ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘প্রতিবন্ধীদেরও পরিবার রাখে, হিজড়াদের রাখে না’

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ২০ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘প্রতিবন্ধীদেরও পরিবার রাখে, হিজড়াদের রাখে না’

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : ‘আমি হিজড়া হিসেবে থাকতে চাই না। আমি মানুষ হিসেবে সমাজে বাঁচতে চাই।’ এমন আকুতি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ জান্নাত জাহানের। জান্নাতের ছোটবেলায় বাবা-মার দেওয়া নাম ছিল নাজমুল ইসলাম বিজয়।

জান্নাতের জন্ম, বেড়ে ওঠা সাভারের নবীনগরে। বাবা ছিলেন বাউলশিল্পী। পরিবারে দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। জন্ম ছেলে হিসেবে হলেও তার মধ্যে মেয়েলি ভাব ছিল ছোটবেলা থেকেই। বোনের পোশাক পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি। নৃত্যের প্রতি ছিল অন্য রকম টান, পারিবারিক যে কোনো অনুষ্ঠানে গানের তালে নৃত্যে অংশ নিতেন জান্নাত।  শৈশবে বিটিভিতে অনুষ্ঠিত নতুন কুঁড়ি নৃত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি।

জান্নাত জাহান শিক্ষাজীবন শুরু করেন স্থানীয় জাফর ব্যাপারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্কুলের সহপাঠী ও সমাজের অনেকে তখন তাকে টিজ করতো। জেএসসিতে ভালো ফল করেন। হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ার পর সব এলোমেলো হয়ে যায়। বাবার সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যরা দ্বন্দ্ব তৈরি করে। তাদের মতে, পরিবারে হিজড়াদের বাবার সম্পত্তি পাওয়ার নিয়ম নেই। রাগে ক্ষোভে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি। গিয়ে আশ্রয় নেন গুরুমা’র ডেরায়। দোকানে গিয়ে টাকা ওঠানো, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চা নাচানো হয়ে ওঠে তার নিয়মিত কাজ। পরে গুরু মায়ের হাত ধরে অবৈধ পথে পাড়ি দেন কলকাতা। সেখানে অন্ধকার আরেক জগৎ। বারে কিছুদিন নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। ভারতে হিজড়া ডেরায় এক বান্ধবী এইচআইভি আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যা করলে পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। অবশেষে বাংলাদেশে চলে আসেন জান্নাত।

ঢাকায় এসে পুরান ঢাকায় আরেক গুরুমা’র সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। জান্নাত জানান, সবাই হিজড়াদের জোকার মনে করে। টাকা তুলতে গেলে সবাই মজা নিতে চায়। অনেক সময় লাঞ্ছিত হতে হয়। একবার পুরান ঢাকার শ্যামবাজার এলাকায় টাকা তুলতে গিয়ে এলাকার মানুষের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয় তাদের। জান্নাত বলেন, ‘পরিবার থেকে একাধিকবার প্রস্তাব দিয়েছে চুল কেটে ছেলে সেজে মুদি দোকান করার জন্য। আমি বলেছি শুধু চুল কাটলে কি হবে? আমার ব্রেস্ট কি করবো? গলার স্বর কি করবো?’ জান্নাত বলেন, ‘পরিবারে প্রতিবন্ধী শিশু জন্মালে তাও পরিবার রাখে। কিন্তু হিজড়া শিশুদের দূরে সরিয়ে দেয়।’

জান্নাতের নৃত্যে যেমন দক্ষতা রয়েছে, বাউল পরিবারে জন্ম নেওয়ায় গানের গলাও অসাধারণ। ‘বিটিভি’, ‘মোহনা টিভি’, ‘মাই টিভি’সহ বিভিন্ন টেলিভিশনে নারী নৃত্যশিল্পী হিসেবে নেচেছেন জান্নাত। এমনকি কাশিমপুর কারাগারে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানেও নেচেছেন তিনি। গানের মধ্যে ফোক, লালন, বাউল গানে রয়েছে তার বিশেষ দক্ষতা।

২৫ বছর বয়সী জান্নাত জীবনযুদ্ধে আবার ঘুরে দাঁড়াতে চান। জান্নাত বলেন, ‘আমি মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে চাই না। নাচ দিয়ে হোক, গান দিয়ে হোক জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে চাই। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার চাই।’ সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা রি-থিংক-এর সহযোগিতায় জান্নাত এখন নতুন জীবনযাপন করছেন। রি-থিংকের সাপোর্টিং স্টাফ হিসেবে কাজ করে নিজেকে সাবলম্বী করার পাশাপাশি জান্নাত এগিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে একজন শিল্পী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার কাজে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ আগস্ট ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়