ঢাকা     সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৮ ১৪৩১

প্রথম ‘শিল্পকলা পদক’ পেলেন যারা

রাশেদ শাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রথম ‘শিল্পকলা পদক’ পেলেন যারা

রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও অতিথিদের সঙ্গে ‘শিল্পকলা পদক-২০১৩’ প্রাপ্তরা

রাশেদ শাওন

ঢাকা, ৩১ ডিসেম্বর: প্রথম বারের মত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি চালু করেছে ‘শিল্পকলা পদক’। প্রথম বারে এই পদক পেয়েছেন সাত গুণী শিল্পী। পদকপ্রাপ্ত শিল্পীরা হলেন যথাক্রমে নৃত্যকলায় আমানুল হক, যন্ত্রসংগীতে ওস্তাদ মতিউল হক খান, লোকসংস্কৃতিতে সাইদুর রহমান বয়াতী, চারুকলায় সমরজিৎ রায় চৌধুরী, কন্ঠসংগীতে ফাহমিদা খাতুন, চলচ্চিত্রে মানজারে হাসীন (মুরাদ) এবং নাট্যকলায় খালেদ খান। তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হল।

নৃত্যকলা: আমানুল হক
বাংলাদেশের নৃত্যাঙ্গনে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সদালাপী ও দৃঢ় প্রত্যয়ী নৃত্যগুরু আমানুল হকের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১২ আগস্ট সিরাজগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে দিয়ারধানগড়া গ্রামে। পিতা মরহুম আইনুল হক আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কর্মচারী ছিলেন যিনি কাব্য সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সঙ্গীত চর্চাও করতেন। শৈশবকাল থেকেই সাহিত্য কাব্য ও সংগীতের প্রতি আমানুল হকের সহজাত আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। পিতার চাকুরীর সুবাদে পরিবার পরিজনের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক পরিবেশে বিচরণ ও বসবাসের কারণে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তাকে প্রভাবিত করে।

১৯৫০ সালে পিতামাতার অনুপ্রেরণায় সংগীতগুরু দীনেশ চন্দ্র মালাকারের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নেন। এক সময়ে নাট্যসংগঠন খেয়ালী ক্লাব ও প্রগতিশীল আদর্শে গঠিত রেনেসাঁ ক্লাবের সদস্য হয়ে নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার অবস্থান সুদৃঢ় করেন।

রাজনৈতিক সচেতন আমানুল হক ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনে যোগদান করে ছাত্র সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এ বছরেই উপ-মহাদেশের নৃত্যাঙ্গনের কিংবদন্তী বুলবুল চৌধুরীর আগমন ঘটে সিরাজগঞ্জে। তাঁর নৃত্যশৈলী আমানুল হকের জীবনে নতুন দিগন্তেরর সন্ধান এনে দেয়। সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি একজন কৃতি ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবেও সুখ্যাতি ছিল বলে ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান স্পোর্টস কন্ট্রোল বোর্ডের আমন্ত্রণে করাচিতে জাতীয় ক্রিকেট প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগদান করেন। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে না ফিরে নৃত্য শিক্ষার অভিপ্রায়ে করাচিতে ‘ঘনশ্যাম রিদমিক আর্ট সেন্টারে’ ভর্তি হন। এখানে নৃত্যগুরু ঘনশ্যাম আঞ্জারিয়া ও নৃত্যমাতা নীলিমা ঘনশ্যামের কাছে কথাকলি, ভরত নাট্যম, মনিপুরী ও তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন লোক নৃত্যের তালিম নেন। এই সময়ে করাচি রেডিওতে অডিশনে পাশ করে নিয়মিত গান পরিবেশন করে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচির প্রখ্যাত মামা পার্শি গার্লস স্কুল, গ্রীনউড গার্লস স্কুল ও পি.ই.সি.এইচ.এস গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে নৃত্যশিক্ষক হিসেবে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেন।

জীবিকার জন্য তিনি ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন ব্যাংকে যোগদান করেন এবং পাশাপাশি নৃত্য ও সঙ্গীত চর্চা অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশনে নৃত্যশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি করাচিতে ‘নীলা পর্বত’ নামে উর্দু ছবিতে প্রথম নৃত্য পরিচালনা করেন। ১৯৬৬ সালে বদলী হয়ে ঢাকায় আসেন এবং ওস্তাদ বারীন মজুমদার প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় পরিচালিত সঙ্গীত একাডেমীর নৃত্য বিভাগে যোগদান করেন। একই সময়ে ‘ক্রান্তি’ নামে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনে যোগদান করেন। এ বছরেই ঢাকায় উর্দু ‘তুম মেরে হো’ ছবিতে নৃত্য পরিচালনা করেন।

