ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বর্ষভাবনা: বিগত ও আগামী নিয়ে || আহমদ রফিক

আহমদ রফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৭, ১ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বর্ষভাবনা: বিগত ও আগামী নিয়ে || আহমদ রফিক

শীতের রোদ গায়ে মেখে বাংলা পৌষের মাঝামাঝি জানুয়ারি অর্থাৎ খ্রিস্টীয় নতুন বছরও বাংলাদেশী মানুষের জীবনে এক বাস্তবতা। একেও আমরা স্বাগত জানাই। কারণ বৈশাখি নববর্ষ নিয়ে রমনার রাজপথে যত ঢাকঢোল বাজাই বা রঙ-বেরঙের মুখোশ পরে মিছিল করি না কেন আমাদের শহুরে জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন চলে খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ রেখে।

এ নববর্ষে রাজধানী-মহানগরে দেখা যায় নানা-রং ফুলের সমাহার। বিচিত্র রং ডালিয়া থেকে চন্দ্রমল্লিকার মতো ফুলের বর্ণময় সমারোহ সত্যি চোখের আরাম, মনের আরাম। বহুতল ভবনে ঠাসা হলেও মাথার ওপর নীল-সুশ্রী আকাশ মনে রোমান্টিক সৌন্দর্যের ভিন্ন এক আবেশ তৈরি করে। কবিতা তখন অকবির মনেও উঁকিঝুকি দেয়।

এই যে ইট-কাঠ-পাথরের কাঠখোট্টা পরিবেশেও শীতের নববর্ষ রূপময়-বর্ণময় পরিবেশ তৈরি করে এর উপভোগ্যতাই আলাদা। রোদের অগ্নিœদাহে ঘর্মাক্ত বৈশাখি নববর্ষের সঙ্গে এর আমেজ ও রূপময়তার অনেক তফাৎ। তাই আমি মাঝে মাঝে লিখি, আকবর বাদশাও নেই, তার রাজত্বের বাস্তবতাও নেই। আমরা তাহলে প্রাচীন অঘ্রানে (অগ্র+হায়ণ) শুরু নববর্ষে ফিরে যাই না কেন? মাসটা তো কৃষ্টি প্রকৃতি ও কৃষি সমাজের জন্যও আনন্দের। ওটা নবান্নের মাস। নতুন ধান ও নতুন গুড়ের কল্যাণে পিঠে-পায়েসের উপভোগ্য, সুগন্ধে সুস্বাদু সময়, তাতে অবশ্য অনেকের আপত্তি আকবরি ঐতিহ্যের কারণে।

দুই

পুরো একটি বছর অর্থাৎ বারোটি মাস পার হয়ে এলাম। নুতন বছরের দোরগোড়ায় পৌঁছে স্বভাবত, সবারই মনে হয়, কেমন গেল বছরটা? সেই সঙ্গে আশার ভাবনা, কেমন যাবে সামনের বছরটা? ভালো না মন্দ, না ভালোমন্দ মেশানো। নববর্ষের তত্ত্বকথা অবশ্য বলে: নতুন বছরে নতুন করে সময়ের গর্ভে জন্ম নিয়ে আমরা নতুন উপভোগ্যতায় বাঁচতে চাই। এটাই নববর্ষের দর্শনতত্ত্ব। সেখানে সুন্দরের প্রত্যাশাই বড় হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ের বাস্তবতা যেমনই হোক না কেন।

চলতি বছরের শেষ লগ্নে দু’একটি কাগজের সিঙ্গেল কলাম খবরে পড়ছিলাম হতাশার সালতামামি। অপহরণ, গুম, খুন বছরটার মুখে বেশ খানিক কালি মাখিয়ে দিয়ে গেল। যদিও অপহরণের বেশ কিছু দিন পর জনাকয়েক মানুষ ফিরে এলেন বিধ্বস্ত অবস্থায়। তাদের মুখ খুলতে বারণ। বাকি কারো কারো লাশ পাওয়া গেল দূরে ভিন্ন জায়গায়, যাতে অকুস্থল সহজে শনাক্ত না হয়।

কী করছে এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা ও নিরপত্তারক্ষাকারী বাহিনী? এখানেই শেষ নয়। কিশোরী, তরুণী বা গৃহবধূদের ওপর যৌন নির্যাতন, বখাটেপনা, কখনো ছুরিকাঘাতে হত্যা- এক কথায় নারী সমাজের ওপর হামলা বছরটার জন্য এক জঘন্য কালো অধ্যায়। ভাবা যায়, চলন্ত বাসে তরুণী রূপাকে গণধর্ষণের পর হত্যা? কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সমাজের কলঙ্ক ওই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে? শাস্তি পেয়েছে তারা?

