ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পর্যটক জানেন না দেশে ফেরার পর কী হবে?

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পর্যটক জানেন না দেশে ফেরার পর কী হবে?

(ভিয়েতনামের পথে: তৃতীয় পর্ব)

ফেরদৌস জামান: সারা রাত বৃষ্টির পর মিষ্টি রোদে ঝলমলে একটি সকাল। ঘুম থেকে ওঠা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিচে নেমে দেখি অন্যরা ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা-কফিতে আড্ডা জমিয়ে তুলেছে। মগ থেকে ওঠা কফির কড়া ধোঁয়া ছড়িয়ে পরেছে চারদিকে। কে জানতো সকাল সকাল নাস্তার এমন সুবন্দোবস্ত অপেক্ষা করছে? আমাদের জানা ছিল না হোটেলের সব অতিথির জন্য সকালের নাস্তা কমপ্লিমেন্টারি। টোস্টারে গরম করা পাউরুটির চাকায় মাখন-জেলি মাখিয়ে মড়মড়ে একটা কামড়, ফাঁকে ফাঁকে কফির মগে তৃপ্তির চুমুক। সত্যি এমন সকাল বহুদিন হয় না।

পৃথিবীর নানান দেশের মানুষের ভিড়ে নাস্তার টেবিল রূপ নিল প্রভাত আসরে। কে কোথা থেকে এসেছে, কী কী দেখল, আরও কী কী দেখবে বা কোথায় যাবে- এসবই আলোচনার বিষয়বস্তু। নানান বয়সী কয়েকজন মানুষ, অথচ একজনের ভ্রমণ দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে আরেকজনের কত পার্থক্য! কেউ দেখতে বেরিয়েছে শহর-বন্দর, কেউ নদী-সমুদ্র, কেউ কৃষ্টি-কালচার, কেউ শুধু ঘুরে ঘুরে খাবারটাই চেখে দেখছে। এদের মধ্যে কেউ আবার পাহাড়-পর্বত এবং সবুজ প্রকৃতি দেখে বেড়াচ্ছে। সাধারণ দুধের প্রচলন ব্যাংককে নেই বললেই চলে। চা-কফিতে দুধ যোগ করতে চাইলে আছে সয়া মিল্ক। এই জিনিস দিয়ে এর আগে কখনও কফি খাওয়া হয়নি। তাই স্বাদে খানিকটা অন্যরকম হলেও নতুন একটা কিছু খাচ্ছি ভেবে ভালোই লাগল। যুদ্ধবিদ্ধস্ত সিরিয়া থেকে দুই বন্ধু মিলে মালয়েশিয়া ঘুরে চলে এসেছে থাইল্যান্ড। মাসাধিক কাল ধরে নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে। আলাপ পরিচয়ে আমার নাম শুনে সম্প্রদায়গত মিল খুঁজে পেয়ে একটু বেশিই খুশি, যার কারণে তারা আরও অন্তরিকতা প্রদর্শন করল। ভাবাই যায় না হানাহানিতে বিদ্ধস্ত দেশ ছেড়ে কীভাবে বিদেশে বেড়াতে আসে? তাদের অবিবেচক মনে হলো। সংক্ষিপ্ত আলাপে জানা যায় তাদের হতাশার কথা। দীর্ঘদিন দেশের অবস্থা নাজুক। এই অনিশ্চিত বাস্তবতা থেকে কয়েকটা দিন হাফ ছেড়ে বাঁচার জন্যই বিদেশ ভ্রমণ করছে তারা। যদিও জানে না দেশে ফেরার পর কী হবে?

 


এবার ওঠা দরকার, ইতিমধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ফায়া থাই থেকে মেট্রো রেলে মো চিৎ পঁচিশ থেকে ত্রিশ মিনিটের পথ। সুশৃঙ্খল এবং সুন্দর রেল সেবা তবে ভাড়া তুলনামূলক অনেক বেশি। ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল মুখের সামনে দিয়ে যাচ্ছে-আসছে। চালকের গায়ে নির্দিষ্ট পোশাক। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে জানতে চায় কোথায় যাব? এটাকে সুবিধার মনে হলেও তা বেপর্তা। কারণ দুজনের জন্য আলাদা দুইটা ভাড়া করতে হবে, একটাতে একজনের বেশি আরোহণের নিয়ম নেই। অধিকন্তু, আমাদের ব্যাগের কারণে এই বাহণ অনুপযোগী। ট্যাক্সিক্যাব আছে প্রচুর কিন্ত খামাখা অধিক ভাড়া গোনার কী দরকার? রাস্তায় শত শত বাস চলছে কিন্তু পথচারী একজনকেও বলে বোঝাতে পারলাম না যে, কোথায় যাব বা কী তথ্য চাচ্ছি। এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র ভরসা মেট্রো রেল। মো চিৎ নেমে অনুসন্ধান করতে হলো চাতুচক বাস টার্মিনাল যেতে কোন পথ ধরতে হবে। আবারও হাঁটা। হাঁটা পথে পরিশ্রম অধিক কিন্তু অভিজ্ঞতা বেশি। হাঁটতে হাঁটতে একটা জিনিস লক্ষ করলাম ব্যাংককেও ভিক্ষুক আছে তবে সংখ্যায় খুবই নগন্য। হঠাৎ কোনো বাস স্টপেজের আশপাশে দেখা যায়। এদের ভিক্ষুক বলা কতটা সমীচীন তা নিয়ে ভাবনায় পরে গেলাম। কারণ যোগ্যতার প্রমাণ রেখেই পথচারীর নিকট সাহায্য প্রত্যাশা করছে তারা। রেল থেকে মো চিৎ নেমে লক্ষ করি একজন হাঁটু মুড়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে বাশির মতো এক যন্ত্রে সুর তুলেছে। অপরিচিত সুর, দুচোখ বন্ধ করে বাদক বাজিয়ে যাচ্ছে নিবিষ্ট মনে। কে শুনল আর কে শুনল না অথবা আদৌ কেউ তাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করল কি না সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।