আমানুল হকের উল্লেখযোগ্য নৃত্যকর্মের মধ্যে নৃত্যনাট্য ‘মুখী মাতারা’, ‘কাবেরী তীরে’, ‘তাসের দেশ’, ‘মায়ার খেলা’, ‘জুলফিকার’, ‘সোনা ঝরা সন্ধ্যা’, ‘সুর পেল সুরভি’, ‘শতাব্দীর স্বপ্ন’, ‘কুসুমের স্বপ্ন’, ‘বিক্ষুব্ধ ৭ই জুন’, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘আমার স্বদেশ আমার ভালবাসা’, ‘ব্যাটল অব বাংলাদেশ’ এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত নৃত্যনাট্য ‘জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে’, ‘ওরা কাজ করে’, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘দিগন্তে নতুন সূর্য’ এবং ১৯৭২ সালে ১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জুলিও কুরী পদক প্রাপ্তির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শিরোনামে নৃত্যনাট্য পরিচালনা করেন।

নৃত্যে অবদানের জন্য তার উল্লেখযোগ্য সম্মাননার মধ্যে রয়েছে আঁভা গার্দে পুরস্কার, করাচি এবং ঢাকাতে কথাকলি সংগীত বিদ্যালয় সম্মাননা, ক্রান্তি শ্রদ্ধাঞ্জলী, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা, শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত ‘দহন’ ও ‘অন্যজীবন’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার জন্য ‘বাচসাস’ পুরস্কার, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত আজীবন সম্মাননা, বেনুকা সঙ্গীত একাডেমী ও নৃত্যধারা পুরস্কার, শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অ্যাওয়ার্ড এবং বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত বুলবুল চৌধুরী পদক-২০১৩।

উল্লেখযোগ্য লেখা: বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাই কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘ভারত বিচিত্রা’, এশিয়াটিক ‘সোসাইটির বাংলা পিডিয়া’ ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘শিল্পকলা’ জার্নাল-এ বাংলা ও ইংরেজিতে নৃত্য বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে থাকেন।

তিনি ১৯৯৬ সালে কর্মজীবন শেষে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের উর্দ্ধতন ব্যবস্থাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার উপদেষ্টা, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিশেষ মানের নৃত্যশিল্পী ও পরিচালক। এছাড়াও বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিশু সংগঠন ‘কচি-কাঁচার মেলার’ উপদেষ্টা এবং বর্তমানে নৃত্য জগতে আন্তরিকভাবে নিবেদিত।

যন্ত্রসংগীত : ওস্তাদ মতিউল হক খান
ওস্তাদ মতিউল হক খান ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সেতার বাদক ওস্তাদ এরশাদ আলী খান। মতিউল হক খান আট বছর বয়সে পিতামহ ওস্তাদ মকসুদ আলী খানের কাছে তবলায় হাতেখড়ি গ্রহণ করেন। দাদার মৃত্যুর পর পিতা এরশাদ আলী খানের কাছে সেতারে তামিল নিতে শুরু করেন। এরশাদ আলী খান শুরুতে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরসাধক এবং সুরবাহার শিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলী খানের কাছে তালিম গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ঐতিহাসিক তানসেন ঘরানার প্রখ্যাত সেতার শিল্পী ওস্তাদ এনায়েত খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। খান সাহেবের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন রাজদরবারে সেতার পরিবেশন করেছেন। পিতার কাছে মতিউল হক খান দীর্ঘ বারো বছর সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি কোলকাতায় ‘আলী আকবর কলেজ অব মিউজিক’ এর চার বছরের কোর্স শেষ করেন। কোলকাতায় থাকাকালীন তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দুই শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খান এবং ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খানের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাদের কাছে তালিম গ্রহণ করেন। পরে ওস্তাদ আলী আকবর খানের কাছেও তিনি কিছুদিন সঙ্গীত শিক্ষা করেছেন।

সংগীত শিক্ষা শেষে মতিউল হক খান সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং উচ্চাঙ্গ সংগীতের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। কোলকাতায় থাকাকালীন ওস্তাদ আলী আকবর খানের সংগীত পরিচালনায় সত্যজিত রায় পরিচালিত ‘দেবী’ এবং তপন সিংহ পরিচালিত ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ চলচ্চিত্রে আবহ সংগীতে সেতার বাজিয়েছেন।

