বদলে যাচ্ছে বেদে সম্প্রদায়ের জীবনধারা
খায়রুল বাশার আশিক : অস্থায়ী ঘর-বসতিতে থাকা একদল জনগোষ্ঠী, যারা আমাদের কাছে বেদে বা বাইদ্যা নামে পরিচিত। কবিরাজি আর ভেষজ ওষুধ বিক্রি করাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে নিজস্ব ভাবধারায় রচিত তাদের জীবন। আচরণে ও পেশায় ভিন্নতা থাকলেও বেদেরা এদেশেরই নাগরিক। সব ধরনের নাগরিক সুবিধা তাদের প্রাপ্য হলেও এখনো অমানবিক তাদের জীবন ব্যবস্থা।
সচেতনতা আর সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনে বেদেদের জীবনেও এসেছে ইতিবাচক আর্থ- সামাজিক কিছু পরিবর্তন। বেদে সম্প্রদায়ে আধুনিকতার ছোঁয়া তাদের জীবন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে। যাযাবর বৃত্তি পরিহার করে স্থায়ী বসতির চিন্তা এখন সকলের। স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য সচেতনতাও গড়ে উঠছে। তারাও এখন আধুনিক ওষুধ ব্যবহারে আগ্রহী। শিশুশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিসহ গাওয়ালি (ভ্রমণরত) বেদে সম্প্রদায়ের নানামুখী পরিবর্তন এখন দৃশ্যমান।
বদলে যাচ্ছে বেদে সম্প্রদায়ের পেশাগত জীবন ও জীবিকা। বাংলাদেশে ক্রমেই কমছে বেদের সংখ্যা। সময়ের পরিবর্তনে কেউ কেউ অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বদলেছেন। এমনকি অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনও করেছেন অনেকে। ফলে বদলে গেছে জীবনধারা। বেদেরা সাধারণত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে গ্রামেগঞ্জে পরিভ্রমণ করেন। এই পরিভ্রমণকে তাদের ভাষায় ‘গাওয়াল’ বলে। গাওয়ালে বের হলে তারা নৌকা ব্যবহার করত। নদীনির্ভর বাংলাদেশে বেদেদের বাহন ছিল নৌকা। নৌকায় সংসার আবার দেশ-দেশান্তরে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছিল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। এখন বেদেরা গাওয়ালে বের হলে নৌকার ব্যবহার অতোটা করেন না। বাসের ছাদে প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য মালামাল তুলে দিয়ে তারা চলে আসে দূর-দূরান্তে। কিংবা বহরের সবাই মিলে মাহিন্দ্রা বা মিনি ট্রাক ভাড়া করে চলে যায় গন্তব্যে।
কবিরাজি আর ভেষজ ওষুধ বিক্রয় ছিল বেদেদের সার্বজনীন পেশা। বাত ও দাঁতের ব্যথার চিকিৎসা, শিশু চিকিৎসা, মালিশ প্রভৃতিতে বেদেরা অভিজ্ঞ বলে বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। বেদেরা নানা রকমের বুনো শেকড়-বাকড়, লতাপাতা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে। বর্তমানে বেদে চিকিৎসা গ্রহণে আধুনিক সমাজ অনাগ্রহী। বেদে চিকিৎসা এখন আর লাভজনক না হওয়ায় বেদেরা বাধ্য হয়েই পেশা পরিবর্তন করছে। অস্থায়ী একাধিক বেদে পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, বেদেদের ব্যবসায়িক পরিবেশ আস্তে আস্তে মন্দা হয়ে আসছে। তাই তারা গাওয়াল জীবন ছেড়ে অন্য কিছু করার চেষ্টা করছে। সাপ কিংবা বাদরের খেলা দেখানো, দৈহিক কসরত প্রদর্শন করে যে সব বেদেরা জীবিকা নির্বাহ করত, তারাও এখন শিল্পভিত্তিক কাজ ও ব্যবসায়ের প্রতি আগ্রহী।
শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারেও তারা আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বেদে পল্লীতে ঘুরে আগের মতো আর খুব বেশি শিশু চোখে পরে না। তারা গাওয়ালে শিশুদের সঙ্গে নেয় না। দাদি-চাচি বা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির কাছে শিশুদের রেখে অধিকাংশ নারী সদস্যারা গাওয়ালে আসেন। প্রযুক্তির ছোঁয়াও লেগেছে বেদে জীবন। এক সময় বেদেপল্লী ঘুরলে দেখা যেত কুপির আলো ছিল একমাত্র ভরসা। এখনকার বেদেপল্লী আলোকিত হচ্ছে সোলার প্লান্টে। সৌর বিদ্যুৎয়ের ব্যবহার, মোবাইল ফোন, খোলা পতিত জমিতে খুপরি ঘরেও ব্যাটারি দিয়ে সাউন্ড বক্সে গান শোনা এখন এগুলো চোখে পড়ে।
বেদেদের জীবনে এই পরিবর্তনে আনন্দিত তারা। বরিশাল কর্নকাঠি বেদেপল্লীতে কথা হয় কানুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে বাতাস আইলে কুপির আগুন নিভা যাইতো, আর ডেরায় আগুন লাগার ডর থাকতো। তয় এখন সোলার ব্যবহারে এই ডর থেইক্যা মুক্তি পাইছি। তাছাড়া মোবাইল চার্জ, ফ্যান চালানোসহ সবকিছু এহন সোলার দিয়াই চালাই, তাই একটু শান্তিতে আছি।’
বেদেজীবন ব্যবস্থার এমন পরিবর্তনকে স্বাগত জানায় সুশীল সমাজ। তবে সমাজবিজ্ঞান বিশ্লেষকরা বলছেন, বংশীয় কাজের ধারার প্রতি মানসিক যে টান থাকে তা পেশা পরিবর্তন হলে থাকে না। কাজের অভাবে ও মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করা মানেই জীবন ব্যবস্থার উন্নতি নয়। অন্য পেশা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বেদেরা জড়িয়ে যাচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশায়। সূত্র বলছে, এই অনগ্রসর জনগোষ্ঠিকে এগিয়ে নিতে কোনো প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু নেই। সরেজমিনে দেখা যায় শত পরিবর্তন সাধিত হলেও তাদের জীবন এখনও অমানবিক। বেদেরা আমাদের সমাজে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। নেই তাদের মৌলিক-মানবিক অধিকার পূরণের ব্যবস্থা। সরকার এবং সচেতন মহলের সুদৃষ্টি আর মানবিকতা বোধ অবসান ঘটাতে পারে বেদেদের অমানবিক জীবনের।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ ডিসেম্বর ২০১৮/ফিরোজ/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন