ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায়ের ১৯তম বার্ষিকী

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২২, ৮ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায়ের ১৯তম বার্ষিকী

শাহ মতিন টিপু : বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায়ের ১৯তম বার্ষিকী বুধবার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর এই মামলায় ২০ আসামির ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল।

এই রায়ের মধ্য দিয়ে জাতি এক দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ লাভ করে। এই রায়ে বাঙালি জাতির কলঙ্কমোচন হয়েছে। এই ঐতিহাসিক রায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ভিত্তি স্থাপন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় প্রদানকারী ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল আজ প্রয়াত। কিন্তু ঐতিহাসিক রায় প্রদানের কারণে তিনি নিজেও ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

রায়ে তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর দুটি রেজিমেন্টের অল্প সংখ্যক জুনিয়র সেনা অফিসার/সদস্য ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেন ওই কতিপয় সেনা সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ/নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেনি তা বোধগম্য নয়। এ ঘটনা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।’
১৯৯৭ সালের ২১ এপ্রিল নিম্ন আদালতে প্রচলিত আইনে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। দীর্ঘ শুনানি, জেরা ও উভয় পক্ষের আইনজীবীদের সওয়াল জবাব শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারিক আদালত ১৫ জন অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তা  প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে কার্যকরের আদেশ দেন।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ এর মাধ্যমে এই বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।  ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খুলে যায় এই জঘন্যতম হত্যার বিচারের দ্বার। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিত করার জন্যে ‘দ্য ইনডেমনিটি (বাতিল) বিল’ ১৯৯৬ উত্থাপন করেন। জাতীয় সংসদে তা পাস হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ এতে স্বাক্ষর করেন।

সংসদ ও আদালত কর্তৃক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের কাজ শুরু হয়। রাষ্ট্রপতির (বঙ্গবন্ধুর) তৎকালীন আবাসিক একান্ত সহকারী এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর  ধানমণ্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি তদন্ত শেষ করে পুলিশ ২৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে।

স্বাধীনতার মাস মার্চের প্রথম দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে বিশেষ এজলাস গঠন করা হয়। বিচারক করা হয় কাজী গোলাম রসুলকে। ২৪ আসামির মধ্যে ৪ জন মারা যাওয়ায় ২০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার দায়রা জজ আদালতে বিচারকাজ শুরু হয় । দেড়শ কার্যদিবস শুনানি শেষে ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল । ব্যাংকক থেকে ফেরত্ আনা হয় খুনি বজলুল হুদাকে। এই রায়ের পর কারাবন্দী চার আসামি, মেজর (অব) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহমদ হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০০০ সালের ৩০ মার্চ ডেথ রেফারেন্স ও আপিল হাইকোর্টের শুনানির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

এরপর শুরু হয় বিচারপতিদের বিব্রতবোধের নামে ন্যাক্কারজনক সময়ক্ষেপণ। ১০ এপ্রিল থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত কয়েক দফা  বিচারপতিরা বিব্রত হবার পর ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিভক্ত রায় দেন। বিচারপতি মোহাম্মদ রুহুল আমিন ১০ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অপরদিকে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশ দেন।

১২ ফেব্রুয়ারি ২০০১ হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের আদালতে মামলার শুনানি শুরু হয় এবং ৩০ এপ্রিল চূড়ান্ত রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। কারাবন্দী চার আসামি একই বছর আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেন। এরপর দীর্ঘ সময় এ মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি।

২০০৭ সালের ১৩ মার্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ল্যান্সার এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার হলে ১৮ জুন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২৪ জুন তিনি আপিল করেন। প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট আপিল শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ওই বছরের ৫ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেন। টানা ২৯ কর্মদিবস শুনানির পর ১৯ নভেম্বর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন। এরপর আসামিদের করা রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।

অবশেষে এই রায় কার্যকর করা হয়। ১২ আসামির মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে। বাকিরা পলাতক এবং একজন মারা গেছেন।

রায় কার্যকর হওয়ার পর এক টেলিভিশন সাক্ষাতকারে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক গোলাম রসুল বলেছিলেন, ‘এখন থেকে আর কেউ এমন জঘন্যতম অপরাধ করার সাহস পাবে না।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ নভেম্বর ২০১৭/টিপু/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়