ষাটের দশকের শুরুতে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ‘বুলবুল ললিতকলা’ একাডেমী’তে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে নৃত্যশিল্পী গওহর জামিল প্রতিষ্ঠিত জাগো আর্ট সেন্টারে ১৯৯৫ সালে শিক্ষকতা করেন। এছাড়া দীর্ঘদিন তিনি বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পী এবং সংগীত প্রযোজক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বেতারের সংগীত প্রযোজক পদ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিশেষ মানের তালিকাভুক্ত উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী। এর বাইরে অসংখ্য সঙ্গীত সম্মেলন এবং উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসরে তিনি সংগীত পরিবেশন করেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কোলকাতার কলেজ স্ট্রীটে অনুষ্ঠিত বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ওস্তাদ আলী আহমেদ খান, ওস্তাদ আলী আকবর খান, পন্ডিত রবি শঙ্কর, পন্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ আমীর খান, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান, ওস্তাদ আল্লারাখা খান, ওস্তাদ বিলায়েত খান প্রমুখ সঙ্গীত গুণীজন।

ওস্তাদ মতিউল হক খান সরকারী ও বেসকারী উদ্যোগে সংগীত পরিবেশনের জন্য এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। বি.বি.সি লন্ডন স্টুডিও থেকে তিনি সেতার পরিবেশন করেছেন। ওস্তাদ মতিউল হক খান একজন সফল সংগীত শিক্ষক। দীর্ঘদিনের পেশাগত সঙ্গীত জীবনে তিনি বহু ছাত্রছাত্রীকে তালিম দিয়েছেন। শুধু দেশে নয় বিদেশেও তার ছাত্রছাত্রী রয়েছে। জাপানী ছাত্রী মতয়া এবং ব্রিটিশ ছাত্রী শার্লি সাফল্যের সঙ্গে তার সংগীত শিক্ষাকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরেছেন। তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর ‘মেন্টর ফেলোশিপ ইন মিউজিক’ শীর্ষক প্রকল্পে সেতার শিক্ষক হিসেবে ১ ডিসেম্বর ১৯৯৬ পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ পর্যন্ত তার দু’টি অ্যালবাম প্রাকশিত হয়েছে। প্রথমটি ক্যাসেট। এতে তিনি অর্কেস্ট্রেশনের সঙ্গে সেতার পরিবেশন করেছেন। দ্বিতীয়টি সিডি। এতে তিনি সেতারে উচ্চাঙ্গ সংগীত এবং ধুন পরিবেশন করেছেন।

বৈবাহিক সূত্রে মতিউল হক খান বিশিষ্ট সংগীত পরিবার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান এবং ওস্তাদ আয়েত আলী খানের ভ্রাতুস্পুত্র বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ সেতারশিল্পী ওস্তাদ খাদেম হোসেন খানের কন্যা জোহরা খানমের সঙ্গে বিয়ে হয়।

সংগীত এবং সুরের সান্নিধ্যে তিনি বর্তমান অতিবাহিত করছেন।

লোক সংগীত : সাইদুর রহমান বয়াতী
বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির প্রবাদ প্রতিম পুরুষ লোকশিল্পী সাইদুর রহমান বয়াতী (১৯৩১ খ্রী.) ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে মানিকগঞ্জ জেলার পশ্চিম হাসলী গ্রামে জৈষ্ঠ্য মাসে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা জিকের আলী ও মাতা কুসুমি বিবি।

শৈশবকাল থেকেই লোক সংস্কৃতির সব শাখায় তার অবাধ বিচরণ ছিল। তিনি তাঁর সুরেলা কন্ঠে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, কবিগান, রাখালিয়া ও গাজীর  গানে মানুষকে মুগ্ধ করে রাখতেন। সাইদুর রহমানের দেশপ্রেমও ছিল প্রবল। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে শরিক হয়ে ভাষার গান লিখেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। এভাবেই তার শিল্পী সত্বা ও অন্তর্নিহিত মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটে। ১৯৫৪ সালে সাইদুর রহমান শেরে বাংলা এ.কে.এম ফজলুল হক এর এক জনসভায় গান গেয়ে তাঁকে মুগ্ধ করেন। পরবর্তীতে মানিকগঞ্জের এক জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর উপস্থিতিতে গান গাইবার সুযোগ হয়। মওলানা ভাসানী আবেগে আপ্লুত হয়ে দোয়া করেন। ৬৯-৭০ সালের গণঅভ্যুথানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে ভোটের গান গেয়ে জনগণকে মুগ্ধ করেন।

