ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জির জনক আ জ ম তকীয়ূল্লাহ

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৬, ১০ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জির জনক আ জ ম তকীয়ূল্লাহ

আ জ ম তকীয়ূল্লাহ

শান্তা মারিয়া : অনেকেই জানেন এখন যে সরকারি বাংলা বর্ষপঞ্জি বাংলাদেশে চালু রয়েছে তা খুবই সহজ। এতে খ্রিস্টীয় সন ও বঙ্গাব্দের মাসগুলোর তারিখ সব সময়ের জন্য স্থির রয়েছে। ফলে প্রতিবছরই ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হবে। একইভাবে অন্যান্য মাসের তারিখও স্থির থাকছে। কিন্তু অনেকেই জানেন না, এই বর্ষপঞ্জির মূল প্রণেতার নাম। বাংলা বর্ষপঞ্জির এই সংস্কার যিনি করেছেন তাঁর নাম আ জ ম তকীয়ূল্লাহ। ‘কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ’ নামে তিনি সমধিক পরিচিত।

এই গুণী মানুষটি দীর্ঘ বিশ বছর গবেষণার পর বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করেন। জীবদ্দশায় তিনি এজন্য কোনো খ্যাতি বা পুরস্কার পাননি। তবে চলতি বছর (২০১৮) বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেছে।

১৯৯৬ সাল থেকে এই বর্ষপঞ্জি বাংলাদেশে চলছে। প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রচলনের নেপথ্য ইতিহাস। আবহমান কাল থেকেই বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণসহ বারো মাস বাঙালির একান্ত নিজস্ব ছিল। বাংলাসহ ভারতীয় ভূখণ্ডে শকাব্দ, লক্ষণাব্দ ইত্যাদি যে বর্ষপঞ্জি প্রচলিত ছিল তাতে এই মাসগুলোই ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সনগুলো ছিল চান্দ্র-সৌর মিশ্র সন। এর মানে হলো মাস গণনা করা হতো চান্দ্র পদ্ধতিতে, আর বছর গণনা করা হতো সৌর পদ্ধতিতে। ব্যাকরণ অনুযায়ী অগ্রহায়ণ মানে অগ্র+ হায়ণ (বৎসর)। অর্থাৎ বছরের প্রথম। অগ্রহায়ণ মাসে সে সময় নতুন ফসলও উঠতো। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে প্রাচীন বাংলায় হয়তো বছরের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ।

চান্দ্র মাস আর সৌর বৎসরের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য তিনবছর পরপর একটি অতিরিক্ত চান্দ্র মাস গণনার রীতি ছিল। এই অতিরিক্ত মাসটিকে বলা হতো মল মাস। মল মাসে পূজাপার্বণ নিষিদ্ধ ছিল। এদিকে ১২০১ সালে বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের পর বিভিন্ন অঞ্চলে হিজরি সনের প্রচলন শুরু হয়। বিশেষ করে দরবারের কাজকর্মে। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ ‘সুবাবাংলা’ নামে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। সে-সময় সুবাতে খাজনা আদায়ের জন্য একটা সমন্বিত বর্ষপঞ্জির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে।

সম্রাট আকবরের নির্দেশে আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি মল মাস বাদ দিয়ে সৌরবর্ষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করেন। মূলত হিজরি সনকে ফসলী সনে রূপান্তরিত করা হয়। তবে মাসের নামের ক্ষেত্রে বাংলা নামগুলোই রাখা হয়। সে-সময় থেকে বৈশাখকে প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা হয়। বাংলা সনের জন্ম ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে একথা মোটামুটিভাবে অধিকাংশ পঞ্জিকা বিশারদ মেনে নিয়েছেন।

ইংরেজ আমলে শহরে সরকারি কাজকর্ম চলতো গ্র্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। কিন্তু বাংলার গ্রামে গঞ্জে জমিদারের খাজনা, পুণ্যাহ, হালখাতা ইত্যাদি চলতো বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। বাংলা মাস কখনো ৩০, ৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হতো। কালের বিবর্তনে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে বেশ কিছু জটিলতা ও সমস্যা দেখা দিতে থাকে। পঞ্জিকা প্রণেতা ও জ্যোতির্বিদদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বাংলা বর্ষপঞ্জি। কবে কোন মাস শুরু হবে, কবে কোন বছর শুরু হবে তা আগে থেকে বলার উপায় হয়ে পড়ে অত্যন্ত জটিল। বাংলা ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করাও প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ফলে বাংলা ক্যালেন্ডার মূলত পঞ্জিকা প্রণেতাদের কুক্ষিগত হয়ে যায়।

এই অবস্থায় ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি প্রখ্যাত জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে সুদক্ষ ও খ্যাতনামা পণ্ডিত ও জ্যোতির্বিদদের সমন্বয়ে একটি বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার উপ-সংঘ গঠন করে। এই উপ-সংঘের সদস্য ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম, পণ্ডিত তারাপদ ভট্টাচার্য কাব্য-ব্যাকরণ-পুরাণ স্মৃতিতীর্থ ভাগবতশাস্ত্রী, সাহিত্যোপাধ্যায় স্মৃতি-পুরাণরত্ন জ্যোতিঃশাস্ত্রী; পণ্ডিত অবিনাশচন্দ্র কাব্য জ্যোতিস্তীর্থ, পণ্ডিত সতীশচন্দ্র শিরোমণি জ্যোর্তিভূষণ এবং বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক সৈয়দ আলী আহসান। ১৯৬৬ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি কমিটি চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। অধ্যক্ষ এম এ হামিদ এই সভায় নিয়মিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন।

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়। স্বাধীন দেশে নতুনভাবে বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয়বাহী বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রয়োজন অনুভূত হয়। বাংলা একাডেমি শহীদুল্লাহ পঞ্জিকা চালু করে। সে-সময় থেকে (১৯৭২) মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ বাংলা একাডেমি প্রচলিত বর্ষপঞ্জি সংস্কারের জন্য গবেষণা শুরু করেন। কারণ শহীদুল্লাহ কমিটি প্রণীত বর্ষপঞ্জিতে কিছু কিছু দুর্বল দিক ছিল। আর চিরাচরিত বাংলা পঞ্জিকার সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল যে এর লিপ ইয়ার গণনার পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট ছিল না এবং বর্ষ গণনায় বর্ষ মানের পরিমাপের সঙ্গে লিপ ইয়ার গণনা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। চারশ বছর পরে পহেলা বৈশাখ তিনদিন সরে যাওয়ার আশঙ্কাও ছিল। ১৯৮৮-৮৯ সালে ১৩৯৫ বঙ্গাব্দে বাংলাদেশে একটি সমন্বিত বিজ্ঞানসম্মত বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের কথা মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ও অন্যান্য লেখকরা বিভিন্ন পত্রিকায় লিখতে থাকেন। ফলে বিষয়টি বিবেচনার জন্য বাংলা একাডেমি একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। বাংলা একাডেমি তার এবং অন্যান্যদের দেওয়া প্রস্তাব বিবেচনা করে। পরে তকীয়ূল্লাহর প্রস্তাব গ্রহণ করে শহীদুল্লাহ কমিটির লিপ ইয়ার সংক্রান্ত প্রস্তাবের সংস্কার করা হয়।

বাংলাদেশ সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুমোদন করে ১৯৯৬ সালে বঙ্গাব্দ ১৪০২-১৪০৩ বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করে। এর নাম দেওয়া হয় ‘শহীদুল্লাহ পঞ্জিকা’। কারণ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন এর প্রাথমিক সংস্কারক। মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর প্রস্তাব অনুযায়ী এখন যে সরকারি বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু রয়েছে তা খুবই সহজ। এতে খ্রিস্টীয় সন ও বঙ্গাব্দের মাসগুলোর তারিখ সব সময়ের জন্য স্থির রয়েছে। ফলে প্রতি বছরই ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হবে। একইভাবে অন্যান্য মাসের তারিখও স্থির থাকবে। এই ক্যালেন্ডারে ভবিষ্যতেও কোনো দিন পরিবর্তন হবে না। মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্যালেন্ডার তৈরি করেছেন এবং তা বাংলা একাডেমির বিশেষজ্ঞ কমিটিতে পেশ করে দেখিয়েছেন যে, এর কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। নতুন নিয়মে যে বাংলা পঞ্জিকা চলছে তা ঋতুনিষ্ঠ সায়ন (ট্রপিকাল) পঞ্জিকা।

এখানে মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ সম্পর্কে কিছু তথ্য না দিলেই নয়। আ জা ম তকীয়ূল্লাহর জন্ম ১৯২৬ সালের ৪ নভেম্বর। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। কিশোর বয়স থেকেই এদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সার্ভিস সিলেকশন পরীক্ষায় তিনি অংশ নেন এবং প্রথম বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত হন। অফিসার হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েও ভাষা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়ায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের যে চারটি মাত্র আলোকচিত্র পাওয়া যায় সেগুলো তারই তোলা। এই আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্য তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৯ সালে রাজনৈতিক কর্ম তৎপরতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং তার নামে হুলিয়া বের হওয়ায় আত্মগোপনে চলে যান। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেপ্তারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। সে সময় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি মূলত বিভিন্ন কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক ইউনিয়ন ও কর্মচারী ইউনিয়ন গড়ে তোলার কাজ করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ইউনিয়ন, জেল পুলিশ ইউনিয়ন, সচিবালয় কর্মচারী ইউনিয়ন গড়ে তোলায় তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আমাদের ভাষা ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রগতিশীল ছাত্র ও যুব সমাজকে সংগঠিত করার জন্য ১৯৫১ সালে যুবলীগ প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি তখন কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পুত্র।

মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ১৯৫১ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর রাজবন্দী হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য আবারও গ্রেপ্তার হন এবং কারাভোগ করেন। তিনি সারাজীবন সমাজ সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি বিভিন্ন গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭২ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি বর্ষপঞ্জি সংক্রান্ত উচ্চতর গবেষণায় ব্যাপৃত ছিলেন। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। এই প্রচারবিমুখ গবেষক, ভাষাসৈনিক ও সমাজকর্মী তার জীবদ্দশায় সরকারি বেসরকারি তেমন কোনো স্বীকৃতিই পাননি। বাংলা নববর্ষ পালনের সময় এর মূল প্রণেতার নামটিও হয়তো উচ্চারিত হয় না।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়