ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পৃথিবীকে বাসযোগ্য করাই হোক অঙ্গীকার

শাহেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৩, ২৯ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পৃথিবীকে বাসযোগ্য করাই হোক অঙ্গীকার

শাহেদ হোসেন : আওয়াজ-জন্ম থেকে মৃত্যু, কোথায় নেই বলুন। হলেও সমস্যা, না হলে মাত্রাটা যেন আরো বেশি। জন্মের পরই ওঁয়া ওঁয়া। শিশু যতো চিৎকার করে মায়ের মুখের হাসি ততোই চওড়া হয়। ঘটনাক্রমে শিশু চিৎকার না করলে স্বজনদের কপালে ভাঁজ, আর মা-বাবার চোখে অশ্রুর বন্যা।

 

বিদায়ের চিত্রটা আবার বিপরীত। এখানে চিরবিদায় নিয়ে খাটিয়ার ওপর শুয়ে আছেন একজন। আর চিৎকার করছে পুরো বাড়ি। এখানে ভুল করেও কেউ হাসলে বিপদ ষোলো আনাই।

 

এতোক্ষণ যা বললাম, তা ছিল ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার মতোই। মানুষের জন্ম-মৃত্যু দুটোতেই কান্না থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে মানব সন্তান যতো বড় হয়, অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের মাত্রাটাও ততো বাড়ে। বিশেষ করে বাঙালির ক্ষেত্রে এটা ষোলো আনাই সত্য। আমার কাছে মনে হয়, অধিকাংশ বাঙালিই শব্দপাগল । এদের এই পাগলামির মাঝে দু’একটা নিরীহ প্রাণ থাকায় ভোগান্তিটা তাদেরই বেশি হয়। বিয়ের সময় ধিরিম ধিরিম, চাকভুম চাকভুম করে উচ্চ আওয়াজে বাজছে হিন্দি গান। নিরীহ প্রতিবেশীর কান ঝালাপালা। কিচ্ছু বলার জো নেই। কারণ, প্রতিবাদকারীর উল্টো মার খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। শত ভেজালের দেশে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর ফের উৎসব। জন্মদিন কিংবা খৎনা যেটাই হোক না কেন ফের ধিরিম ধিরিম। লাউড স্পিকারের যন্ত্রণায় পাশের বাড়ির রোগীটি বিছানায় শুয়ে কুঁই কুঁই করলেও কারো দরদ জাগে না। 

 

বাঙালির জীবনে পার্বণও অনেক। ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখ, খ্রিস্টিয় নববর্ষ। এখন আবার পশ্চিম থেকে আমাদানি করা ফেন্ডস ডে, ভ্যালেন্টাইন ডেসহ নানা ‘ডে’ রয়েছে। এখন উৎসব মানেই লাউড স্পিকারের অত্যাচার। আগে অডিটোরিয়াম কিংবা কোনো মাঠে মাইক কিংবা স্পিকারের গন্ডি সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন পাড়ার চিপাগলিতেও ঢাউস সাইজের স্পিকারে ধিরিম ধিরিম মিউজিক বাজতে থাকে মধ্যরাত অবধি। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ এখন স্পিকার পকেটে নিয়েই ঘোরে। রাস্তায়, বাজারে, শ্রেণিকক্ষে, অফিসে সব জায়গাতেই বেজে উঠছে পকেটে থাকা স্পিকার অর্থাৎ মোবাইল ফোনটি। এমনকি স্রষ্টার কাছে অবনত মস্তকে প্রার্থণা জানানোর সময়ও রিংটোনে বেজে ওঠে চটুল হিন্দি গান। রাস্তায় সে তো কোনো কথাই নেই। ব্যক্তিগত গাড়ি বলুন আর ট্রাকই বলুন হাইড্রোলিক হর্ন যেন সবাইকে চেপে ধরেছে। হাল আমলে আবার হর্ন হিসেবে যুক্ত হয়েছে কুকুরের ডাক। বাংলিশ যুবকের মোটরসাইকেল থেকে বিকট ঘেউ ঘেউ আওয়াজ পথচারীদের (বিশেষ করে নারীদের) পিলে চমকে দেয়। মার্কিনিরা বছরে একবার হ্যালোইন উৎসবে ভুত সাজে। আর আমরা  প্রতিনিয়ত অমানুষ সাজার চেষ্টা করছি।

 

২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রণীত শব্দ দূষণ নীতিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শব্দসীমা হলো ৫৫ ডেসিবেল এবং রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবেল। একইভাবে, নীরব এলাকায় এই সীমা ৫০ ও ৪০ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ও ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় ৭৫ ও ৭০ ডেসিবেল সর্বোচ্চ শব্দসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বিধির আওতায় স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের চতুর্দিকে ১০০ গজের ভেতরে কোনো প্রকার হর্ন বাজানো যাবে না।

 

শব্দ মাত্রা সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অভিমত হচ্ছে, ৮৫ ডিবিতে শ্রবণ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে এবং মাত্রা ১২০ ডিবি হলে কানে ব্যথা শুরু হয়। অথচ  রাজধানী ঢাকায়  শব্দের সাধারণ মাত্রা হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ ডেসিবেল। শুধু যানবাহন থেকে উৎসরিত শব্দের মাত্রাই হচ্ছে ৯৫ ডেসিবেল। রাজধানীর বড় বড় হাসপাতাল কিংবা স্কুলগুলোর সামনে হর্ন বাজানো নিষেধ লেখা থাকলেও দেখা যায়, সেখানেই বেশি করে হর্ন বাজাচ্ছেন চালকরা।

 

প্রতি বছর ঘুরেফিরে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার নাম উঠে আসছে। বিষয়টি মোটেও গর্বের নয়। কিন্তু কর্মকাণ্ডে আমরা তা-ই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। অতিরিক্ত শব্দদূষণে উচ্চ রক্তচাপ, মাথাধরা, অজীর্ণ, পেপটিক আলসার, অনিদ্রাসহ নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে শিশুদের বুদ্ধিমত্তাও নষ্ট হয়ে যায়। কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের পাশাপাশি প্রয়োজন সচেতনতা। তাই আসুন সচেতন হয়ে নিজেরাই শব্দদূষণ বন্ধে উদ্যোগী হই। পৃথিবীকে ‘নবজাতকের কাছে বাসযোগ্য’ করে যাওয়াটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ অক্টোবর ২০১৬/শাহেদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়