 


যেতে যেতে প্রবেশ করি ছায়া ঢাকা এক চমৎকার সড়কে। বাহারি সব পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে অনেক দোকানী। দেখেই অনুমান করা যায়, অস্থায়ী দোকন। সড়কে গাড়িঘোড়া তুলনামূলক কম। পাশে সবুজ রং করা বাইসাইকেলের জন্য নির্ধারিত আলাদা লেনেও বাহণ নেই। দোকান আর ক্রেতা-দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখোর হয়ে উঠছে জায়গাটি। জানতে পাই এটা শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটির দিনের বাজার। প্রকৃতপক্ষে ‘উইকেন্ড মার্কেট’ বলেই পরিচিত। স্থানীয়দের ক্ষেত্রে তো বটেই বিদেশী পর্যটকদের নিকটও এই মার্কেটের অনেক গুরুত্ব। এমনও দেখা যায় অনেক পর্যটক কেবল এই মার্কেট দেখার জন্যই ব্যাংকক ভ্রমণ করেন। আপাতত আমাদের লক্ষ্য বাস টার্মিনাল। কারণ পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী গন্তব্য মে হং সন। মার্কেটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আফসোস হলো; উল্লেযোগ্য একটা জায়গা দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম! পরিষ্কার রাস্তাঘাট, তার উপর দিয়ে আগের রাতে বৃষ্টিতে চারপাশ ধুয়ে গেছে। উঠেছে কটকটে রোদ। গরমটাও পরেছে বেশ। টার্মিনালের অভ্যন্তর এসির বাতাসে শীতল। প্রবেশ করে মনে হলো সারা জনমের নিবাস এখানেই পাতি।

 


তথ্য সরবরাহের জন্য ঠিক মধ্যখানে রয়েছে তথ্যকেন্দ্র। ভেতরে বসা ভদ্রলোকের কাছে মে হং সন যেতে বাসের টিকিট কোথায় পাওয়া যাবে জানতে চাইলে প্রতি উত্তরে যা বললেন তার কিছুই বুঝলাম না। তবে কথার মাঝ থেকে ছাকনি দিয়ে ছেকে তোলার মতো করে কেবল তিন কি চারটা শব্দ উদ্ধার করতে সক্ষম হলাম- কাউন্টার নাম্বার তের থেকে সতের। কাউন্টারে গিয়ে কিছু জানতে চাইলে মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসে নয়তো হা করে থাকে। টিকিটে নাম লেখা নিয়েও এক সমস্যা! অবশেষে কী-বোর্ড নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিলে কাঁচের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে নিজেই টাইপ করে দিতে হলো। আমি ভেবেই পেলাম না, সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ পর্যটক ব্যাংকক আসে কিন্তু এরা তাদের সামলায় কীভাবে!

