ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বইয়ের সংজ্ঞা ও বিশ্বের প্রাচীন বই

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৪, ২২ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বইয়ের সংজ্ঞা ও বিশ্বের প্রাচীন বই

মুম রহমান : সাহিত্যের ইতিহাসের যথার্থ দিন-তারিখ খুঁজে বের করা বড়ই দুষ্কর। কেননা, যখন লিপি আবিষ্কার হয়নি, অর্থাৎ লিখিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই সাহিত্যের সৃষ্টি। সোজা বাংলায় বলা যেতে পারে, প্রাগৈতিহাসিক যুগেই সাহিত্য এসে গেছে। এটা ভাবা খুব অসঙ্গত নয় যে, মানুষের কথা বলা ও কল্পনার ক্ষমতার সাথে সাহিত্য জড়িত। মৌখিক সাহিত্যের ইতিহাস সুপ্রাচীন। গান, অভিনয়, আবৃত্তি ইত্যাদি নানা ভঙ্গিতেই মুখে মুখে সাহিত্য ছড়িয়েছে। অন্ধ কবি হোমারের মহাকাব্য মুখে মুখে গাওয়া হতো। রামায়ণ-মহাভারতও তাই। তারও আগে, মায়ের মুখের ঘুমপাড়ানি গান থেকে শুরু করে দাদা-দাদীর গল্প বলার ঐতিহ্যের মধ্যেও লুকিয়ে আছে সাহিত্যের অঙ্কুরোদগমের ইতিহাস।

ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম থেকে চতুর্থ শতকের সময়ে মানুষ লিখতে শুরু করেছে। পাথর, কাদামাটি (পরে যা পুড়িয়ে ফলক করা হতো), মৃৎপাত্র, গুহার দেয়াল, মন্দিরের দেয়াল-দুয়ার, খিলান, তালপাতা, প্যাপিরাস (মিশরে প্রাপ্ত এক ধরণের পাতা), চামড়া এমনকি শবাধারেও (কফিন) মানুষের লিখিত পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। উল্লেখ্য এর সবই যে সাহিত্য কিংবা গ্রন্থ হিসেবে বিবেচ্য তা নয়। কাজেই প্রাচীনতম বইয়ের কথা বলতে গেলে অন্য সংকট তৈরি হয়। আগে প্রাপ্ত লিপিমালা বই কিনা সেটা ভেবে দেখতে হয়। অভিধানের সংজ্ঞা মতে, একগুচ্ছ ছাপার কাগজ যা একটা নির্দিষ্ট বিষয় কিংবা মলাটের মধ্যে ধরে যায় তাকে বই বলে (দ্রষ্টব্য: ম্যারিয়াম-ওয়েবস্টার ডিকশনারি)। এই সংজ্ঞায় পোড়ামাটির ফলক বা ট্যাবলেট, স্ক্রল (চামড়া বা কাগজের তৈরি দীর্ঘ প্যাঁচানো বা গুটানো লেখা), প্রস্তরস্তম্ভ, শিলালিপি, কফিন, পিরামিড ইত্যাদি বইয়ের আওতায় পড়ে না; যদিও এর অনেকগুলোতেই সাহিত্য পদবাচ্য উপাদান আছে।

উল্লেখ্য, একাধিক ধর্মগ্রন্থও শুরুতে পাথরে বা ফলকে খোদাই করা হয়েছে, পরবর্তীতে যা ছাপার অক্ষরে বই হিসাবে গণ্য হয়েছে। অন্যদিকে, অনেক পণ্ডিত মনে করেন, বই হতে হলে লিখিত উপাদানের একটা নির্দিষ্ট বৈশ্বিক ভাবনা থাকতে হবে। ধরুন, হিসাবের খাতা, সেটা তো আর বই হিসাবে গণ্য হতে পারে না। খবরের কাগজে বইয়ের অনেক উপাদান থাকতে পারে, বৈশ্বিক বিষয়ও আছে, কিন্তু সেটাও বই নয়। বই হতে হলে তার যেমন সাহিত্য মূল্য দরকার তেমনি দরকার একটা সুনির্দিষ্ট বিষয়-ভাবনার