বিশ্ব গ্রন্থ দিবস
বই নিয়ে ভিনদেশী ৮ কবিতা
বইয়ের মতো আর কোনো দ্রুতগতির রণতরী নেই
আমাদের দূরের ভূমিতে নিয়ে যাবে,
কিংবা পৃষ্ঠার মতো দ্রুতগতির কোনো অশ্ব নেই
কবিতা নিয়ে লাফাবে।
এ ভ্রমণ হয়তো-বা নগণ্যতমই নেবে
কোনো রকম শুল্কের নিপীড়ন ছাড়াই;
কতো পরিমিতব্যয়ী এই রথ
যা মানুষের আত্মা বহন করে!
একটি বই খোলো
আর তুমি পেয়ে যাবে
সব ধরণের মানুষ আর স্থান;
একটি বই খোলো
আর তুমি হতে পারবে
যা যা খুশি তুমি চাও;
একটি বই খোলো
আর তুমি ভাগ করে নিতে পারবে
যে আশ্চর্য পৃথিবী ওখানে তুমি পেয়েছো;
একটি বই খোলো
এবং আমি আমিও খুলবো
তুমি আমার জন্যে পড়বে
আর আমিও তোমার জন্য পড়বো।
সন্ধ্যায় যখন আলো জ্বালানো হয়
আমার অভিভাবক আলোর পাশে বসে রয়
তারা ঘরে বসে থাকে আর কথা বলে গান গায়
আর তারা সময় কাটায় না খেলাধুলায়।
এখন আমি আমার ছোট্ট বন্দুক নিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে
গভীর অন্ধকারে দেয়ালের ধার ছুঁয়ে
এবং বনের গহীন পথ পেয়ে যাই এগিয়ে
সোফার পেছন দিক দিয়ে।
এখানে, রাত্রিরে, কেউ পারবে না গুপ্তচরগিরি করতে
আমি একা রয়েছি আমার শিকারীর তাবুতে
আর খেলছি সেই সব বই নিয়ে যাদের পড়েছি একসময়
যদিও এখন হয়ে গেছে বিছানায় যাওয়ার সময়।
এরা হলো পাহাড়, এরা হলো শব্দরাশি
এরা হলো আমার তারা ভরা একাকী হাসি
আর এরাই হলো নদী যার কিনারে
গর্জনরত সিংহরা জল পান করে।
আমি অন্যদের দেখি দূরে অনেক দূরে
যেন এই আগুন জ্বালানো ক্যাম্পের ধারে
আর আমি ঠিক এক ইণ্ডিয়ান বালকের মতো
দেখি ওদের শিকার খোঁজার উল্লাস যতো।
তাই, ধাত্রী যখন আমার খোঁজ করে
সমুদ্র পার হয়ে তখন ফিরি আমি ঘরে
এবং বিছানায় যাই পেছনের চোখ রেখে
আমার প্রিয় গল্পের-দেশের দিকে।
এবং এখনও বইগুলো সেলফে রয়ে যাবে, আলাদা প্রাণ হয়ে,
যা একদা আবির্ভূত হয়েছিলো, এখনও আর্দ্র
যেন এক উজ্জ্বল বাদাম বৃক্ষ শরতের আকাশ তলে
এবং আবেগতাড়িত, আহ্লাদিত, বাঁচতে শুরু করে
যদিও দিগন্তে আগুন জ্বলছে, দিবাস্বপ্নরা উড়ে যাচ্ছে,
গোত্রের লোকেরা কদম বাড়াচ্ছে, এই গ্রহ ঘুরছে, ঘুরছে।
‘আমি আছি’ ওরা বললো, যদিও তাদের পৃষ্ঠাগুলো
ছিঁড়ে গেছে প্রায়, কিংবা এক গুঞ্জরিত শিখা
চেটে নেয় তাদের অক্ষরগুলো। তবু অনেক অনেক বেশি স্থায়ী
আমাদের চেয়ে, যার অস্থায়ী উত্তাপ
শান্ত হয়ে যায় স্মৃতিতে, উধাও, বিনাশ প্রায়।
আমি কল্পনা করি তখনকার পৃথিবীর যখন আমি আর থাকবো না:
কিছু ঘটবে না, কোনো লোকশান নাই, তবু তা আজব নাট্য রয়ে যাবে
নারীরা পোশাক পরবে, শিশিরস্নাত লাইলাক, উপত্যকায় যেন গান।
তবু বইগুলো রয়ে যাবে ওখানে বইয়ের তাকে, জাত্য
জন্ম,
মানুষ থেকে প্রাপ্ত, কিন্তু প্রভাময়,
উচ্চতায়।
আমি বই সংগ্রহ করতে থাকি আমি জানি
আমি কখনো, কখনোই পড়বো;
আমার বউ আর কন্যা তেমনই বলে
এবং আমি কখনোই তা মানবো না।
‘দয়া করে আমাকে নিন’ বলে সতৃষ্ণ বৃহৎ বইখানা
‘তোমার নিজের একটি ক্ষুদ্রাংশ।’
আর আমি তাই আমার ছোট্ট গুপ্তধন বাড়ি নিয়ে যাই,
আর ওকে বইয়ের তাকে গুঁজে দেই।
আর এখন আমার একান্ত বইয়ের তাক অভিযোগ করে:
ওরা গাদাগাদি করছে, ছিটকে পড়ছে।
ওরা বলে, ‘আপনি কেন আমাদের টানাটানিতে সহজ করে দেন না?’