বাস ছাড়বে সন্ধ্যা ছয়টায়। এখন বাজে বেলা এগারোটা। মনের অতৃপ্ত বাসনা পূরণের এ যেন এক সূবর্ণ সুযোগ হিসেবে হাজির হলো। কারণ আমাদের জানা ছিল টার্মিনালে গিয়েই বাস পাবো আর টুপ করে রওনা দেব। অতএব, এই লম্বা সময়টার মধ্যে ‘উইকেন্ড মার্কেট’ ঘুরে দেখতে আর কোন বাধা নেই। ব্যাগ দুটো কোথাও রেখে দিতে পারলে ভালো হতো। টার্মিনালে একটা ডিপজিটরি আছে। কত দিতে হবে জানতে চাইলে বলল, পঞ্চাশ পঞ্চাশ একশ। চোখ তো কপালে, বলে কি একশ বাথ! এটা নিতান্তই অনেক বেশি মনে হওয়ায় পিঠে ঝুলিয়েই মার্কেট দেখতে বেরুলাম। ফুটপাথ ছাপিয়ে দোকান চলে এসেছে রাস্তায়। শুরুতেই মাছের সুবৃহৎ বাজার। সাধারণ মাছ নয়, অ্যাকুরিয়ামে রাখা বাহারি সব মাছ! হরেক রঙের মাছ, মাছের খাদ্য এবং অ্যাকুরিয়াম সাজানোর প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপকরণে ঠাসা একেকটা দোকান। চিংড়ির মতো দেখতে লাল, নীল, বেগুনি, সাদা প্রভৃতি রঙের প্রাণীগুলো সব থেকে আকর্ষণীয়। পলিথিনে পানি ভরে তাতে মাছ ছেড়ে মুখ বেঁধে সারিবদ্ধ করে রাখা। রঙ্গিন মাছে ভরা এত পলিথিন দেখে যে কারোরই মনে হবে দুই হাতে দুইটা ঝুলিয়ে বাড়ির পথ ধরি আর সাজিয়ে তুলি অ্যাকুরিয়াম। ফেলে দেয়া হয় এমন জিনিসও একটু ঘষামাজা করে অত্যান্ত যত্নে সাজিয়ে রাখা। যেমন- গাছের ছোট ছোট পুরনো গুঁড়ি, শেকড় এবং বিভিন্ন রঙের পাথর।

 


অকাশে-বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে খাবারের দোকান থেকে ভেসে আসা হরেক রকমের মন জুড়ানো সুগন্ধ। পাতলা করে কাটা মাংস কাঠিতে ফোড়ানো। আগুনের ওপর ওলট-পালট করা হচ্ছে। সুজিতের ইচ্ছায় সেটা দিয়েই রসনাবিলাস পর্ব শুরু করা হলো। এক কাঠি পাঁচ বাথ এবং স্বাদে অনন্য। মনে হলো শুধু এই জিনিসটা খেয়েই পেট ভরিয়ে ফেলি। কিন্তু না, কারণ চেখে দেখার আছে অনেক কিছু। অনেক বড় কড়াইয়ে ডুবন্ত ঝোলে সেদ্ধ হচ্ছে মাংস। পাশেই কলাপাতায় মোড়ানো কিছু একটা দেখা যায়। পাতার কোথাও কোথাও আগুনের তাপে পুড়ে হালকা কাসটে হয়ে যাওয়া। পাতার আবরণ খুলে কামড় বসাতেই সুজিতের মুখমণ্ডজুড়ে বিষাদের বহিঃপ্রকাশ- ভাত ও পাকা কলার মিশ্রণে একটা দলা মাত্র। তবে আমার কাছে খারাপ লাগেনি। গোল পাত্রে সাদা বরফের মাঝে রং-বেরঙের আইস পপ। পাশে দাঁড়াতেই স্টিলের পাইপটা উল্টিয়ে কাঠিওয়ালা পপ বাড়িয়ে ধরে নারী বিক্রেতা। জিনিসটা শুধু দেখতেই সুন্দর নয় খেতেও দারুণ!

পাশেই চারকোণা পাত্রে কিলবিল করছে বাদামি রঙের অজস্র পোকা। অগোচরে ওৎ পেতে থাকা চড়ুইপাখি ফুরুৎ করে এসে তুলে নিয়ে পালাচ্ছে দুএকটা পোকা। একটু এগিয়ে দেখা গেল এই পোকা এবং ফড়িং বা কীটপতঙ্গ মড়মড়ে করে ভেজে বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। উপস্থাপনা দেখেই অনুমান করা যায় এগুলো কতটা প্রিয় খাবার হিসেবে গণ্য হয়। বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের মধ্যে এর আগে যারা থাইল্যান্ড গিয়েছে তাদের মুখে ব্যাংককের গল্প মানেই প্রথমে উঠে এসেছে ফলমূলের কথা, যেন কমলার কেজি আট আনা। আমার কাছে বিষয়টা মোটেও তেমন মনে হলো না। কারণ এক কলার দাম আট থেকে দশ বাথ, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় বিশ টাকা। ছোট ছোট পলিথিনে আম, তরমুজ, আনারস, জাম্বুরাসহ অন্যান্য ফল কেটে রাখা। ফলভেদে মূল্য বিশ থেকে পঞ্চাশ বাথ। ওজন দুইশ গ্রামের বেশি হবে না। তাহলে একে সস্তা বলি কীভাবে? ভেবে দেখলাম তাদের গল্পের সাথে বাস্তবের অমিলের পেছনে কারণ থাকতে পারে দুইটা। এক, যাদের কাছ থেকে শোনা তার সকলেই অর্থনৈতিকভাবে ধনি। ফলে এক বাথ যে বাংলাদেশি টাকায় আড়াই টাকা; সেই হিসাব করার সময় তাদের হয়নি। দুই, হতে পারে আমি ফলের মৌসুম পাইনি। (চলবে)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়