প্রকাশ। সর্বোপরি, চিন্তাশীল কর্মের ফসল। নেহাতই তথ্যভাণ্ডার নয়, ভাবনার খোরাকও দেবে বই। অভিধান, বিশ্বকোষ ইত্যাদি ছাপার অক্ষরে এক মলাটে বই আকারে প্রকাশ হয়, তবে চরিত্রগত দিক থেকে তা বই নয়। ওগুলো তথ্যসূত্র হিসেবেই প্রয়োজনীয়- আলাদা করে পাঠ বিবেচ্য নয়। সেই বিবেচনায়, পাঠ যোগ্যতাও একটা বইয়ের বড় মাপকাঠি। পাঠকের জায়গা থেকে দেখলে অবশ্যই বইয়ের সংজ্ঞায়ন আরো বিস্তৃত হতে পারে। বই যে পৃথিবীতে কতো রকমের, ধরণের হতে পারে সে আলোচনা হতে পারে। এখানে বরং সোজাসুজি পৃথিবীর প্রাচীনতম কিছু বইয়ের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।

কোডেক্স বলতে হাতে লেখা পুঁথি বোঝানো হয়। ছাপাখানার আগে হাতে লেখা পুঁথিই ছিলো জ্ঞান অর্জনের অন্যতম হাতিয়াড়। প্রাচীন বাইবেল থেকে শুরু করে, গ্রীক-রোমান সাহিত্যের একটা বড় অংশ হাতেই লেখা হয়েছে। কোডেক্সগুলো সচিত্রিতও বটে। ‘মাদ্রিদ কোডেক্স’ ১৮৬৯ সালে স্পেনের মাদ্রিদে আবিষ্কৃত হয়েছে। মায়া সভ্যতার পূর্ববতী যুগের একমাত্র টিকে থাকা এই পুঁথিটি সম্ভবত ষোড়শ শতকের স্পেন বিজয়ের আগে রচিত। এটি ইয়োকাটেকান ভাষায় রচিত। ইয়োকাতেক, ইৎজা, লাকানডোন এবং মোপান- এই সব মায়ান ভাষার সম্মিলিত রূপ ইয়োকাটেকান ভাষা। স্পেনের মাদ্রিদের মিউজো দ্যু আমেরিকাতে বইটি আজও সংরক্ষিত আছে। আরেকটি আলোচিত কোডেক্স হলে ‘কালিক্সটিনাস’। ফরাসী সন্ত আইমেরি পিঁকা ১২ শতকের মাঝামাঝি এই পুঁথি রচনা করেন বলে ধারণা করা হয়। এই গ্রন্থের পাঁচটি অধ্যায়ের প্রথম চারটিই ধর্মীয় বাণী। তবে এর পঞ্চম অধ্যায়টি আজ পর্যন্ত বেশি জনপ্রিয়। এই অধ্যায়টি স্পেনের ক্যাথিড্রাল অব সান্তিয়াগো দ্যু কমপোস্টেলা যাত্রার জন্যে তীর্যযাত্রীদের জন্যে নির্দেশনা হিসেবে রচিত হয়েছে। এটিকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের প্রথম ভ্রমণ নির্দেশনা বা ট্রাভেল গাইড। এই গাইডে বর্ণনা করা হয়েছে একজন ফরাসী কী করে স্পেনে যাবেন, কোথায় থাকবেন, কী খাবেন না, কী করবেন, কী করবেন না ইত্যাদি। ২০১১ সালে এই মূল্যবান বইটি ক্যাথিড্রালের আর্কাইভ থেকে চুরি যায়। ধারণা করা হয়েছিলো এই বইটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। কিন্তু এক বছর অনুসন্ধানের পর ক্যাথিড্রালের একজন প্রাক্তন ইলেকট্রিশিয়ানের বাড়ির গ্যারেজে আরো একাধিক মূল্যবান গ্রন্থ এবং এক মিলিয়ন ডলারসহ এই বইটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বর্তমানে আরো অধিক জোড়ালো নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ বইটি ক্যাথিড্রাল অব সান্তিয়াগো দ্যু কমপোস্টেলায় সংরক্ষিত আছে।

‘কালিক্সটিনাস কোডেক্স’ প্রাচীন বইয়ের মধ্যে অন্যতম আলোচিত একটি বই। জার্মানির বাভারিয়ার উটা প্রদেশে প্রাপ্ত পুঁথি দ্য উটা কোডেক্সও একটি ধর্মীয় গ্রন্থ। এটি মূলত একটি লেকশোনারি। লেকশোনারি হলো বাইবেলের নির্বাচিত উক্তি বা অংশসমূহের সংকলন যা বিভিন্ন ধর্মীয় উপলক্ষে বা অনুষ্ঠানের সময় গীর্জায় গাওয়া বা আবৃত্তি করা হয়। ১০২৫ সালে রচিত এই কোডেক্সের বিশেষ উল্লেখযোগ্যতা হলো এটি দারূণ কারুকাজময়। একাদশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য খোদাই কর্মের অন্যতম নমুনা এটি। এর সোনার তৈরি আসল বাক্সটি যার মধ্যে বইটি সংরক্ষিত করা হয়েছে সেটি আজও অক্ষত আছে। এই পুঁথিটি জার্মানির মিউনিখে বাভারিয়ান স্টেট লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনের ত্রিনিতি কলেজ লাইব্রেরিতে রাখা আছে কেল্ট ভাষীদের প্রাচীনতম টিকে যাওয়া বই ‘বুক অব কেলস’। ৮০০ খ্রিস্টাব্দে কেল্ট সাধুরা স্কটল্যান্ডের দ্বীপ আয়োনাতে এই বইটি তৈরি করে পরবর্তীতে কেলস-এর মঠে নিয়ে আসেন। ধারণা করা হয় যে তিনজন চিত্রকর ও চারজন লিপিকর মিলে এই অনবদ্য নান্দনিক বইটি তৈরি করেছেন। কোডেক্স কেনানেনসিস, লেয়াবহার চিয়ানেনআসি ইত্যাদি নামেও এই বইটি পরিচিত। ল্যাটিন ভাষায় রচিত এই বই মূলত নতুন টেস্টামেনের চারপি গসপেল এবং তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে রচিত। পশ্চিমা লিপিবিদ্যা এবং আইকোনোগ্রাফির চূড়ান্ত বিকাশ লক্ষ্য করা যায় এই বইতে। দারূণ বর্ণিল সব ছবি ও লিপিমালা দিয়ে সাজানো এই বই আয়ারল্যান্ডের জাতীয় সম্পদ। সাধু-সন্তের ছবির পাশাপাশি এতে পৌরাণিক জীবজন্তু এবং নানা রকম আল্পনা, নকশা আঁকা আছে। খ্রিস্টিয় নানা রূপক-সংকেতের চিত্রায়ণ এই বই। ১৯৫৩ সাল থেকে চারখণ্ডের এই বইটি ডাবলিনের ত্রিনিতি কলেজ লাইব্রেরিতে প্রদর্শিত হয়ে আসছে, তবে একসঙ্গে দুখণ্ডের বেশি প্রদর্শন করা হয় না।

স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে প্রাচীন বইটির নাম ‘কেলটিক সল্টার’। লাল, সবুজ, বেগুনি, সোনালী কারুকাজ করা ১১ শতকের এই বইটিও একটি উপাসনা পুস্তক। ছোট্ট পকেট সাইজের এই বইটি আসলে ল্যাটিন ভাষায় রচিত কিছু স্ত্রোত। এগুলো আজও পাঠ উপোযোগী। বইটির আদি বাঁধাই এখন আর নেই। ধারণা করা হয়, স্কটল্যান্ডের রানী মার্গারেটের জন্য এই বইটি তৈরি করা হয়েছিলো। বর্তমানে এটি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে। ৮৪০ খ্রিস্টাব্দে রচিত ইহুদিদের প্রাচীন প্রার্থনার বই ‘সিডোয়ার’ আবিষ্কৃত হয়েছে ২০১২ সালে। পশুর চামড়ার তৈরি কাগজে (পার্চমেন্ট) মূদ্রিত এই বইয়ের ভাষা প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইংরেজির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। সিডোয়ার