ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পাউরুটি আইসক্রীমের খোঁজে বিদেশের ফুটপাতে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৪, ২৯ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাউরুটি আইসক্রীমের খোঁজে বিদেশের ফুটপাতে

(ভিয়েতনামের পথে: দশম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: সকাল সাড়ে ছয়টায় রেস্ট হাউস ছেড়ে দিয়ে পায়ে হেঁটেই উপস্থিত হলাম বাস টার্মিনালে। যত তাড়াতাড়ি পাই যাওয়া যায় ততো ভালো। একটা ঘণ্টা সময় বেশি পাওয়ার মানে ভ্রমণে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ। সুতরাং প্রতি মুহূর্ত অনেক মূল্যবান।

কাউন্টারে যোগাযোগ করলে জানানো হলো দুপুর বারোটার আগ পর্যন্ত পাই অভিমুখী সমস্ত গাড়ির টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। এখন নিশ্চয়ই মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকার কারণ নেই! যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মানিয়ে নেয়া এবং তাকে কার্যকর করে তোলাই উপযুক্ত সমাধান। বারোটার টিকিট কেটে কাউন্টারে ব্যাগ জমা রেখে আবারও রওনা দিলাম শহরের দিকে। বিকল্প পথে বাজার এলাকায় পৌঁছতে সময় একটু বেশিই লেগে গেল। তবে দেখা হলো নতুন আরও কিছু জায়গা। সাকালের বাজার জমে উঠেছে। ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমে মুখর পরিবেশ। নানা রঙের শাকসবজির পসরায় সমস্ত বাজার এক দারুণ সাজে সেজে উঠেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপকরণে দোকানগুলো ঠাসা। এক্ষুণই কিছু একটা খাওয়া দরকার। সামনের দোকানে সাজানো হরেক পদের জিনিসগুলো দেখেই বোঝা যায় মিষ্টি জাতীয় খাবার। সুতরাং আর দেরি নয়। এসব পরখ করতে আবার সুজিতের জুরি নেই। সাজানো মিষ্টির পরিমাণ দেখে অনুমান করা যায় এরা মিষ্টান্নে অত বেশি অভ্যস্ত নয় যতটা না আমরা। বেছে বেছে কয়েক পদের একটা করে নেয়া হলো। পুরোটা না খেয়ে পরখ করতে সুজিত প্রতিটায় একটা করে কামড় বসিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিভ্রমণ করল। এরই মধ্যে তার মুখের ভূগোল পরিবর্তিত হয়ে এমন হলো যে, তাকে বাংলার পাঁচ না বলে যুক্ত-খ বললে উপযুক্ত হয়।



দোকানের সামনে টানা বেঞ্চিতে জায়গা পাওয়া সহজ নয়। সকালের নাস্তা কেনাবেচায় জায়গাটা তুলনামূলক বেশিই জমজমাট। কেউ বসে খাচ্ছে, কেউ দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে। বেশ কয়েকটা দোকান। উঁচু ছাউনির নিচে বাজারের এই অংশটায় শুধু খাবারের দোকান। প্রতিটা দোকানের সামনে এক থেকে দুইটা বেঞ্চ পাতা। খাবার খাওয়ার নিয়ম পাশাপাশি বসে। সামনের উঁচু টেবিলে রাখা আছে মূল পদের সাথে যুক্ত করার অন্যান্য মশলাপাতি। চাইলে ইচ্ছেমতো যে কোনোটাই যোগ করা যায়। পাশেই ঢাকনাবিহীন কৌটার মধ্যে গুছিয়ে রাখা নানান ধরনের চপস্টিক। যার যেটা দিয়ে খেতে পারে। বাঁশের তৈরি স্টিকগুলো গোল, চারকোণা অথবা তিনকোণা। খানিক দাঁড়িয়ে পরখ করার চেষ্ট করলাম কোন খাবারটা নেয়া যেতে পারে। খাবার পরিবেশনকারী বেশ ব্যস্ত। একটা বড় কাঠিতে কিছু পরিমাণ সেদ্ধ নুডুলস পেঁচিয়ে নিয়ে ভাতের মাড়ের মতো সাদা ঘন তরল পদার্থে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চুবিয়ে তুললেন। দেখতে ভাতের মাড়ের মতো হলেও তা আরও মিহি এবং আঠালো। এরপর চুবানো নুডুলসের বাটিতে আরও কী যেন তিনি দিলেন। অতঃপর পরিবেশন।

এটাই আমাদের এই বেলার নির্বাচিত খাবার। হ্যাঁ, সকালের নাস্তা হিসেবে এটা বেশ উপাদেয়। পাশের জন মুখে এমন করে খাবার পুরে খাচ্ছেন যে, তার বাঁকানো কনুই এসে ঢুকে পড়ছে আমার থুতনি বরাবর। এমনিতেই চপস্টিক সামলাতে ঘেমে যাচ্ছি তার উপর দিয়ে বারংবার কনুইয়ের অনুপ্রবেশ। চিন্তায় আছি নুডুলস মুখে ওঠার আগেই স্টিকের প্যাঁচ খুলে সুরৎ করে তার কনুইয়ের ভাঁজে আটকে না যায়! চপস্টিক ধরাটাও রপ্ত করা দরকার। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে একটা স্টিক ঠাস শব্দ তুলে নিচে পরে গেলে। এবার তিনি সজাগ হলেন। দোকানি নারী এতক্ষণ আমার খাওয়া দেখছিলেন তা খেয়ালই করিনি। মুখের দিকে তাকাতেই হেসে দিলেন। পাশের কড়াইয়ে ভাজা হচ্ছে টফু। মুচমুচে হয়ে তেলের উপর ভেসে উঠছে। এ নিয়ে আমাদের ব্যাপক আগ্রহ। পারলে তেল থেকে তুলে টপাটপ দুটো মুখে পুরে দেই। কথা চলছে, গতরাতে অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেছে আজ আর ছাড়ছি না। খাওয়া রেখে আমাদের সমস্ত মনোযোগ এখন টফুর পাত্রের দিকে। ফিরে তাকিয়ে দেখি সামনে এক পিরিচ টফু রাখা। কম করে হলেও সাত-আটটা হবে। কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না! বৃদ্ধা কি তাহলে অনুমান করতে পেরেছে যে, গত রাত থেকে আমাদের মন-মস্তিষ্ক এই জিনিসের মধ্যে ঢুকে বসে আছে? আমাদের আচরণ শুরু থেকেই তাকে আকৃষ্ট করেছে। তাই তো তার মুখের দিকে তাকাতেই চোখ মুখের ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন- এটা তোমাদের জন্য এবং বিনা পয়সায়। সত্যিই যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই মুখে তুলে একটা কামড় দিতেই মুচমুচে অথচ মোলায়েম স্বাদ পেলাম!



বিভিন্ন দোকান ঘুরে এটা-সেটা খেতে খেতে পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পুরনো জিনিসপত্রের দোকানে কেনার মতো রয়েছে অনেক কিছু। কিন্তু দামে একেবারেই চড়া। বুদ্ধের ছোট্ট মূর্তিটা মনে এতটাই ধরে বসল যে, প্রায় কিনেই ফেলেছিলাম। পরোক্ষণেই যখন ভাবলাম ভ্রমণের সবে শুরু। অতএব, খরচার ক্ষেত্রে হিসেবি হওয়াই শ্রেয়। বাজারের প্রতিটা আলিগলি এবং কোণায় কোণায় ঘোরাঘুরি শেষ। গতকাল দুপুরের খাবার শেষে রেস্টুরেন্টে বলে এসেছিলাম যে, রাতের খাবার খেতে আবারও আসছি। রাতে যেমন এদিকটায় আসা হয়নি তেমনি এখন কছাকাছি অবস্থান করেও খাওয়া সম্ভব হলো না। এমন সুন্দর বাজার দেখে এবং কী কী সব খেতে খেতে মন ও পেট উভয়ই ভরে গেছে। তবে বাইরে বেরিয়ে সেই পাউরুটি আইসক্রীম খুঁজেছি ফুটপাতের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত।

বারোটা বাজতে বেশি দেরি নেই। টার্মিনালের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ। ভিন্ন একটা পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। বেশ লম্বা পথ। অথচ গতকাল পাহাড় চূড়ার মন্দির ওয়াট ফ্রাথাট ডই কং মু প্রাঙ্গণ থেকে এক নজরে শহরটাকে এতটাই ক্ষুদ্র মনে হয়েছিল যেন দশ মিনিটেই পরিভ্রমণ সম্ভব। ঝকঝকে তকতকে শহরের রাস্তার পাশে ফুল ও পাতাবাহারের পরিপাটি আয়োজনে যে কারোরই ইচ্ছা হবে আরও খানিকটা হাঁটি। হস্তশিল্পের দোকানে বাঁশের তৈরি নিত্য ব্যবহার্য ও সাজিয়ে রাখার জিনিসপত্র থরে থরে সাজানো। দেখেই বোঝা যায় প্রতিটা জিনিসে কতটা যত্নের ছোঁয়া আর মনের মাধুরি মেশানো। মাথার উপর দিয়ে ফরফর করে উড়ে যাচ্ছে উন্মুক্ত কবুতরের দল। কোন কোন দোকান থেকে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দানা দানা খাদ্যবস্তু। গেরুয়া বসনের খুনখুনে বৃদ্ধের বয়স কম করে হলেও নব্বই হবে। খালি পায়ে কাঁধে ঝুলানো দুই দুইটা থলে। একটায় বোধহয় সামান্য কাপড়চোপড়, অন্যটাতে  ভিক্ষু-শ্রমণদের সদাসঙ্গী ধাতব পাত্র। আর হাতে কবুতরের খাদ্য। ধিরে ধিরে হাঁটছেন আর হাত বাড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছেন দুই-চার দানা খাদ্য। তাকে ঘিরে এক ঝাক কবুতরও এগিয়ে চলছে। পরম মমতায় কবুতরকে আদার খাওয়ানোর দৃশ্যে আশপাশের লোকজনেরা তেমন আকৃষ্ট হচ্ছে না। এর কারণ হতে পারে এটা বৃদ্ধের নিত্যদিনের কাজ। কবুতরগুলো তার ঘারে, কোছায় এমনকি হাতে; যে যেমন পারছে উড়ে উড়ে বসছে এবং ফুরুৎ করে মাটিতে নেমে দানা খেয়ে আবারও ফিরে এসে বসছে আগের জায়গায়। দুএকটা তো ছিটানোর আপেক্ষায় না থেকে হাতের তালু থেকই টুকে নিচ্ছে খাবার। নিজ সন্তানের মতো ভালোবেসে বৃদ্ধ আর শহরের কবুতর দলের এই আদর আহ্লাদ এবং মমতার সম্পর্ক কত দিনের কে জানে? ময়লা বসন, বার্ধক্যে নুয়ে পরা দুর্বল শরীর, ঠিক মতো নিজের পরিচর্যার ক্ষমতাটুকুও নেই। দুবেলা নিজের খাবার পায় কি না সন্দেহ। অথচ প্রকৃতির সামান্য এই সৃষ্টির প্রতি অসীম মমতা দেখে মন যেমন পুলকিত হলো তেমনি দুচোখে যেন বাষ্প জমে এলো।