কী হয়েছে বনানীর বিত্তবান পরিবারের বখে যাওয়া বিএমডব্লিউ গাড়িবিলাসী সন্তানের এবং তার দোস্তদের? যারা দুই ছাত্রীকে নৈশ-বিহারের লোভ দেখিয়ে তাদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। এদের এবং মূল অপরাধীর পরিবার প্রধানের উদ্ধত হুমকিও দৈনিক পত্রিকায় পড়েছি আমরা! ভেবে অবাক হই কী এক দূষিত সমাজে বাস করছি আমরা! ধীরে, বড় ধীরে চলছে এমন কোনো কোনো অপরাধের তদন্ত ও মামলা। এর শেষ পরিণতি কী হবে কে জানে।

তিন

সংবাদ ভুবনের ভিন্ন পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে রকমারি খেলা- জোট, মহাজোট, বাদ-প্রতিবাদ, হুমকি পাল্টা হুমকি, গ্রেফতার, মামলা, আদালত ইত্যাদি নিয়ে বিচিত্র ঘটনাবলি। এর মধ্যে আগামী নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক, বাকযুদ্ধ। একজন মেধাবী মেয়রের হঠাৎ প্রয়াণে কাগজে কলমে নানা মাত্রায় স্মরণ-প্রশস্তি বচন। আমরা যা চাই তা পাই না। আবার যা পাই তা হয়তো চাই না। ‘অবস্থিত’ বা ‘অনাকাক্সিক্ষত’ বলে একটা কথা আছে না? কবির উপলব্ধিতে হলেও তা বড় বাস্তব।

এমন অনেক অনেক ঘটনার জন্ম দিয়ে বিদায় নিতে চলেছে একটি খ্রিস্টীয় বছর। ‘পেছনে কী রেখে এলাম, কী দেখে এলাম’ সেসব নিয়ে সাধারণ মানুষের ভাবনা কম। তাদের ভাবনায় থাকে সামনের দিন, প্রত্যাশার সোনালি দিন। মানুষ তো ভবিষ্যত দিনগুলোকে সর্বদাই প্রত্যাশামাফিক দেখতে চায়, সমৃদ্ধ ভবিষ্যত দিনের সম্ভাবনা নিয়ে মানুষের দিনযাপন, বেঁচে থাকা। বাস্তবে তা ধরা দিক বা না দিক।

সাধারণ্যে, ভাবনা যেমনই হোক, মননশীলতার ভুবন ওই গতানুগতিকতার বাইরে চারিদিকের হিসাব-নিকাশ নিয়ে রেখাচিত্র টানতে চায়- হোক তা রাজনৈতিক, সামাজিক বা অথনৈতিক। বিচার-বিশ্লেষণ সেখানে প্রাধান্য পায়। তাই নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ যেমন তাদের চোখে প্রশংসনীয় উদ্যোগ, প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার যেমন তাদের প্রত্যাশিত, তেমনি রামপাল-সুন্দরবন নিয়ে তাদের অনেকের বিশেষ করে পরিবেশবাদীদের মনে যথেষ্ট ক্ষোভ, প্রতিবাদে যা প্রকাশ পায়।

শিল্পপতিদের একচেটিয়া রাজত্ব, চরম মুনাফাবাজী, প্রত্যাহিক দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া বিস্ফোরণ এবং সেই সূত্রে সিন্ডিকেট-মুনাফার অদম্য প্রতাপ সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের মনে গভীর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। চাল, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ নিয়ে বৃহৎ ব্যবসা, কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, নিয়ন্ত্রণের কোনো ইচ্ছাও নেই; আছে শুধু উদাসীনতা- এ অবস্থা কোনো নাগরিক মেনে নিতে পারে?

