ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

প্রিয় স্যারের দেয়া প্রিয়তম উপহার

রফিক মুয়াজ্জিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২১, ৫ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ১৮:৫৫, ১১ নভেম্বর ২০২২
প্রিয় স্যারের দেয়া প্রিয়তম উপহার

|| রফিক মুয়াজ্জিন ||

১৯৯৩ সাল। কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের শিতাইঝাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির প্রথম ক্লাশ চলছে। অন্য সব শিক্ষক রোল কল শেষে পড়ানো শুরু করলেও নাসির স্যার রোল কল করেন ক্লাশ শেষে। তিনি বুঝতেন, মফস্বলের স্কুলে সব ছেলেমেয়ে সময়মতো ক্লাশে আসতে পারে না। কারণ, সেই সময়ে গ্রামের স্কুলপড়ুয়া শিশুদের শুধু স্কুলে পড়লেই হতো না, সংসারের নানা কাজে সহযোগিতা করতে হতো। হয়তো বাড়ির গাভি দুটোকে মাঠে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আসার পর পাটখেতে কর্মরত বাবাকে খাবার পৌঁছে দিয়ে তারপর স্কুলে আসতে হয়। একই অবস্থা মেয়েদেরও। গৃহস্থালি কাজে মাকে সাহায্য করতে গিয়ে তারাও সময়মতো স্কুলে আসতে পারে না। ফলে, সকাল ১০টার ক্লাশ করতে তারা প্রায়ই সোয়া ১০টা কিংবা সাড়ে ১০টায় আসে। তাই, নাসির স্যার চেষ্টা করেন ক্লাশ শেষে রোল কল করতে। তাহলে কারো ক্লাশে আসতে দেরি হলেও রোল কলের সময় তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়।

যাহোক, ক্লাশ শেষে রোল কল চলছে। প্রথম নামটাই আমার- রফিক আহমেদ। কিন্তু, নাসির স্যার আমার নাম ডাকতে গিয়ে থেমে গেলেন। সে সময় তৃতীয় শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে একটা কবিতা ছিল- আলোর ভোর। কবি ফজলুর রহমান। কবিতার প্রথম দুটি পঙ্‌ক্তি এ রকম- ‘পূব গগণে আলোর পরী বাজায় সোনার বীণ/মিনার হতে আজান হাঁকে রফিক মুয়াজ্জিন।’ নাসির স্যার সেদিন এ কবিতাটিই আমাদের পড়িয়েছেন। রোল কলের সময় তিনি হঠাৎ থেমে আমার দিকে তাকালেন।

অ্যাই, আজ থেকে তোর নাম রফিক আহমেদ না, রফিক মুয়াজ্জিন। রফিক মুয়াজ্জিন লিখবি, বুঝলি?

পরে সবার উদ্দেশে নাসির স্যার বললেন, আজ থেকে ওকে সবাই রফিক মুয়াজ্জিন বলে ডাকবি।  

সবাই বলল, জ্বি, স্যার।

স্যার হাজিরা খাতায় আমার নামের শেষ অংশ ‘আহমেদ’ কেটে দিয়ে ‘মুয়াজ্জিন’ লিখে দিলেন। আমাকে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, আমার নাম এখন থেকে ‘রফিক মুয়াজ্জিন’।

ক্লাশ শেষে সবাই খ্যাপাতে লাগল- ‘মুয়াজ্জিন, মুয়াজ্জিন। মিনার হতে আজান হাঁকে রফিক মুয়াজ্জিন।’ আমার মন ভীষণ খারাপ হলো। কারণ, সচরাচর কারো নাম তো এরকম হয় না। কোথাও শুনিনি আগে। স্যার আমাকে অনেক ভালোবাসেন। তারপরও তার ওপর আমার অনেক রাগ হলো। ভাবলাম, আর ক্লাশ করব না। পালিয়ে বাড়িতে চলে যাব। যাওয়ার উপায় ছিল না। ততক্ষণে বাবর স্যার ক্লাশ নিতে চলে এসেছেন।

নতুন নাম মেনে নিতে আমার আরো কিছু দিন সময় লেগেছিল। ধীরে ধীরে এর প্রতি আমার প্রগাঢ় ভালোবাসা জন্মায়। ভাবি, সবার এমন সৌভাগ্য হয় না। সবার শিক্ষক সবাইকে এমন মধুর নাম উপহার দেন না। প্রিয় স্যার যখন ভালোবেসে এমন নামকরণ করেন, তখন তো সেটা অমূল্য উপহার। পরে বিভিন্ন সময়ে যখন কেউ আমার ‘মুয়াজ্জিন’ নামকরণের ইতিবৃত্ত জানতে চান, আমি গর্বভরে বলি, প্রিয় নাসির উদ্দিন স্যার আমার নামের সঙ্গে ‘মুয়াজ্জিন’ জুড়ে দিয়েছেন। এটা প্রিয় স্যারের পক্ষ থেকে পাওয়া আমার প্রিয়তম উপহার।

আমি চতুর্থ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার কিছুদিন পরই নাসির স্যার শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন। অনেক দিন দেখা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। বাড়ির কাছের বাজারে চায়ের দোকানে স্যারের সঙ্গে দেখা। কুশলাদী জিজ্ঞেস করলাম। স্যার জানতে চাইলেন, এখন কোথায় পড়ি? বাবা সঙ্গে ছিলেন। তিনি স্যারকে বললেন, স্যার, রফিক মুয়াজ্জিন এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। দোয়া করবেন, ও যেন আপনার দেওয়া নাম উজ্জ্বল করতে পারে।

স্যারের বেশ বয়স হয়েছে। তিনি আমার নামকরণের বিষয়টি স্মরণ করতে পারলেন না। আমি স্মরণ করিয়ে দিলাম। স্যার খুব খুশি হলেন। তার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। তিনি জানালেন, তার ছাত্রদের মধ্যে এই প্রথম কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলো। তাকিয়ে দেখি, বাবার চোখেও পানি। আমার চোখে জল চিকচিক করেছে কি না, আমি দেখতে পারিনি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়