শব্দের অর্থ অর্ডার, বাংলায় বলা যায় আদেশ, রীতি, শৃঙ্খলা, ক্রম ইত্যাদি। এটি আসলে ইহুদিদের প্রতিদিনের প্রার্থনা গ্রন্থ। প্রাচীন ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তোওরাত (আসমানী কিতাব)-এর কিছু অংশও এতে আছে। সন্ত ডানস্টন ছিলেন ইংল্যান্ডের গ্লাসটোনবেরি এবি’র মঠাধ্যক্ষ। তিনি ধর্মযাজকদের পাঠদানের জন্যে ল্যাটিন ভাষায় এই পুস্তক লিখেছিলেন। দশ শতকের সূচনা লগ্নে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের জন্যেই ‘সেন্ট ডানসন্টনের ক্লাসবুক’ রচিত। ধারণা করা হয় এটি ৯৪৩-৯৫৭ সালের দিকে রচিত। এই বইয়ের অন্যতম আকর্ষণ সেন্ট ডাস্টনের একটি প্রতিকৃতি। ছবিতে দেখা যায় সেন্ট ডানস্টন স্বয়ং যিশুর পায়ের কাছে নত হয়ে বসে আছেন। সেন্ট ডানস্টন নিজেই এই ছবিটি এঁকেছেন। হাতে আঁকা ও লেখা এই বই গ্লাসটোনবেরি এবি’র মঠেই সংরক্ষিত ছিলো। ১৬০১ সালে এটি অক্সফোর্ডের বদলেইয়ান লাইব্রেরিতে স্থানান্তরিত হয়।

অক্সফোর্ডের বদলেইয়ান লাইব্রেরিতে রাখা সবচেয়ে প্রাচীন বই হলো ‘বেনেডিক্টাইল রুল’। ধারণা করা হয় ৭০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এটি রচিত। সেন্ট বেনেডিক্ট মধ্যযুগের ইংল্যান্ডের অন্যতম ধর্মগুরু। পাশ্চাত্য মঠকেন্দ্রিক সংস্কৃতির বিকাশে তার ভূমিকা অন্যতম। এই বইতে মূলত সন্ত বেনেডিক্টের অনুসারীদের মঠের জীবন, তাদের জীবনাচার, ধর্মচর্চা ইত্যাদি প্রসঙ্গ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। গরুর বাছুরের চামড়ায় খোদিত এটিই বেনেডিক্টের সবচেয়ে প্রাচীন রীতির গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত।প্রাচীন আরেকটি বই ‘সেন্ট কাথবার গসপেল’। এই বইয়ের আবিষ্কারের কাহিনি রীতিমতো রোমাঞ্চকর গল্প হতে পারে। ৬৯৮ খিস্টাব্দে দক্ষিণ পশ্চিম ইংল্যান্ডের লি-সফার্নে দ্বীপে ধর্মগুরু সেন্ট কাথবারের কফিনের সঙ্গে কবর দেয়া হয় তার প্রিয় গসপেল গ্রন্থটিও। ৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ভাইকিং জলদস্যুদের হাতে ডারহাম ক্যাথিড্রালে হামলা হয় এবং কফিনসহ বইটি ছিনতাই হয়। পরবর্তীতে ১১০৪ সালে কফিন উন্মোচিত হলে বইটি আবার খুঁজে পাওয়া যায়। এই সময় ডারহ্যাম ক্যাথিড্রালে অন্যান্য দর্শনীয় বস্তুর সঙ্গে এটি সংরক্ষণ করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ কেউ বেড়াতে এলে তার গলায় একটি চামড়ার ব্যাগসহ বইটি ধারণ করার সুযোগ পেতেন। অস্টম হেনরির রাজত্বকালে ১৫৩৬ থেকে ১৫৪১ নাগাদ মঠের গুরুত্ব ও প্রভাব কমতে থাকে। এ সময় বইটি সংগ্রাহকদের কাছে চলে যায়। এরও কয়েকশ বছর পর ১৯৭৯ সালে ব্রিটিশ লাইব্রেরি প্রদর্শনের জন্যে এটি ধার হিসেবে