‘কোনো একদিন’ আমি বলি, ‘আমি করে দেবো।’
তাই বইয়ের পরে বই অভিযোগ করে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে
আমি তুলে দেখি আর তলিয়ে দেখি আর খুঁটিয়ে দেখি;
তারপর ফিরিয়ে রাখি তাদের, নিদারূণ বেদনায়
আমি যে অনেক ব্যস্ত মানুষ।
এখন, এই যে ওখানে আমার বসওয়েল আর স্টার্ন,
আমার গিবন ও ডিফো;
রসালো স্যুইফ আমি কখনোই কি জানবো না,
মন্তাগিন আপনাকেও হয়তো জানবো না।
বেকনের প্রতি আমি কখনোই চুমুক দেব না
শেকসপিয়রের জন্যে আমার সময় নেই;
কারণ আমি ব্যস্ত আছি
এই সুরেলা ছন্দের ঝঙ্কার তৈরিতে।
চেকভ আমার কাছে ক্যাভিয়ারের মতো
অন্যদিকে স্ত্যান্দাল নাক ডাকতে দেয়;
বেচারা প্রুস্ত আমার ধাচের নয়
আর বালজাক একঘেঁয়ে।
ওদের বই আমার আছে, আমি ওদের নামও ভালোবাসি
এবং তবুও হায়! ওরা চলে যায়
লরেন্স, জয়েস আর হেনরি জেমসের সাথে
আমার অপঠিত বইয়ের তালিকায়।
আমার মনে হয় এটা বেশ ভালো হতো
যদি আমি একটা অপরাধ করতাম,
আর জেলখানার একটা কুঠুরিতে থাকতাম
এবং ছড়া কবিতা লেখার অনুমতি না-পেতাম;
এবং তারপরও এইসব মূল্যবান বইগুলো পেতাম
আমার প্রয়োজন মতো,
আমি তখন ওদের যত্ন নিতাম প্রেমময় চোখে
কিন্তু কখনো, কখনোই পড়তাম না।
ভালো বই যেন বন্ধুত্বপূর্ণ কিছুর মালিকানা।
তুমি ব্যস্ত থাকলে তারা তোমার অপেক্ষায় থাকবে।
তারা তোমাকে ফোনে ডাকবে না
কিংবা বেলা বেড়ে গেলে ঘুম থেকে ডাকবে না।
তারা একত্র দাঁড়াবে সারি ধরে,
নিচের তাকে কিংবা উপরের তাকে।
কিন্তু যদি তুমি নিঃসঙ্গ বোধ করো তবে তো জানো-
তোমার একজন কিংবা দুচারজন বন্ধু আছে কাছেই।
বইয়ের সাহচার্য যথার্থ একদম।
তারা কখনোই শরগোল করবে না তুমি যখন স্থির।
তারা কখনোই তোমার খাওয়ার সময় বিরক্ত করবে না।
যখন তুমি অসুস্থ তারা তোমাকে আরাম দেবে।
তারা নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোর অংশীদার হবে।
সরিয়ে দিলেও তারা অভিযোগ করবে না।
এবং যদিও তুমি তাদের যত্ন নিতে অস্বীকার করো
তোমার ধ্রুব বন্ধু তখনও রয়ে যাবে।
ভালো বই কখনো তোমার ভুল দেখবে না
কিংবা সেগুলোর কথা শহরময় বলে বেড়াবে না।
যদি তুমি তাদের সংশ্রব পেয়ে যাও
কদাচ তুমি ওদের নামিয়ে রাখতে পারবে।
তারা সময়কে দূরে সরাতে সাহায্য করবে,
তারা পরামর্শ দেবে যদি তুমি প্রয়োজন বোধ করো।
তারই আছে সত্যিকারের বন্ধু দিনে ও রাতে
যার আছে পড়ার মতো ভালো কিছু বই হাতে।
একটা বই হলো পৃষ্ঠা, ছবি আর অনেক শব্দ
একটা বই হলো জীব-জন্তু, মানুষ আর বিহঙ্গ
একটা বই হলো রাণী আর রাজার কাহিনী
কতো কিছু নিয়ে কবিতা আর গানের বাণী!
এক কোণায় কুচিমুচি করে থাকে যেখানে আমি লুকাতে পারি
একটা বই সঙ্গে নিয়ে দূরে আর অনেক ঘুরে আসতে পারি
যদিও এটা কেবলই শেষতক কাগজ আর কাগজের সমাহার
তবুও একটা বই-ই হলো বিশেষ বন্ধু সবার।
আমি একটা ড্রাগনের সাথে মুখোমুখি হয়েছি যখন
আমার বয়স ছিলো মাত্র দশ তখন,
আমি মহাশূন্যে অভিযান করেছি প্রায়
নিশ্চিন্তে আমি গিয়েছি এক জলদস্যুর আস্তানায়
কুস্তি লড়েছি আমি দানবের সাথে
লড়াই করেছি শ্বেত হাঙ্গরের সাথে
আমি পথ খুঁজে নিয়েছি খরগোশের অচেনা গর্তে
শিকার করে ফিরেছি অজানা প্রাণীদের।
আমি ডুবোজাহাজে ঘুরেছি সদাই
যাদুর দরজা আমি খুলেছি হামেশাই
টাইম মেশিনে করে ঘুরেছি আমি
দৈত্যের মাথায় চড়েছি আমি
আর খুঁজে পেয়েছি স্বর্ণ পাত্র।
এইসবই আমি করেছি যে সব বই আমি পড়েছি
তখন আমার বয়স দশ ছিলো আগেই স্বীকার করেছি।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ এপ্রিল ২১০৮/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন