ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

উপকূলের পথে

বর্গা চাষীর ধুঁকে চলা জীবন

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ৬ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বর্গা চাষীর ধুঁকে চলা জীবন

রফিকুল ইসলাম মন্টু: নামের সঙ্গে কীভাবে যে ‘বেপারী’ শব্দটা যুক্ত হয়ে গিয়েছিল, তা জানেন না বেলাল বেপারী। বাপদাদার আমল থেকে খাজনার দাখিলা, জাতীয় পরিচয়পত্র, চেয়ারম্যানের সনদ- সবখানেই এই শব্দটি ছিল। এখনও কথা বলার সময় বেলাল নামের সঙ্গে জুড়ে দেন এই শব্দটি। কিন্তু বাপ কিংবা দাদাকে কখনোই বেপারীগিরি করতে দেখেননি। ছোটবেলা থেকে বাবা শামসুল হককে দেখেছেন বর্গা জমি আবাদ করতে; নিজেও জীবনের এই পর্যন্ত সময়ে একই কাজ করছেন। পরের প্রজন্ম কী করবেন, তা এখনও জানা নেই বেলালের।

মেঘাচ্ছন্ন এক বিকেলে বেলাল বেপারীর সঙ্গে দেখা হয় চাঁদপুরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাইমচরের প্রাণকেন্দ্র সাহেবগঞ্জ বাজারসংলগ্ন মাটির কিল্লার ওপরে। বয়স হয়তো ৪০ ছুঁয়েছে; কিন্তু দেখে মনে হয় আরও বেশি। পরিশ্রমী কাজের চাপে, জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার দুশ্চিন্তায় ভেঙে গেছে শরীর। মাটির কিল্লায় ছবি তুলতে দেখে এগিয়ে এলেন। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে; কোন কথা নেই। আমি তাকাই তার দিকে। সাদা রঙ্গের স্যান্ডো গেঞ্জি পরার কারণে তার পোড়া শরীরটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার দিকে ক্যামেরা তাক করে পোর্টেট তুলি। ক্যামেরার স্ক্রীনে তার ছবিটি দেখতে দেখতে কথা বলতে থাকি। আকাশের সঙ্গে বেলালের মনটাও যেন খারাপ। টানা তিন দিন মালিকের জমিতে নিড়ানি দিলেও মজুরির পুরোটাই বকেয়ার খাতায়।

পেশায় বর্গা চাষী। বাড়ি গোলদার পাড়ায়। অতিকষ্টে নদীতীরে পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। তর্জনী উঁচিয়ে বাড়ি দেখিয়ে তিনি বলেন, এই গ্রামের পরের গ্রামে মেঘনা নদীর কিনারে বাড়ি। যেতে হয় মাঠের ভেতর দিয়ে। মাটির কিল্লার পাশের মাঠে মানুষের চলাচলে তৈরি হওয়া পথ ধরে হাঁটি। বেলাল সামনে, আমি পেছনে। আশপাশে চোখে পড়ে মরিচ ক্ষেত, পাট ক্ষেত, সয়াবিন ক্ষেত। বেলালের নদীতীরের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরোতে হলো কাদাপানি। রাস্তার পাশের বেলার ছোট্ট ঘরটি ভাঙনের খুবই কাছাকাছি।

গলায় ঝুলানো ক্যামেরা, পিঠে ব্যাগ, নোটখাতা, অচেনা মানুষ- এমন দেখে বেলালের ঘরের সামনের উঁচু স্থানটিতে নারী-পুরুষ এবং শিশুদের ভিড় জমে গেল। সাংবাদিকের পরিচয় পেয়ে সবার কথা যেন ফুরোতে চাইছিল না। আমি তাদের কাছে প্রশ্ন করে জানি নানান তথ্য। পুরনো হাইমচরের তাসকারকান্দিতে ছিল বেলালের বাপদাদার বাড়ি। জমিজমাও ছিল বেশ। কিন্তু সেসব জমি অনেক আগেই হারিয়ে গেছে মেঘনার অতলে। বাবার সঙ্গে প্রায় ২৩ বছর আগে কিশোর বেলাল নতুন হাইমচরে এসেছিলেন। এখানে এসে ঠাঁই হয়েছে আরেক কান্দি; গোলদার কান্দিতে।