বাসস্ট্যান্ডের খানিক আগেই চোখে পরে এক কফির দোকান। পাশে কিছু স্থানীয় জংলী ফলমুল সাজানো। তাদের ধারণা আমরা ইন্ডিয়ান। বলেও ফেললো ইন্ডিয়া থেকে এসেছি কি না? শুধু মে হং সন নয় ব্যাংককেও আমাদেরকে অনেকে ইন্ডিয়ান ধরে নিয়েছে। এর পেছনে বাস্তব কারণ একটাই হতে পারে, বাংলাদেশি পর্যটকদের বড় একটা অংশ ব্যাংকক গিয়ে নিজেদের ইন্ডিয়ান বলেই চালিয়ে দেয় বা পরিচয় দিয়ে থাকে, যা খুবই দুঃখজনক! আমাদের এইরূপ মানসিকতার জন্য যে জিনিসটা দায়ী তা হলো, জাতীয়তা বোধ তথা দেশপ্রেমের ক্রম অবনতি। এছাড়াও আর একটা কারণ হতে পারে, ভাষাগত জটিলতা এড়ানোর খাতিরে তারা যা ধরে নেয় তাতেই সায় দিয়ে কেটে পরা। আবার অনেক সময় এমনও হয়ে থাকে রাজধানী ছেড়ে দূরবর্তী কোথাও গেলে অনেক মানুষই পাওয়া যায় যারা বাংলাদেশের নামই শোনেনি, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তার অর্থ নিশ্চয়ই এই নয়, বিদেশে গিয়ে নিজেকে কেউ ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানি বলে সম্বোধন করলে তাকে সংশোধন না করে দিয়ে ফিরে আসব।

যাই হোক, আমাদের প্রকৃত পরিচয় জানার পর দোকানে বসা লোকেরা অনেক খুশি হলো এবং ছবি তোলার জন্য এগিয়ে এলো, যেন কোন বাংলাদেশির সাথে এই প্রথম মোলাকাত। কফির কাপে চুমুকের ফাঁকে দোকানে সদ্য আগত লোকটির সাথেও আলাপ জমে উঠল। হাতের আঙুলে হরেক পাথরের আংটি এবং কোমরের বেল্টের সাথে ঝুলছে কাঠ, শেকড় ও বিভিন্ন পশুর হাড়গোর এবং শিং দিয়ে তৈরি এক গুছি পুরুষাঙ্গ আকৃতির বস্তু। ঝকঝককে বস্তুগুলো দেখেই অনুমান করা যায় বহুদিন তার সংগ্রহে রয়েছে। সম্পর্ক একটু গভীর করা দরকার কারণ এমন বিচিত্র জিনিসের সংগ্রহকর্তাকে পেয়ে তাকে শুধু শুধু ছেড়ে দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। এক পর্যায়ে এর মাহাত্ম জানতে চাইলে তিনি বোধহয়  আমার কৌতূহলের মাত্রা অনুমান করতে পারলেন এবং পকেট থেকে আরও এক গুছি বের করলেন। এবার তো কৌতূহল দ্বিগুণ হয়ে গেল। উত্তরে সংক্ষিপ্ত করে যা জানালেন তার সারাংশ হলো- এসব সংগ্রহ বা সাথে রাখার পেছনে ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাস জড়িত। বিগত প্রায় পয়ত্রিশ বছর ধরে তিনি এই জিনিসগুলো সংগ্রহ করে আসছেন। কালক্ষেপণের আর কোনো সুযোগ নেই, মাত্র কয়েক মিনিট পরেই পাই নামক আরেক গন্তব্যের দিকে যাত্রা করার সময় হয়ে গেছে।
(চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়