খণ্ডের নাগরিকরা এদের খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। ‘মানতা’ শব্দটাকে স্থানীয় ভাষায় ‘বেআইজ্জা’ বা ‘বেবাইজ্জা’ বলা হয়। জমিজমা নেই, বসতি নেই অর্থেই এমন শব্দ উচ্চারণ করা হয়। ফলে স্থানীয়রা এদের ভাসমান মানুষ হিসেবে দেখে নিগ্রহের চোখে। এদের মধ্যে অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে; অনেকের নেই। প্রান্তিকের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জন্য সরকারের সেফটিনেট কর্মসূচি থেকে সহায়তা এলেও ‘মানতা’ সম্প্রদায়ের মানুষ সেই ধারার সঙ্গে কোনভাবেই সম্পৃক্ত হতে পারছে না। এদের সম্বল মাত্র একখানা নৌকা আর জাল। জোয়ারের ওপর নির্ভর করে পরিবারের সকলকে নিয়ে এরা নদীতে মাছ ধরতে যায়। শিশুরাও বড়দের সঙ্গে জাল টানে কিংবা জাল ফেলে। কোথাও বনের ধারে নৌকা ভিড়লে শিশুরা বন থেকে লাকড়ি কুড়াতে যায়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ভয় উপেক্ষা করে এরা জীবিকার তাগিদে নদীতে যায়। অনেকে আবার চড়া সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মাছ ধরতে বাধ্য হয়। অথচ অধিক কষ্টে এদের ধরে আনা মাছের ন্যায্য মূল্য মেলে না। মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি মুনাফা নেয়। প্রান্তিকে বসবাসকারী এই মানতা সম্প্রদায়ের মানুষেরা বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও এভাবেই বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ এদের মাঝেও লুকিয়ে আছে বিরাট সম্ভাবনা। পরিকল্পিত উপায়ে এই জনশক্তি কাজে লাগিয়ে এদের জীবনমানের যেমন উন্নয়ন ঘটানো যায়; তেমনি এরাও জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
 


‘মানতা’ সম্প্রদায় নিয়ে বৃহৎ পরিসরে  গবেষণা কর্ম না থাকায় এদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে অনুমান করা হয়, প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে এদের সংখ্যা আড়াই লক্ষাধিক। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ মাছধরা পেশায় নিয়োজিত; অনেকে জীবিকার প্রয়োজনে শহরাঞ্চলে গিয়ে অন্য পেশায় ফিরেছে। উপকূলীয় জেলা ভোলার ইলিশা, তজুমদ্দিন, কলাতলী, চরফ্যাসন, দৌলতখান, ভোলা সদরের বিভিন্ন এলাকা, পটুয়াখালীর গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, চরমোন্তাজ, লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট, রায়পুরের নাইয়া পাড়া, কমলনগরের মতিরহাট, রামগতি, আলেকজান্ডার, বরিশালের লাহারহাট, বরিশাল সদর, মুলাদি, মেহেন্দিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় মানতা সম্প্রদায়ের লোকজনের দেখা মেলে। উপকূল অঞ্চল ছাড়াও দেশের অন্যান্য এলাকায়ও এই সম্প্রদায়ের লোকজনের দেখা মেলে। তবে সে সংখ্যা একেবারেই কম। মানতা সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা হাজারো সংকটে রয়েছে। মাছধরা পেশায় নিয়োজিত থাকার কারণে দুর্যোগ-দুর্বিপাক এদের নিত্যসঙ্গী। নৌকায় বসবাসের কারণে এরা প্রতিনিয়ত অনেক সমস্যার সুখোমুখি হয়। এদের জীবন অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে বহুমূখী সমস্যা। মূল ভূমির বাসিন্দাদের সঙ্গে এদের জীবন একেবারেই পৃথক। আর এই সমস্যাগুলোই এদেরকে পিছিয়ে রাখছে।

এই সম্প্রদায়ের মাঝে দক্ষতা উন্নয়ন ও বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ নেই। এখানে নারীর প্রতি বৈষম্য পদে পদে; নেই জেন্ডার সমতা। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ বিষয়ে মানতা সম্প্রদায়ের মাঝে নেই সচেতনতা। তাদের মধ্যে বাল্যবিয়ের প্রবণতাও প্রকট। ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা রয়েছে। মৎস্য আহরণ, সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ বিষয়ে এদের তেমন ধারণা নেই। তাদের সমস্যার আলোকে কিছু কাজের প্রস্তাব করা হচ্ছে। যেহেতু মানতা সম্প্রদায়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই, সে কারণে বেজলাইন জরিপ করতে হবে। জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে মানতা সম্প্রদায়ের জন্য নদীতীরে বিশেষ ধরণের পাকা আবাসন নির্মাণ করতে হবে। এদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভোটার অন্তর্ভূক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মৎস্য আহরণে বিশেষ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মানতা বাসিন্দাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মাছধরাসহ অন্যান্য ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সহজশর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের জন্য নির্মিত আবাসনে স্কুল নির্মাণ করতে হবে। আবাসনগুলোতে পয়ঃনিস্কাশন, সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পাকা লেট্রিন নির্মাণ করতে হবে। থাকতে হকে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, চিকিৎসক এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ। 

এর বাইরেও এই সম্প্রদায়ের বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। জেন্ডার সমতা ফিরিয়ে আনতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ বিষয়ে এই সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে। তাদের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে এবং সরকারি সুবিধাসমূহ পেতে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। বাল্যবিয়ে রোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে। ন্যায়বিচার পাওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের সচেতনতা ও অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি নিতে হবে মৎস্য আহরণ, সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণে বিভিন্ন ধরণের সচেতনতামূলক কর্মসূচি।

মানতা সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নের জন্য এ কাজগুলো করা জরুরি। তবে সেটা খণ্ডিত কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা নিলে হবে না। সবগুলো সমস্যার আলোকে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে পারে। প্রস্তাবিত কাজগুলো করা হলে অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে, যা এদের জীবনমান উন্নত করবে। একইসঙ্গে জিডিপিতে বাড়বে তাদের অংশগ্রহণ। আর এ উন্নয়ন এসডিজি লক্ষ্য বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নেবে দেশকে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়