সারাদিন বৃষ্টি হয়ে রাস্তাঘাট কাদায় ভরে আছে। এখনও আকাশে জমে আছে মেঘ। বাড়ির উঠোনেও ভেজা মাটি। বেলালের ঘর থেকে ভেসে এলো অসুস্থ মানুষের কোঁকানোর শব্দ। খানিক পরে কাঁশতে কাঁশতে ঘরের ভেতর বেরিয়ে এলেন বেলালের অসুস্থ বাবা শামসুল হক বেপারী। তিনিও কিছু কথা বলতে চান। কথা বলতে তার কষ্ট হচ্ছে। তার কথাগুলো আসলে বেলাল এবং অন্যান্যরাই বলতে পারছেন। আমি তাকে থামাই। শামসুল হক জানাতে চাইলেন, এক সময় তাদের সব ছিল। এখন কিছুই নেই। অন্যের জমিতে থাকেন। জমি বর্গা আর গরু বর্গা নিয়ে জীবন চলে। তারা খুবই কষ্টে আছেন। আবার আলাপ শুরু করি বেলালের সঙ্গে। বাড়ি আসতে আসতে অনেক কথাই তার সাথে হয়েছে। তবুও নোট নেওয়া জন্য আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বেলালের চার ছেলেমেয়ে। সংসারের আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে অতি আদরের মেয়ে বিলকিস মায়া (১৬) বছর দু’য়েক হলো ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি করে। বেতন ৬ হাজার টাকা। ঢাকায় থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য খরচে তার ৫ হাজার টাকা চলে যায়। বাকি এক হাজার টাকা বাবাকে পাঠায়। ছেলে হানিফের বয়স হয়েছে ১৩ বছর। লেখাপড়া করাতে পারেননি; অন্যের ক্ষেতে কাজ করে। ১১ বছরের ছেলে খোরশেদ আর ১০ বছরের সোহেল এখনও স্কুলে যায়; জানালেন বেলাল। নিজের জমি কখনোই আবাদ করতে পারেননি বেলাল বেপারী। ছোটবেলায় অন্যের ক্ষেতে কাজ করেছেন। বড় হয়ে নিজে হয়েছেন বর্গা চাষী। সামান্য জমি বর্গা নিয়ে এবার আবাদ করেন মরিচ ও সয়াবিন। একইসঙ্গে অন্য বর্গা চাষীর মতো গরুও বর্গা নিয়েছেন বেলাল। জমি চাষাবাদে বর্গা চাষী পান তিন ভাগের এক ভাগ। ফসল মার খাওয়া থেকে অন্যান্য সকল ঝুঁকি চাষীর। একইভাবে গরু বর্গার ক্ষেত্রে মালিক তার আসল বুঝে নেওয়ার পর যা থাকবে, সেটার অর্ধেক মালিকের বাকি অর্ধেক বর্গা চাষীর। শুধু হাইমচর নয়, উপকূলের সর্বত্রই জমি এবং গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল বর্গা নেওয়ার প্রথা চালু রয়েছে। তবে জমি বর্গা নিয়ে চাষীরা ভালো নেই। জমিতে যে ফসল হয়, তা থেকে মালিককে দেওয়ার পর যা থাকে, তাকে সংসার চলে না; বলছিলেন বেলাল বেপারী।



বর্গা জমি চাষ, বর্গা ৩টি গরু লালন পালন এবং গার্মেন্টস-এ চাকরিরত মেয়ে বিলকিস মায়ার দেয়া এক হাজার টাকা পাওয়ার পরও বেলালের সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হয়। সে কারণে তিনি অন্যের জমিতে কাজ করেন। বর্গা নেওয়া জমিতে কাজ না থাকলে বেলাল হয়ে যান অন্যের জমির কৃষি মজুর। দৈনিক মজুরি ২০০ টাকা; কিন্তু কাজ মিলে মাসে ১০-১৫দিন। তাও আবার মজুরির টাকা পাওয়া যায় না ঠিকঠাক। ১৫ দিনের চুক্তিতে দুদুমিয়া পাজালের মরিচ ক্ষেতে নিড়ানির কাজে যোগ দিয়েছেন। দৈনিক টাকা শোধ করার কথা; কিন্তু কাজের তিনদিন পার হলেও এক টাকাও দেয়নি বেলালের হাতে। বেলাল বলেন, এভাবেই মালিকেরা কৃষি মজুরদের মজুরির টাকা দিতে বেশ দেরি করে। কাজ করে খাই; কিন্তু সময়মত মজুরি পাই না। কীভাবে চলি? এতক্ষণ বেলাল বেপারির কথার সূত্র ধরে কিছু কিছু বিষয় যোগ করে দিচ্ছিলেন পাশে বসা তার স্ত্রী খোরশেদা বেগম। তার সঙ্গে আলাপ করে জানি, স্বামীর সঙ্গে তিনিও ক্ষেতে-খামারে কাজ করেন। ক্ষেতে মরিচ তোলা, সয়াবিন তোলা, গরুকে খাবার দেয়া, খাস কাটা, গরু ঘরে তোলা- এসব কাজ পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও করতে হয়। হাইমচর ঘরে এমন দৃশ্য অনেকবার চোখে পড়েছে। যেমন বেলাল বেপারির বাড়িতে আসার পথে চোখে পড়লো পাট ক্ষেতের ভেতর দিয়ে দুই নারী গরু নিয়ে যাচ্ছেন ঘাসের মাঠে। বাইরের এই কাজগুলোর করার পরেও নারীদের করতে হয় ঘরের রান্নাবান্না, সন্তান পালনপালন, ঘরদোর গোছানো, ঝাড়ু দেওয়াসহ অন্যান্য কাজ।

একে তো সব হারানো মানুষ, তার উপর নতুন হাইমচরে এসেও বেলাল বেপারিকে চারবার বাড়ি বদল করতে হয়েছে। বাড়ি ভেঙে যাওয়ার আগেই নতুন স্থানের সন্ধান করতে হয়। কারও পরিত্যক্ত জমি চেয়ে নিয়ে ছোট্ট ঝুপড়ি বানিয়ে সেখানে ক’দিন থাকেন। নদী কাছে চলে এলে আবার অন্যত্র ঠাঁই। এভাবেই চলছে বেলালসহ সকলের জীবন। নিয়তি যেন এই মানুষদের এভাবেই তাড়িয়ে ফেরে। বেলাল বেপারীর সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে এসে বসেছিলেন আমজাদ হোসেন। ৪ ছেলেমেয়ের বাবা। তার দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আর এক ছেলে আর এক মেয়ে পড়াশোনা করে। বেলালের অবস্থা থেকে আমজাদের অবস্থার খুব বেশি তফাত নেই। আমজাদও বর্গা চাষী। বর্গা চাষের পাশাপাশি সামান্য ব্যবসা বাণিজ্য আছে বলে অবস্থা বেলালের চেয়ে কিছুটা ভালো। তবে ঋণ করে চলা, দেনা শোধ করতে না পারা, ঘরে বিপন্নতায় বসবাস- এগুলো বেলালের মতই। গোলদার কান্দির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, এখানকার নদীভাঙন কবলিত মানুষেরা দলবদ্ধভাবে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যায়। ২/৩ পরিবার মিলে একসঙ্গে অন্যত্র জমি কিনে বসতি গড়ে। বেলাল, আমজাদসহ তিন পরিবার ভাঙনের তীর থেকে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। হাইমচরের বাঘা সরদার বাজারের পাশে সামান্য জমি কিনেছেন ৩০ হাজার টাকায়। সবাই মিলে এ টাকা দিয়েছেন। মাটি ভরাট করা হয়েছে বাড়ি করার জন্য। গোলদার কান্দির আরও কিছু পরিবার সেখানে যাচ্ছে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। মেঘের আড়ালে গোধূলির আলোটুকু আরো আগেই ম্লান হতে চলেছে। মানুষজন ঘরে ফিরছে; ঘরে তুলছে বর্গা নেওয়া গরু-ছাগল। গাছে গাছে পাখিদের বাসায় কিচিরমিচির শব্দের মাঝেই কানে আসে মেঘনায় জাহাজ চলার শব্দ। গোধূলি আলোর আবছা আলো পর্যন্ত কাজ করার পরও অবশিষ্ট থেকে যায় কিছু বর্গা চাষির ক্ষেত নিড়ানির কাজ। আমি বেলাল বেপারির ভিটে থেকে উঠে সাহেবগঞ্জ বাজারের পথ ধরি।  




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়