ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

প্রাণ ফিরে পাচ্ছে কুমার নদ

বাদল সাহা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ২৩ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রাণ ফিরে পাচ্ছে কুমার নদ

বাদল সাহা, গোপালগঞ্জ : শুরু হয়েছে কুমার নদ খননের কাজ। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে চলা কুমার নদ এক সময় ছিল খরস্রোতা।

কুমার নদে চলত পাল তোলা নৌকা ও লঞ্চ। এটি ছিল দেশীয় মাছের ভাণ্ডার। আর দেশীয় মাছ শিকারকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের চলত জীবন জীবিকা।

এলাকায় ব্যাপকভাবে পাটের আবাদ হওয়ায় কুমার নদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বড় বড় বাজার। কুমার নদে বয়ে চলা পানি দিয়ে মাঠে মাঠে ফলত সোনার ফসল।

কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে খনন না করা ও সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় দিনে দিনে কুমার নদ যেন পরিণত হয় খালে। নির্বিঘ্নে দখল হওয়ায় যেন প্রাণ যেতে বসেছিল কুমার নদের। এ নদকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবন জীবিকাও যেন হারিয়ে যেতে বসেছিল।

মরতে বসা কুমার নদ প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। গত শনিবার এর খনন কাজের উদ্বোধন করা হয়। নদের দুই পাড়ের মানুষ আশা করছেন, খননের ফলে সারা বছর নদ থাকবে প্রবাহমান। আবারো এতে চলবে নৌকা ও লঞ্চ। সারা বছর পাওয়া যাবে দেশীয় মাছ। পানি প্রবাহের ফলে দুপাড়ে শত শত একর জমি উর্বর হয়ে উঠবে। খননের ফলে আবারো কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে কুমার নদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মুকসুদপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাজার। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাজারগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে,  কুমার নদ বনগ্রাম-বানেশ্বরদী-হাড়ভাঙ্গা পয়েন্ট থেকে নারানপুর-পৈলানপট্টি, নারানপুর-চাঁদহাট, কমলাপুর-বল্লভদী, টেংরাখোলা-দক্ষিণ চন্ডিবরদী-উত্তর চন্ডিবরদী, লখাইরচর-বাউশখালি, কৃষ্ণাদিয়া-কামারদিয়া, পাচুড়িয়া-জয়বাংলা-যদুনন্দী হয়ে বলুগা-তেতুলিয়া-রুপাপাত পয়েন্টে গিয়ে শেষ হয়েছে গোপালগঞ্জের অংশ।

সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২১ কোটি টাকার বেশি অর্থে কুমার নদ খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। গত শনিবার খনন কাজের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গোপালগঞ্জ-১ আসনের সংসদ লে. কর্নেল (অব.) ফারুখ খান। ২৮.২০ কিলোমিটার খননে মোট পাঁচজন ঠিকাদার কার্যাদেশ পেয়েছেন। ১২৫টি এক্সকাভেটর (ভেকু মেশিন) দিয়ে নদী খননে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছেন তারা।

কাজ শুরুর ৪৫ দিন পর অর্থাৎ আসছে বৈশাখের মধ্যেই এলাকাবাসী কুমার নদ থেকে সুবিধা পেতে থাকবেন। আর ভাদ্র মাসে কুমারে থাকবে ভরা যৌবন । নৌযান চলাচল ও পানি প্রবাহের জন্য খুলে দেওয়া হবে কুমার নদকে।

 



কমলাপুরের কৃষক শেখ সরোয়ার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কুমার নদে পানি না থাকায় স্যালো টিউবওয়েল দিয়ে চাষাবাদ করায় তেমন একটা ফসল ফলাতে পারতাম না। কুমার নদ প্রাণ ফিরে পেলে নদীতে সেচ মেশিন বসিয়ে চাষ করা যাবে। প্রাকৃতিক পানিতে ফসলের ফলন বেশি হবে।’

গোপীনাথপুরের মৎসজীবী রবিন মালো রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘জাল যার জলা তার- এই নিয়মে বাংলাদেশ চললেও আমাদের বিশাল জলাধার কুমার নদ শুকিয়ে যাওয়ায় মাছ ধরা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতে হত। ঘরে জাল দড়ি সব থাকার পরও কুমার নদে পানি না থাকায় পেশা বদল করতে হয়েছিল। এখন আবার আমাদের সুখের দিন ফিরে আসবে।’

টেংরাখোলা গ্রামের মিয়াজন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কুমার নদের পাশে কমলাপুর খাল থেকে এত বেশি দেশীয় মাছ ধরা পড়তো যে খেয়ে শেষ করতে না পেরে খোলায় শুকিয়ে শুঁটকি করা হতো। সেই শুঁটকির মধ্যে বেশি থাকতো পুঁটি-টেংরা মাছ। সেই থেকেই এই জনপদের নাম হয় টেংরাখোলা। কুমার নদ মরার সঙ্গে সঙ্গে সেই মাছও উধাও হয়েছে। দখল বেদখলে নদী আর নেই। যদি কুমার প্রাণ ফিরে পায় তাহলে অন্তত কিছু মিঠা পানির মাছ তো পাওয়া যাবে’

নারায়নপুর গ্রামের শফিউদ্দীন মাতুব্বর রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আগে কুমার নদ দিয়ে নৌকা-লঞ্চে চলাচল করেছি। ফরিদপুর, ভাঙ্গা, খুলনাসহ দেশের নানা জায়গায় নৌকা, লঞ্চে গিয়েছি। আত্মীয়তাও করেছি যত দূরেই হোক নদীর পাড়ে। এখন আর তা নেই। কয়েক মাস আগেও নদীর বুকে হয়েছে ঘোড়াদৌড়। নদীটি খনন করায় সেই আগের স্মৃতিতে ফিরে যেতে পারব।’

পরিবহন ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর মোল্লা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পণ্য এবং উৎপাদিত ফসল পরিবহনে নদীপথে খরচ অনেক কম, সুবিধাও অনেক বেশি। কিন্তু নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় সড়ক পথে পণ্য আনতে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। নদীটি খনন হলে এখন স্বল্প খরচে পণ্য আনা নেওয়া করতে পারব।’

মুকসুদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম শিকদার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে কুমার নদকে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছ। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মুকসুদপুর মরা অংশে কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।’

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অংশীদার আমিনুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আগের মত খরস্রোতা না হলেও নদীর পানি প্রবাহ সারা বছর রাখা এবং নাব্যতা রক্ষার জন্য স্থান ভেদে ৮ থেকে ১১ ফুট গভীর হবে। নদের নিচের তল চওড়া হবে কমপক্ষে ৬৫ থেকে ৭৫ ফুট এবং উপরের চওড়া হবে ১২৫ থেকে ১৩৫ ফুট।’

গোপালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাইনুদ্দীন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পদ্মা থেকে উৎপন্ন হওয়া কুমার নদের ১১৯ কিলোমিটারের গোপালগঞ্জ জেলার ২৮ কিলোমিটার অংশে সংস্কার কাজ শুরু হচ্ছে। এই খনন কাজ মাঠ পর্যায়ে তদারকি করার জন্য রয়েছে চারজন উপ-সহকারী প্রকৌশলী। আশা করি সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী মে মাসের মধ্যে মাঠ পর্যায়ের সকল কাজ শেষ হবে। অফিসিয়ালি সবকিছু শেষ হবে জুন মাসেই। এলাকাবাসী মে মাসের শুরু থেকেই কুমার নদের পানি প্রবাহ সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।’



রাইজিংবিডি/গোপালগঞ্জ/২৩ মার্চ ২০১৭/বাদল সাহা/রুহুল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়