ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন মহিবুর রহমান

হাসমত আলী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২৫ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন মহিবুর রহমান

মুক্তিযোদ্ধা মহিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলছেন রাইজিংবিডির প্রতিনিধি

নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর : মুক্তিযোদ্ধা মহিবুর রহমান, বাড়ি গাজীপুর শহরের হাজীপাড়ায়। ১৯৭১ সালে তিনি জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী রাণী বিলাসমনি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তখন তার বয়স ছিল আনুমানিক ১৭ বছর। তার স্কুলের পাশেই জয়দেবপুর ভাওয়াল রাজবাড়িতে সে সময় ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অবস্থান।

মার্চের প্রথম থেকেই সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এর ঢেউ লাগে গাজীপুরেও। প্রতিদিন চলতে থাকে মিছিল মিটিং। ১৯ মার্চে দেশের ‘প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ’ হয় গাজীপুরে। এ যুদ্ধে অন্যদের সঙ্গে অংশ নেন মহিবুর রহমানও। আলাপকালে তিনি সেই দিন গুলোর স্মৃতিচারণ করেন রাইজিংবিডির সঙ্গে।

মুক্তিযোদ্ধা মহিবুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করার পর ওই সময় ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করে। এ সব বিষয় নিয়ে আন্দোলন প্রকট হতে থাকে। মার্চের প্রথম থেকেই সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। প্রতিবাদে গাজীপুর তথা জয়দেবপুরেও চলতে থাকে মিছিল-মিটিং-সমাবেশ। প্রতিটি মিছিলে অংশগ্রহণ করি। আমাদের সঙ্গে গাজীপুরস্থ বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি ও সমরাস্ত্র কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।’

তিনি বলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিলেন। ওই ভাষণ রেডিওর মাধ্যমে শুনেছি। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন ‘যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকার জন্য’। তার নির্দেশের পর গাজীপুরে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে তৎকালীন ছাত্রনেতা আ ক ম মোজাম্মেল হককে (বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী) আহ্বায়ক এবং শ্রমিক নেতা মো. নজরুল ইসলাম খান (বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য) কোষাধ্যক্ষ করা হয়। কমিটির হাইকমান্ড (উপদেষ্টা) হন তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিব উল্ল্যাহ (মরহুম), শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা এমএ মুত্তালিব এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নেতা বাবু মনিন্দ্রনাথ গোস্বামী (মরহুম)। তাদের নেতৃত্বে চলতে থাকে বিভিন্ন কর্মসূচি।

তিনি আরো বলেন, বাঙালির আন্দোলন দমানোর জন্য গাজীপুরস্থ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের ৩০৩ ক্যালিবার রাইফেলগুলো জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এ রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার-সৈন্যরা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। তারা গোপনে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন ও অফিসারদের মনোভাব অবহিত করতেন। অস্ত্র জমা না দিয়ে তারা বিভিন্ন অজুহাতে কাল ক্ষেপণ করতে থাকেন। পরে ১৯ মার্চ ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবারের নেতৃত্বে এক কোম্পানি পাকিস্থানি সৈন্য দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আসে।

মুক্তিযোদ্ধা মহিবুর রহমান  
 

মহিবুর রহমান বলেন, ‘দিনটি ছিল শুক্রবার। পাকিস্থানি সৈন্য আসার খবর পেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। দেখি রাজবাড়ি সড়কে (বর্তমান কেবির মার্কেট থেকে জয়দেবপুর বাজার) হাজার হাজার মানুষ। তারা রাজবাড়ি সড়কের বাজার বটতলা রেলক্রসিং গেটে ব্যারিকেড তৈরি করে।তারা ‘জয়বাংলা, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীণ কর ইত্যাদি স্লোগান দেন। এ সময় রেজিমেন্টের কয়েকজন বাঙালি সৈন্য টাঙ্গাইলে রেশন পৌঁছে দিয়ে রাজবাড়ি ক্যান্টনম্যান্টে ফিরছিল। পথে শিববাড়ি মোড়ে তাদের আটক করে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়। পরে ওই সৈন্যরাও আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। বাঙালি সৈন্যদের একাত্মতা প্রকাশের খবর পেয়ে পাকিস্থানি সৈন্যরা রাজবাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাজবাড়ি থেকে বের হয়েই তারা আমাদের প্রতিবোধের মুখে পড়ে। তারা রাস্তা থেকে ব্যারিকেট সরানোর জন্য হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দেয়। ব্যারিকেট না সরালে তারা গুলি করে। পাকবাহিনীর গুলিতে সেদিন শহীদ হন মনু খলিফা ও কিশোর নিয়ামত। আহত হন সন্তোষ মল্লিক, ডা. ইউসুফ, মো. শাহজাহানসহ আরো কয়েকজন। আমাদের পক্ষ থেকে ওই সৈন্যরা পাল্টা গুলি ছুড়ে। এক পর্যায়ে আমরা টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। পরে তারা ব্যারিকেট সরিয়ে ঢাকার পথে যেতে থাকে। পথে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ফের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এখানেও গুলি করে পকিস্তানি বাহিনী। এখানে পাকিস্তানি সৈন্যের গুলিতে হুরমত শহীদ হন। এ সময় কানু মিয়াসহ অনেকে আহত হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কানু মিয়াও মারা যায়।’