তবে গেল বছরটা, অর্থাৎ ২০১৭ একটা বড় লাল রেখা টেনে দিয়ে গেল। রাজনৈতিক-সামাজিক মননশীলতার একাংশে। অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন অপ্রত্যাশিতভাবেই নতুন মাত্রা পেয়ে গেল একাধিক শ্রেণীর রাজনৈতিক বৃত্তের মানুষের তৎপরতায়। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক ও নারী সংগঠন যেমন এগিয়ে এসেছে অনুষ্ঠান বিচিত্রায়, তেমনই তৎপরতায় শিক্ষক-লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী ও মননশীল ভুবনের বেশ কিছু সংখ্যক সদস্য আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন অবশেষে ৭ই নভেম্বরের বর্ণাঢ্য মিছিলে।

বলাবাহুল্য, দুর্নীতি ও দুবৃত্তপনাই সমাজজীবনের শেষ কথা হয়ে থাকেনি। বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, সর্বোপরি শিল্পকলা একাডেমি, এমনকি নাট্যমঞ্চ তাদের নান্দনিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে নিজ নিজ ধারায়। তবে শিল্পকলা একাডেমির অবস্থান এদিক থেকে অর্থাৎ শৈল্পিক বিচারে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে।

শাস্ত্রীয় সংগীতসহ সংগীতের নানামাত্রিক উপহার, নৃত্যগীতবাদ্যের আকর্ষণীয় তৎপরতা, কত্থক বা মণিপুরি- এমন সব বিচিত্র আয়োজনে শিল্পকলার হলঘরগুলো রাতভর শৈল্পিক মননকে তৃপ্তি দিয়েছে।

সেই সঙ্গে বিচিত্র ধারার মঞ্চনাটক, স্থানিক বা বৈশ্বিক ধারার প্রগতিবাদী কি মানবিকতাবাদী দর্শক শ্রোতার মনন-পরিতৃপ্তির কারণ হয়ে উঠেছে। শিল্পের নান্দনিক ভুবনটি সত্যিই ছিল প্রশংসনীয় মানের।

চার

রাজনৈতিক মহল কোনোদিনই সব মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করাতে পারেনি। পারার কথাও নয়। সঙ্গত বা অসঙ্গত যেমনই হোক তবে এবারের বর্ষ শেষের বড় আকর্ষণ নির্বাচন ভাবনা- বিশেষ করে বড় দুই দল এবং তৃতীয়সহ বিভিন্ন মতাদর্শের দলগুলোর। সবারই যেন ঘুম ভেঙে, জড়তা ভেঙে তৎপর হবার (ওয়ার্মিং) পর্ব। আর এর সূচনা ঘটলো রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। জাতীয় পার্টির জয়ের মধ্য দিয়ে এ পর্যায়ের তৎপরতার সূচনা, ঘর গোছানোর সূচনা।

বিদায়ী বছরের এমন একটি নানা রং চিত্র পেছনে রেখে আমরা তাকিয়ে আছি সামনের দিকে বর্ষ ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে। কেমন যাবে বছরটা? অবশ্য এ বছরের বড় আকর্ষণ হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। উত্তাপ, বিতর্ক, দলীয় তৎপরতার মধ্যে সবাই চাইবে শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন। কোনো প্রকার সন্ত্রাস বা সহিংসতা নয়। নয় কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা, রক্তঝরা ঘটনা।

তেমনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কাম্য রাজনৈতিক সুশাসন যা হবে সব কাজের কাজী। চাই রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পারিবারিক এমনকি ব্যক্তিক পর্যায়েও নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা। কোনো অঘটন নয়, কোনো দুর্ঘটনা নয়। বিশেষ করে বয়স নির্বিশেষে নরী সমাজের নিñিদ্র নিরাপত্তা। তারা যেন নিরাপদে সর্বত্র বিচরণ করতে পারেÑ বাসে, অটোতে, পার্কে বিনোদন ভ্রমণে সর্বত্র।

খুব কি বেশি চাওয়া হলো আগামী বছরের জন্য? ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত সহিংসতা বা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তো সুস্থ, যুক্তিবাদী ও মানবিক চেতনার কোনো মানুষেরই কাম্য নয়। মানুষ চায় শান্তি। ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক শান্তি। যেমন স্বদেশে, তেমনি বৈশ্বিক পরিসরে। ‘বিশ্ব শান্তি’ শব্দটি তাই আধুনিক কালের একটি বড় তাৎপর্যময় ঘোষণা। যে ঘোষণা বিগত শতকের মনীষীরা রঁলা-রাসেল-আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ চিন্তাবিদ রেখে গেছেন, আমাদের হৃদয়-মন শুদ্ধতায় ভরে দিতে। আমরা কি সেসব মনে রেখেছে। না, রাখিনি। তবু আগামী বছরের শপথ হোক শান্তি, সুস্থ জীবনের পরিচর্যা এবং তা সর্বস্তরে। যা মানসিক বিশ্ব গড়ে তোলার প্রত্যয়ে ঋদ্ধ। জানি না কী আছে ভবিষ্যত সময়ের মুঠোয়।

লেখক: রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়