বাবার সংসারে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে লেখাপড়ায় বেশী দূর এগোতে পারেননি সাইদুর রহমান। কিন্তু তার শিল্পীসত্বা তাকে সংস্কৃতির বিশাল জগতে টেনে এনেছে। তার এসব গুণাবলীতে চাচা অধর আলীও মুগ্ধ ছিলেন। কিশোর বয়সে চাচার সঙ্গে তিনি আসমান সিং-এর যাত্রাদলে যোগ দেন। এই দলের পালায় রামদুর্গার ভূমিকায় অভিনয় করতেন। বাবা সারিন্দা ও দোতারা বাজিয়ে বৈঠকি গান গাইতেন। পিতার অন্যান্য শিষ্যদের সঙ্গে তিনি গুরু পরম্পরা শিক্ষা গ্রহণ করতেন। পিতার সংগীত চর্চার সুবাদে তিনি তার বাবার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে সুনাম অর্জন করেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন লোকশিল্পী ও বয়াতীদের সাহচর্যে আসার সুযোগ হয় তার।

জীবন-জীবিকার তাগিদে সাইদুর রহমান এক সময় নৌ-বাহিনীতে এবং কো-অপারেটিভ ব্যাংকে যোগ দেন। কিন্তু তার শিল্পীমন তাকে কোনটিকেই আটকে রাখতে পারেনি। পুনরায় তিনি শিল্পী জীবনে আত্মনিয়োগ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। গান রচনা এবং যাত্রাপালায় পুনরায় ফিরে এলে চারিদিক হতে তার ডাক আসা শুরু হয়। তিনি একাধারে পালাগান, যাত্রা এমনকি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘লাঠিয়াল’। এরপর ‘নদীর নাম মধুমতি’, ‘লালসালু’, ‘লালন’, ‘রাবেয়া’, ‘লিলিপুটেরা বড় হবে’ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেন। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী সাইদুর রহমান বয়াতি ‘নদীর নাম মধুমতি’ ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের পুরস্কার, ডেসটিনি পুরস্কার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী নাট্যোৎসব পুরস্কার এবং মানিকগঞ্জ সাংস্কৃতিক পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তাকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রও নির্মিত হয়েছে। লোক সংস্কৃতির বিশেষ অবদানের জন্য সম্প্রতি তাকে বাংলা একাডেমী সম্মানসূচক ফেলোশিপ ২০১২ প্রদান করেছে। এই গুণী শিল্পীর  খ্যাতি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে আছে। এই সুবাদে বিদেশী সুহৃদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। এদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফোকলোর বিশেষজ্ঞ হেনরী গ্লাসি, লাউরো হংকো, সাইমন ড্রিঙ্ক, জওহরলাল হান্ডু প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ অন্যতম।

অসাম্প্রদায়িক সাইদুর রহমান বয়াতি দেশকে, দেশের মানুষকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত  সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিডিআর দরবার হলে নিজের রচিত গান পরিবেশন করলে বঙ্গবন্ধু তাকে তাৎক্ষণিক পুরস্কৃত করেন। বর্তমানে এই স্বনামধন্য শিল্পী আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত। তার গাওয়া গানের মধ্যে সৃষ্টিতত্ত্ব, বাউল, মারেফতসহ জয় বাংলার গান ও বঙ্গবন্ধু হত্যার জারিগান উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের এই প্রথিতযশা ও খ্যাতিমান লোকশিল্পী দেশের আধ্যাত্মিক, সুফিতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং সমসাময়িক বিভিন্ন লোকসংস্কৃতির উন্নয়নে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। বর্তমানে সাইদুর রহমান বয়াতী বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে গবেষণার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।

চারুকলা : সমরজিৎ রায় চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগের সুপার নিউমেরারেরী প্রফেসর সমরজিৎ রায় চৌধুরী ১৯৩৭ সালে কুমিল্লা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৬০ সালে তৎকালীন সরকারের আর্ট ইন্সটিটিউট (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) থেকে গ্রাফিক্স ডিজাইনে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেই বছরই একই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। কেননা ওই সময় থেকেই গ্রাফিক্সের উপর তার নানা ধরনের ডিজাইন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর্ট ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করার পর তরুণ ডিজাইনার নিজ কর্মের প্রতি মনোনিবেশ করে প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুতি নেন। এই সময়ে তিনি আমন্ত্রিত শিল্পী হিসাবে প্রায় ১০০টি জাতীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। এভাবেই তাঁর কর্মের বিস্তৃতি ঘটে। ১৯৬৬ সালে প্রথম তিনি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে প্রবেশ করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ৫ম তেহরান দ্বিবার্ষিক; ৩য়, ৪র্থ, ৫ম এবং ৬ষ্ঠ বাৎসরিক আন্তর্জাতিক মিনিয়েচার আর্ট ১৯৮৮-৯১ টরেন্টো, কানাডা; ১৯৯০ ও ১৯৯৩ সালে আমেরিকার ফ্লোরিডায় অনুষ্ঠিত মিনিয়েচার আর্ট সোসাইটি আয়োজিত বার্ষিক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী এবং ১৯৭৫ ও ১৯৯৭ সালে ভারতের নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত ত্রিবার্ষিক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী উল্লেখযোগ্য।

সমরজিৎ রায় চৌধুরী একজন সৃজনশীল শিল্পী। তার কাজের পরিধি নিজ দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও একটা বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। তিনি বাংলাদেশের বাইরে ১৯৮১ সালে হংকং এ অনুষ্ঠিত প্রদর্শনী ছাড়াও কোলকাতা, দিল্লী ও মুম্বাইতে বাংলাদেশের সমকালীন শিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। এভাবে বিভিন্ন দেশে একের পর এক প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরেছেন। কখনও ইতালি, প্যারিস, জিম্বাবুয়ে আবার কখনও কোলকাতা, মস্কো, ওমান নিউইয়র্ক ও ব্রাসেলস প্রভৃতি শহরে। তিনি ১৯৮৫ সালে যুগোশ্লাভিয়ার সরকারী উদ্যোগে আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত ছাপা ও ড্রইং প্রদর্শনীতে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শিল্প উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। সরকারী কিংবা বেসরকারী উদ্যোগে বিভিন্ন গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত গ্রাফিক্স ডিজাইনের বিভিন্ন বিষয় ও সমকালীন বিষয়ে একক বা গোষ্ঠি ভিত্তিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন সংগঠন ও উদ্যোক্তাদের আয়োজিত সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছেন।

সমরজিৎ রায় চৌধুরী সম্পর্কিত গ্রন্থে সমকালীন ২১টি শিল্পকর্ম, ১৬টি চিত্রশিল্পের ফলিও, নির্বাচিত ২৪জন চিত্র শিল্পীদের ড্রইং ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চিত্রকর্ম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া আর্ট ও ক্রাফর্ট সম্পর্কে বেতারে কথিকা সম্প্রচার শিল্পানুরাগীদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।

সমরজিৎ রায় চৌধুরী বিভিন্ন জাতীয়, বহুজাতিক কোম্পানীর বইয়ের অলংকরণ, বইয়ের নকশা, গ্যালারী প্রদর্শনী নকশা, বাংলা একাডেমির, বাংলা ইলেকট্রনিক টাইপরাইটারের জন্য নতুন বর্ণমালার সংযোজন করেছেন। তিনি বইয়ের প্রচ্ছদ, পোষ্টার, ফোল্ডার, সার্টিফিকেট, ক্যালেন্ডার এবং মনোগ্রামের কাজগুলো শৈল্পীক মাধুর্য দিয়ে সুন্দর ও নিখুঁতভাবে করে থাকেন। এ ছাড়াও তার শিল্পকর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে নকশা, অলংকরণ এবং মনোগ্রামের ডিজাইন। এ ক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য মনোগ্রাম নকশার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি, বরিশাল ক্যাডেট কলেজ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী অন্যতম। এ ছাড়াও তিনি অসংখ্য শীর্ষ স্থানীয় সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামের নকশা করে অভিনন্দিত হয়েছেন। খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব হিসাবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, এবং দেশে বিভিন্ন কর্মশালায় বইয়ের প্রচ্ছদ নকশা অঙ্কনে শিল্পকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন চিত্র প্রতিযোগিতার জুরী বোর্ডের সদস্য হিসাবে সম্মানীত হয়েছেন। তিনি বাংলা একাডেমী এবং বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের আজীবন সদস্য। বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধানসহ অন্যান্য ডিজাইনের শিল্পকর্মে অবদানের জন্য অসামান্য প্রশংসা লাভ করেছেন। তিনি বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন সংগঠনসহ সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেছেন। দেশ ও বিদেশে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে তার চিত্রকর্মের সংগ্রহ সমাদৃত হচ্ছে। ইদানিং বাংলাদেশ ব্যাংকের রংপুর-এ তার ৪৬০.২৭ বর্গফুট-এর মুর‌্যাল চিত্র ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ শোভা পাচ্ছে। ব্যক্তিগত ও আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে তিনি ভারত, মালয়েশিয়া, ব্যাংকক, কম্বোডিয়া, নেপাল, ভুটান, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালী ও গ্রীস ভ্রমণ করেছেন। সমরজিৎ রায় চৌধুরী সরকারী চারুকলা ইন্সটিটিউটে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে চারুকলা ইন্সটিটিউট) দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর চাকুরী করে ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণ করে বর্তমানে সুপার নিউমেরারী প্রফেসর হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে কর্মরত আছেন।