পায়। অবশেষে ২০১২ সালে একটি তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে ৯০ লাখ পাউন্ড দিয়ে ব্রিটেশ লাইব্রেরি বইটি কিনে নেয়। ব্রিটিশ লাইব্রেরির বরাতে জানা যায় যে এটি ইউরোপীয় সবচেয়ে প্রাচীন পূর্ণাঙ্গ বাঁধাই করা বই। ১৩৮ পৃষ্ঠার পকেটে বহনযোগ্য ছোট্ট এই খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থটি ল্যাটিন ভাষায় রচিত। অতি প্রাচীন এই বই এখনও বেশ ঝকঝকে অবস্থায় সুরক্ষিত আছে। এর সুদৃশ্য চামড়ার বাঁধাই পাশ্চাত্য বই বাঁধাইয়ের প্রাচীনতম ও সুন্দরতম উদাহরণ হয়ে আছে। জনের গসপেল নিয়ে মূদ্রিত এই বইটি ব্রিটিশ লাইব্রেরির ট্রেজার্স গ্যালারিতে গেলে দেখা যাবে। সম্প্রতি বইটির একটি ডিজিটাল সংস্করণ করা হয়েছে।

মিশরীয় প্রাচীন পুঁথি ‘নাদ হামাদি’ আবিষ্কার নিয়েও একটি গল্প হতে পারে। ১৯৪৫ সালে দুজন মিশরীয় কৃষক কাজ করতে গিয়ে পাথরের খাঁজের আড়ালে একটা সিল করা পাত্রের ভেতরে ১৩টি পুঁথি পান। প্যাপিরাস কাগজে লেখা চামড়ায় বাঁধানো এই পুঁথিগুলো পাওয়া যায় মিশরের নাগ হামাদি শহরে। সেই থেকে এর নাম হয় নাগ হামাদি পুঁথি। কপটিক ভাষায় রচিত এই গ্রন্থেরও বিষয়বস্তু প্রাচীন ইহুদি ও খিস্ট্রিয় ধর্মচিন্তা। ধারণা করা হয় চতুর্থ শতকের দিকে এই বইটি রচিত হয়েছে। এটি সম্ভবত কোন একটি গ্রিক বইয়ের অনুলিপি- পণ্ডিতদের এমন মতও আছে। মিশরের কায়রোতে কপটিক মিউজিয়ামে এই বইটি সুরক্ষিত আছে। ১৯৬৪ সালে এক খননকালে ইতালির পিয়ারগি থেকেও পাওয়া যায় তিনটি সোনার পাত। এই পাতগুলো ৫০০ খ্রিস্টাব্দের। তিনটি পাতের এক প্রান্তে ফুটো আছে। ধারণা করা হয়, এই ফুটোগুলোর মাধ্যমে পাত তিনটি একত্রে রাখা ছিলো। এই তিনটি পাতকে একত্রে ‘পিয়ারগি ট্যাবলেট’ বলা হয়। এর তিনটি পাতকে বইয়ের তিনটি পাতা মনে করা হয়ে থাকে। এর দুটো পাতের ভাষা প্রাচীন এত্রুস্কান এবং একটি পাতের ভাষা প্রাচীন ফিনেসিয়ান। এটিই বিশ্বের প্রথম দ্বিভাষিক গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। রোমের এত্রুস্কান জাতীয় যাদুঘরে এগুলো সংরক্ষিত আছে। ফিনেসীয় দেবী আসথারোতের প্রতি প্রাচীন কায়রোর রাজার নিবেদন হিসেবে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছে।

৬৬০ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘এত্রুস্কান’ স্বর্ণবইটিও আবিষ্কৃত হয় প্রায় ৭০ বছর আগে বুলগেরিয়ায় একটি খাল খননের সময়। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন একাধিক পৃষ্ঠার বই বলা হয়। ৬ পাতার এই বইটি ২৪ কেরেট সোনায় রচিত এবং একসাথে রিং দ্বারা বাধাই করা। আজ থেকে প্রায় তিনহাজার বছর আগে প্রাচীন এত্রুস্কান জাতি লিডিয়া থেকে অভিবাসন করে মধ্য ইতালিতে ছিলো। এদের আদিবাস ছিলো বর্তমান তুরস্কে। এত্রুস্কানদের নিজস্ব লিপির পাশাপাশি এই বইতে ঘোড়া, ঘোরসওয়ার, একটা সাইরেন, একটা বাঁশি ও সৈন্যের ছবিও আঁকা আছে। বর্তমানে বইটি বুলগেরিয়ার সোফিয়াতে জাতীয় ইতিহাস যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় রোমান জাতি ও ল্যাটিন ভাষার অবদান অনস্বীকার্য। ৬০০ খ্রিস্টাব্দে লেখা ‘লেইডেন হার্বারিয়া’ ল্যাটিন ভাষায় রচিত সবচেয়ে প্রাচীন বই। হার্ভ বা ভেষজ উদ্ভিদের উপর রচিত এই বইতে বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদের ওষুধি গুণাগুণ ও কার্যকারিতা লেখা হয়েছে। দক্ষিণ ইতালি কিংবা ফ্রান্সে রচিত হয়ে থাকতে পারে এই বইটি। বইটিতে বেশকিছু দর্শণীয় ছবিও সংযুক্ত হয়েছে। উদ্ভিদবিদ্যার প্রাচীনতম এই বই ল্যাটিনদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অগ্রগামিতার প্রমাণ দেয়। তবে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় শুধু যে পাশ্চাত্য সভ্যতা এগিয়ে ছিলো তা তো নয়। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে চৈনিক সভ্যতা অনেক বেশি অগ্রগামী ছিলো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাশ্চাত্যের ছাপাখানা আবিষ্কার কাগজ-কালির আবিষ্কারের বহু আগেই চীনারা এ সব আবিষ্কার করে ফেলেছিল। পাশ্চাত্য থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণেই চৈনিক সভ্যতার কথা আমরা অনেক পরে জেনেছি। চীনের প্রাচীনতম এক মূদ্রিত পুস্তক হলো ‘হীকসূত্র’। পূর্ব এশিয়ার জেন বৌদ্ধ চর্চাকারীদের মহাযান ধারার জ্ঞানগ্রন্থ বজ্রসূত্র বা ‘হীরকসূত্র’ বা ডায়মণ্ডসূত্র আসলে প্রজ্ঞাপারমিতা বা জ্ঞানের পরিপূর্ণতার এক পুঁথি। সহস্র বছরের পুরনো এই বইটি এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত মূদ্রিত আকারের সবচেয়ে প্রাচীন পূঁথি। ব্রিটিশ লাইব্রেরি সংরক্ষিত এই পুঁথিটি সচিত্র। হীরা বা বজ্র যেমন সবকিছু কেটে ফেলতে পারে জ্ঞানও তেমনি সকল মায়া কেটে বাস্তবের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়-এ ধারণাটিকেই প্রতিকীভাবে বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে। এই বইটি শুধু চীনে নয়, এশিয়ার নানা দেশেই প্রচলিত ছিলো। প্রাচীনকালেই সংস্কৃত, জাপানী, কোরিয়ান, মঙ্গোলীয়, ভিয়েতনামী ও তিব্বতি ভাষায়ও এর অনুবাদ হয়েছিলো। বৌদ্ধদের এই পবিত্র গ্রন্থটি বিংশ শতকে এসে চীনের এক গুহায় পাওয়া যায়। বইটি একটা স্ক্রলে ধূসর রঙের কাগজের উপর ছাপা, একটা কাঠের ঠ্যাঙ্গার উপর বসানো। ওয়াং জাই নামের এক ব্যক্তি প্রাচীন এই পবিত্র গ্রন্থটি ৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে অনুলিপি করেছিলেন।

জার্মানির মাইনজের ব্যক্তি জোহানেস গুটেনবার্গ বইয়ের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম। তিনি ছাপাখানার আবিষ্কারক। মানব সভ্যতা ও জ্ঞান বিকাশের ইতিহাসে ছাপাখানা বা মূদ্রণযন্ত্রের ভূমিকা অপরিসীম। গুটেনবার্গের ছাপাখানার কল্যাণে একইসঙ্গে বহু বই ছাপা হতে লাগল। এর আগে বই বা পুঁথি ছাপা ছিলো বেশ জটিল কর্ম। প্রতিটি বইয়ের প্রতিটি অক্ষর হাতে লেখা সত্যিই সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টসাধ্য ছিলো। বই তৈরি ছিলো ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘতর একটি প্রক্রিয়া। গুটেনবার্গ মূদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করে পুরো ব্যাপারটিকে সহজ ও সুলভ করে দিলেন। গুটেনবার্গ তার ছাপাখানায় নিজে যে বইটি প্রথম ছাপেন সেটি ছিলো বাইবেল। গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকডর্সের তথ্যমতে এটি হলো ছাপার যন্ত্রের সবচেয়ে প্রাচীন বই। প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরেরও পুরনো এই বইটি ছাপা হয়েছিলো আনুমানিক ১৪৫৪-১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে। ছাপার অক্ষরে মূদ্রিত এই বইটিকে যান্ত্রিকভাবে ছাপা হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বই হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও, উল্লেখ করা দরকার, প্রাচ্যে তার আগে থেকেই বই ছাপার ব্যবস্থা ছিলো। চীনারা গুটেনবার্গেরও বহু আগেই ছাপাখানার আবিষ্কার করেছে। চীনের হীরকসূত্র (ডায়মন্ড সূত্র) ছাপা হওয়ার বিবেচনায় গুটেনবার্গের বাইবেলের চেয়ে পুরনো। যাহোক, গুটেনবার্গের হাতে ছাপা হওয়া ৫০টি বাইবেল আজও পাওয়া যায়। যার মধ্যে ২১টি পূর্ণাঙ্গভাবে রক্ষিত হয়েছে। এখানে বইয়ের শেষে চিত্রিত কপিটি নিউ ইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত। নিলাম বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন, এক কপি গুটেনবার্গ বাইবেলের দাম হতে পারে ১০ লাখ ডলার। নিউ ইয়র্কে মর্গান লাইব্রেরি মিউজিয়ামে গুটেনবার্গের ছাপা তিনটি বাইবেল সংরক্ষিত আছে। গুটেনবার্গের ছাপাখানা আর তার প্রথম ছাপা বই বাইবেল দিয়ে বিশ্বব্যাপী বইয়ের ব্যাপক বিস্তারের সূচনা হয়। আজ ডেস্কটপ পাবলিশিং-এর কল্যাণে বই ছাপা অনেক আয়েশসাধ্য হয়ে গেছে। কিন্তু প্রাচীনতম বইগুলোর কদর আজো অমলিন। এই সব প্রাচীন বই শুধু প্রকাশনা বা ছাপার ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত নয়, বরং জ্ঞানের নানা ধারার চর্চারও পরিচায়ক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ জুলাই ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়