তিনি জানান, এর পরের দিনগুলোতে বাড়িতেই অবস্থান করতে থাকি। এ সময় প্রতিদিনই শহরে নেতাদের নির্দেশে মিছিল মিটিং করতে থাকি।২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ চালায়। লোকজন ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে আসতে থাকে। আমার আব্বা পূবাইল হয়ে বাড়িতে ফিরেন। ২৮ মার্চ ভোরে ভাওয়াল রাজবাড়িতে অনেক সময় ধরে গুলির শব্দ পাই। সকালে রাজবাড়িতে গিয়ে অনেক পাঞ্জাবি সেন্যের লাশ দেখতে পাই। এমন সময় দুটি ফাইটার বিমান রাজবাড়ির ওপর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে দেখি। দ্বিতীয়বার চক্কর দেওয়ার সময় বোমা হামলার শব্দ পাই। মানুষ দৌড়াদৌড়ি করে পালাতে থাকে। আমরাও দৌড়ে নিরাপদে সরে পড়ি। ওই দিন পাকিস্থানিরা এখানকার অস্ত্রাগারে বোমা হামলা করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর আটকে পড়া সৈন্যদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

তিনি আরো বলেন, জয়দেবপুর বাজারের পাশেই আমাদের বাড়ি। খবর পেলাম আমাদের বাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেখার জন্য এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে লুকিয়ে বাড়িতে আসি। আমাদের বাড়িটি পুড়ানো না হলেও লুট হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে লুকিয়ে বাড়িতে আসতাম। প্রায়ই দুপুরে একটা ট্রাক রাজবাড়িতে আসত। ট্রাকের শব্দ পেলেই বাড়ির কাছে থাকা বড় আম গাছে ওঠে পড়তাম। দেখতাম চোখ বাধা অবস্থায় ৫-১০ জন করে লোক ট্রাকে করে নিয়ে আসত। ট্রাকটি গিয়ে ঢুকত রাজবাড়িতে। এর কিছুক্ষণ পরেই পাওয়া যেত ব্রাশ ফায়ারের শব্দ। এর কিছুক্ষণ পর ট্রাকটি চলে যেত, তখন দেখতাম ট্রাকটি খালি। এ ছাড়া আশপাশ এলাকা থেকে লোক ধরে এনে এখানে মেরে ফেলত। নারীদের ধরে এখানে এনে নির্যাতন করত। এগুলো দেখে চিন্তা করলাম এভাবে বাঁচা যায় না। মরতে হয় লড়াই করেই মরব। সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার।

মহিবুর রহমান  বলেন, ‘এরপর একদিন খাতিয়া এলাকায় দেখা হল মুক্তিযোদ্ধা হাতেম আলীর সঙ্গে। তার কাছে তথ্য নিলাম কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া যায়। তার কাছ থেকে তথ্য নেওয়ার পর যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারত যাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। মে মাসের এক সন্ধ্যায় বাড়ির কাউকে কিছু না বলে মুক্তিযোদ্ধা মো. মহর আলীর গ্রুপের সঙ্গে ভারত চলে যাই। প্রথমে আমরা আগরতলা কংগ্রেস ভবনে গিয়ে ওঠি। পরে সেখান থেকে হাপানিয়া ও ইছামতি ক্যাম্পে যাই। সেখান থেকে আমাদের আসামের লায়লাপুর ক্যাম্পে নেওয়া হল এবং ট্রেনিং দেওয়া হল। ট্রেনিং শেষ করে মধ্য জুন মাসের দিকে কুমিল্লা হয়ে জয়দেবপুরে চলে আসি। আমি ছিলাম সহকারী সেকশন কামন্ডার। আমাদের গ্রুপ কামান্ডার ছিলেন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মো. জিন্নাহ পাঠান এবং সেকশন কমান্ডার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন। জয়দেবপুরে বিভিন্ন স্থানে আমরা যুদ্ধে অংশ নিই। এর মধ্যে জয়দেবপুর জংশন, জয়দেবপুর বাজার, চান্দনা চৌরাস্তা, রাজবাড়ি আর্মিক্যাম্পে আমাদের সঙ্গে পাকিস্থানিদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়।




রাইজিংবিডি/গাজীপুর/২৫ মার্চ ২০১৭/হাসমত আলী/উজ্জল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়