কণ্ঠ সংগীত : ফাহমিদা খাতুন
দেশের সংগীতজগতে একটি উজ্জল নাম, ফাহমিদা খাতুন। ১৯৪২ সালের ২৭ জুলাই শিক্ষা-সংস্কৃতি-মানবতাবোধে ঋদ্ধ এক পরিবারে জন্ম রবীন্দ্রসংগীতের এই গুণী শিল্পীর। পিতা, মুক্তচিন্তার অধিকারী আধুনিকমনস্ক বিজ্ঞানী-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ-ক্রীড়াবিদ সংস্কৃতিপ্রেমী, স্বনামে খ্যাত জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহের হোসেন। মা সাজেদা খাতুন ব্রিটিশ আমলে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত শাখাওয়াত মেমোরিয়াল হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন। তার পড়ালেখার নেশা ছিল বলে অনুবাদের কাজ করেছেন বড় পরিবার সামলাতে সামলাতেই। এমন এক পরিবেশ থেকে প্রায় পুরোটাই নিতে সক্ষম হয়েছেন ফাহমিদা। শৈশব থেকেই মেতে উঠেছিলেন গান-খেলা আর লেখাপড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন প্রাণিবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশায় বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও গান তাঁর আজীবনের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। আরও শখ বাগান করা, পাখি আর নানা প্রাণি পোষা এবং রান্না-বান্না।

বাড়ির আদরের লীনু স্কুল জীবন থেকেই গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তার দুই বোন সংগীত-সংস্কৃতি জগতেরই সানজীদা খাতুন আর মাহমুদা খাতুনও স্বনামে খ্যাত। শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন বড় বোন জোবায়দা মির্জা। লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বড় দুই ভাই কাজী আনোয়ার হোসেন ও কাজী মাহবুব হোসেন। এমন এক পরিবার থেকে নিজ গুণে আলাদাভাবেই বড় মাপের মানুষ হয়ে উঠেছেন ফাহমিদা। ১৯৫৭ সালের শিক্ষা সপ্তাহের প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে। ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন ১৯৬১ সালের রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের সময় পাকিস্তানি শাসকদের হুমকি উপেক্ষা করে নানা অনুষ্ঠানে গান গেয়ে। দেশের বাংলা চলচ্চিত্র ‘ধারাপাত’-এ প্রথম রবীন্দ্রসংগীত ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’ তারই গাওয়া।

ফাহমিদা খাতুনের সংগীতশিক্ষার ভিত গড়ে দেন খ্যাতিমান টপ্পা গায়ক হেকিম মুহম্মদ হোসেনের পুত্র মনির হোসেন। রবীন্দ্রসংগীতে পাঠ নিয়েছেন আব্দুল আহাদ, কলিম শরাফী ও সনজীদা খাতুনের কাছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ‘স্বার্থক জনম আমার’, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’ প্রভৃতি গান গেয়ে। ১৯৭১ সালের ২৩ শে মার্চের প্রজাতন্ত্র দিবসে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের উপেক্ষা করে দিনের অনুষ্ঠান শেষ করার সময়, রাত ১২ টায়, পাকিস্তানি জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা প্রদর্শন এড়িয়ে টেলিভিশনে প্রচারিত হয় ফাহমিদার গাওয়া ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’ গানটি।

ফাহমিদার গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতের তিনটি রেকর্ড ও ছয়টি ধ্বনিমুদ্রিকা (সিডি) প্রকাশিত হয়। আছে একটি অতুল-কান্ত-দ্বিজেন্দ্র গীতির সিডিও। দেশের বাইরে ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ফ্রান্সে আয়োজিত হয়েছে ফাহমিদার গানের একাধিক অনুষ্ঠান। তিনি বিবিসি ও ভিওএর অনুষ্ঠানে গেয়েছেন, অংশ নিয়েছেন আলোচনায়। তার স্বীকৃতির ভান্ডারে যুক্ত হয়েছে সিক্যুয়েন্স পুরস্কার, ১৯৭৩; বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর গুণীজন সম্মাননা, ২০০১; কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী স্মৃতি সম্মাননা, ১৪১৪; কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের গুণীজন সম্মাননা, ২০১০; রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষ উদ্যাপনে ভারতের রবিতীর্থ, পথের পাঁচালী ও মঞ্জিস প্রদত্ত গুণীজন সম্মননা, ১৪১৭; রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষ উদ্যাপনে চ্যানেল আইয়ের রবীন্দ্র মেলায় আজীবন সম্মাননা, ২০১১; বাংলা একাডেমীর রবীন্দ্র পুরস্কার, ২০১২।

ষাটের দশকে ফাহমিদা খাতুনের গান শুনে মুগ্ধ কবি শামসুর রাহমান তাঁর ‘ঋণী’ কবিতায় লিখেছেন-

ফাহমিদা সুর ভাঁজে- এ-ও এক বৃষ্টি অপরূপ,
অস্তিত্ব ডুবিয়ে নামে। গীতবিতানের কিছু নিভৃত নিশ্চুপ
পাতা ওড়ে অলৌকিক কলরবে, গাংচিলের মতো ওড়ে
ঘোরে সারা ঘরে
প্রাণের ঊর্মিল জল ছুঁয়ে যায় কতো ছলভরে।

চলচ্চিত্র : মানজারে হাসীন (মুরাদ)
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের একজন গুণী ব্যক্তিত্ব মানজারে হাসীন (মুরাদ)। ১৯৫৪ সালের ২১ অক্টোবর রংপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুল হক খন্দকার ও মাতা রুবী খন্দকার। ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীল কর্মকান্ডের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। ১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি চলচ্চিত্র মাধ্যমের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। পরবর্তীতে বৃত্তি নিয়ে ১৯৮৭ সালে চেক প্রজাতন্ত্রের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে ডিপ্লোমা এবং ১৯৮৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

দেশে ফিরে মানজারে হাসীন চলচ্চিত্র নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। বিশেষ নির্মাণ কৌশল, কারিগরী, চিত্রনাট্য রচনা, পরিচালনা ও নেপথ্যের আনুষঙ্গিক কাজে সতীর্থ ও কলাকুশলীদের প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য বিষয়ে সহায়তা প্রদান করেছেন। তার নির্বাচিত চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আমি সুদূরের পিয়াসী’, ‘কৃষ্ণনগরে একদিন’, ‘বিল ডাকাতিয়ার বৃত্তান্ত’, ‘রোকেয়া’, ‘সোনারগাঁর কথা’, ‘চারুশিল্পে মুক্তিযুদ্ধ’, ‘অগ্নিজিতা’, ‘আমাদের ছেলেরা’, ‘অপরাজিতা’, ‘অভিযাত্রী’ ও ‘স্মৃতির ঠিকানা’।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের স্বনামধন্য ও প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব মানজারে হাসীন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিচরণ করেছেন এবং সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর বহন করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। চলচ্চিত্রের এই নির্মাতা ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ছাড়াও ভারত, নেপাল, জাপান, জার্মানী, যুক্তরাষ্ট্র ও ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্র উৎসব এবং আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ ও প্রামাণ্যচিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করে সুনাম অর্জন করেছেন।

মানজারে হাসীন চলচ্চিত্র নির্মাণ ও চলচ্চিত্র শিক্ষকতায় নিয়োজিত। তিনি ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান, চলচ্চিত্র ও মিডিয়া বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; খন্ডকালীন শিক্ষক ফিল্ম ও টেলিভিশনবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; মিডিয়া বিভাগ, আই.ইউ.বি, ঢাকা এবং বিভিন্ন সময়ে চলচ্চিত্র বিষয়ক কর্মশালার পরিচালক। এছাড়াও সাংগঠনিক কর্মকান্ডে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সভাপতি, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটি অব বাংলাদেশ অন্যতম। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদের সম্মানীত উপদেষ্টা এবং ছায়ানট এর সাধারণ পরিষদের সদস্য।

এছাড়াও তার অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখালেখি, চলচ্চিত্র ও শিল্প বিষয়ক সংকলন ‘দৃশ্যরূপ’ সম্পাদনা। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করে থাকেন।

নাট্যকলা : খালেদ খান
নজরুল ইসলাম খান ও খালেদা বেগমের প্রথম সন্তান খালেদ খান ১৯৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার মসদই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। খালেদ খান পারিবারিক পরিমন্ডলের সাংস্কৃতিক বলয় থেকেই নিজের সংস্কৃতিচর্চার প্রেরণা পান। মা, বাবা, দাদা ও নানা সকলেই সংগীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। বাবা নজরুল ইসলাম খান ছিলেন খেলাধুলা, গান-বাজনা ও অভিনয়ে পারদর্শী। শিক্ষকতার পাশাপাশি তার সন্তান ও ছাত্র-ছাত্রীদের সংস্কৃতিবান করে গড়ে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী  মিতা হকের সঙ্গে খালেদ খান ১৯৮৫ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

তিনি ১৯৭৩ সালে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। বাবা তখন সাটুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

খালেদ খান সাটুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন বাবার সঙ্গে ‘শাজাহান’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৭৭ সালে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এর সঙ্গে যুক্ত হন এবং ২০০৮ সাল পর্যন্ত অভিনয় করেন। নাগরিকে তিনি যে সব মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন তাদের মধ্যে ‘অচলায়তন’, ‘মোহনগরী’, ‘নূরুলদিনের সারাজীবন’, ‘কবর দিয়ে দাও’, ‘কোপিনিকের ক্যাপ্টেন’, ‘দর্পণ’, ‘গ্যালিলিও’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’, ‘ঈর্ষা’ ও ‘রক্তকরবী’ অন্যতম। মঞ্চ নাটকে খালেদ খান রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’-এ অভিনয় করে নাট্য বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীকালে ঈর্ষা নাটকে তার অভিনয় ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছায়।

টেলিভিশনে তিনি শতাধিক ছোট নাটকে অভিনয় করেছেন। উল্লেখযোগ্য সিরিজ নাটকগুলোর মধ্যে ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘এই সব দিন রাত্রি’, ‘কোন কাননের ফুল’, ‘রূপ নগর’, ‘দামান’ ও ‘লোহার ছুরি’ অন্যতম। সকাল সন্ধ্যা, এই সব দিন রাত্রি ও রূপ নগর নাটকে অভিনয়ের জন্য তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠেন।

চলচ্চিত্রে তিনি দুটি আর্ট ফিল্মে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন এবং দুটি ছবিই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। প্রথমটি সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে আখতারুজ্জামানের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ‘পোকা মাকড়ের ঘর বসতি’, এবং দ্বিতীয়টি এনামুল করিম নির্ঝরের পরিচালনায় ‘আহা’।

খালেদ খান সর্বমোট ৯টি নাটকে নির্দেশনা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকে নির্দেশনার মাধ্যমে তার নাট্য নির্দেশনা শুরু। এরপর তিনি ইবসেন-এর ‘অ্যা ডল হাউস’ অবলম্বনে ‘পুতুল খেলা’ বুদ্ধদেব বসুর ‘কাল সন্ধ্যা’, নাসরীন জাহানের ‘স্বপ্নবাজ’ ও ‘রূপবতী’, ইবসেনের মাস্টার বিল্ডার্স অবলম্বনে ‘কারিগর’ রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের নাট্যরূপ ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, এবং একটি মিশরীয় নাটক ‘ভূত রাজকতন্ত্র’ নাটকে নাট্য নির্দেশনা প্রদান করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর তিনি অক্সফাম নামে একটি বিদেশী সাহায্য সংস্থায় কিছুদিন কাজ করেন। পরবর্তীকালে তিনি বেসরকারি এবি ব্যাংকে চাকুরি করেন। পরে  তিনি বেক্সিমকো ফার্মাতে যোগদান করে ম্যানেজার পদে আসীন থাকা অবস্থায় বেক্সিমকো ত্যাগ করে বেঙ্গলে এবং শেষে তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বিশ্ববিদ্যাল (ইউল্যাব)-এ প্রথমে শিক্ষকতা এরপর রেজিস্টার এবং সবশেষে কোষাধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

খালেদ খান স্বল্প সময়ের অভিনয় জীবনে বেশ কিছু স্বীকৃতিও পেয়েছেন। এদের মধ্যে থিয়েটার প্রদত্ত মোহাম্মদ জাকারিয়া পুরস্কার, বাচসাস কর্তৃক একাধিকবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এবং মঞ্চ নির্দেশকের পুরস্কার, সিজেএফবিএ কর্তৃক একাধিকবার শ্রেষ্ঠ মঞ্চ নাটক নির্দেশক পুরস্কার এবং ইমপ্রেস-অন্যদিন টেলিভিশন অ্যাওয়ার্ড, শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন অভিনেতা পুরস্কার অন্যতম।

খালেদ খান জীবনের স্বল্পায়তনে নানারকম বৈচিত্রময় কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। অভিনয়, নির্দেশনা, প্রশিক্ষণ, আবৃত্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে নাটককে বিষয় হিসাবে অন্তর্ভূক্তকরণের প্রচেষ্টায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।

২০ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে ‘মটর নিউরন’ রোগে আক্রান্ত হয়ে খালেদ খান মৃত্যুবরণ করেন।


রাইজিংবিডি / রাশেদ শাওন

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়