ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বাঁশির সুরের প্রেমে …

আমিনুর রহমান হৃদয় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০২, ৩ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাঁশির সুরের প্রেমে …

আমিনুর রহমান হৃদয় : বাঁশির সুর সবার মনে নাড়া দেয়। সুর কখনো মন ভালো করে, কখনো পুরনো দিনের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। অনেকে এই সুরের প্রেমে মাতোয়ারা হন।

তেরো বছর বয়সে সুরের প্রেমে পড়েছিলেন এমনই একজন। বাঁশি শুনতে তার ভালো লাগতো। একটা সময় তিনি নিজেই বাঁশি বাজানো শিখে সুরে ঝড় তোলেন। যদিও এই ঝড়ে তার শিক্ষাজীবনটাই ঝরে পড়ে। তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দেন। স্কুল ফাঁকি দিয়ে খোলা মাঠে বসে একা একা বাঁশিতে সুর তুলতেই তার ভালো লাগত। শুনে অনেক তরুণী তাঁকে প্রেমও নিবেদন করেছেন। ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে তার এই সখ্য। বলছিলাম বংশীবাদক রাজু মিয়ার কথা। বাড়ি নেত্রকোনার মদন থানার ত্রিয়োশ্রী গ্রামে।

সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে রাজু মিয়ার রাজধানীর ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে কথা হয়। কথায় কথায় জানালেন, বাবা ইসমাঈল মিয়া পেশায় কৃষক, মা জুলেহা গৃহিণী। তিন ভাই আর এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। বর্তমানে থাকেন রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে। বাঁশির প্রেমে পড়ার গল্প জানতে চাইলে রাজু মিয়া বলেন, ‘আমার এক চাচাতো ভাই বাঁশি বাজাতো। আমার বয়স তখন ১৩ বছর। আমি তার কাছে প্রতিদিন বিভিন্ন গানের সুর বাঁশিতে শুনতাম। একটা সময় বাঁশি না শুনলে আমার ভালো লাগতো না। ফলে ঠিক করি, আমিও বাঁশি বাজানো শিখব। চাচাতো ভাই রেহাজ মিয়ার কাছেই আমি বাঁশি বাজানো শিখেছি। এরপর বাঁশি বাজানো আমার নেশা হয়ে যায়। সবকিছু বাদ দিয়ে দিন-রাত বাঁশি নিয়ে মেতে থাকতাম। আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেও আমি যেতাম না। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দূরে কোথাও খোলা মাঠে বসে একা একা বাঁশিতে সুর তুলতাম।’

দশ বছর নিজে নিজে বাঁশি বাজানোর পর গৌরাঙ্গ নামে এক ওস্তাদের কাছে বাউল গানের তালিম নেন রাজু মিয়া। তার কাছেই বাঁশির সুর আত্মস্থ করেন। এরপর গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে তিনি বাঁশি বাজাতেন। এভাবেই এলাকার মানুষের কাছে তিনি ‘বংশীবাদক’ হিসেবে পরিচিতি পান। এ সময় পার্শ্ববর্তী কেন্দুয়া থানার মো. সালাম তাকে একটি প্রস্তাব দেন। রাজু বলেন, ‘আমাকে তিনি বাঁশি তৈরি শেখাবেন, বিনিময়ে তার ছেলেকে বাঁশি বাজানো শেখাতে হবে। আমি সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। এরপর থেকে আমি নিজে বাঁশি তৈরি করা শুরু করি এবং বিভিন্ন মেলায় ঘুরে ঘুরে বাঁশি বিক্রি করতে থাকি। এতে আমার চলার মতো টাকা আয় হতো। মেলায় বাঁশি বিক্রির পাশাপাশি বাঁশি শুনিয়ে মানুষকে আনন্দও দিতাম।’

রাজু মিয়া আরো বলেন, ‘মেলায় ঘুরে বাঁশি বিক্রির সময় ঢাকার এক লোকের সঙ্গে দেখা হয়। তিনিই আমাকে ঢাকায় এসে বাঁশি বিক্রি করার প্রস্তাব দেন। ২০০৪ সালে ঢাকা আসি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে বাঁশি বিক্রি শুরু করি। সেই সঙ্গে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বাঁশি বাজিয়ে শুনাতাম। ঢাকার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজাই। বাজিয়ে ভালো টাকা পেতাম।’

 



বাঁশির বিভিন্ন সুর নিজে নিজে তুলতে পারলেও বাঁশির স্বরলিপি জানতেন না- একথা জানিয়ে এই বংশীবাদক বলেন, ‘ঢাকায় মোহাম্মদ তাজুল নামে এক ওস্তাদের কাছে বাঁশির স্বরলিপি শিখেছি। এখন বাঁশি বাজানো শেখাই, অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজাই এবং বিকালে রবীন্দ্র সরোবরে এসে বাঁশি বিক্রি করি। প্রতিমাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় হয়।’ জীবনের কষ্টের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জীবনে লেখাপড়া করতে পারলাম না। এটাই সবচেয়ে বড় কষ্ট। লেখাপড়ার যে কি দাম তখন বাপ-মাও বোঝেনি, আমিও বুঝি নাই। লেখাপড়া করলে আরো ভালো জায়গায় যেতাম।’

স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে এই বংশীবাদক বলেন, ‘ছেলেমেয়েকে নিয়েই আমার স্বপ্ন। আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের লেখাপড়া করাতে চাই। তাদের মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। এটাই এখন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন।’ তার চতুর্থ শ্রেণী পড়ুয়া ছেলে শাহাদাত হোসেনও ভালো বাঁশি বাজাতে পারেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ছেলে বিভিন্ন টিভির গানের অনুষ্ঠানে এরই মধ্যে বাঁশি বাজিয়েছে। তাকে লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি গানও শেখাচ্ছি।’

ত্রিশ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা দামের বাঁশি তিনি বিক্রি করেন। জানালেন, স্কেলের বাঁশিতে বেশি লাভ। স্কেলের বাঁশির দামও বেশি। আর অন্যান্য বাঁশিতে ৩০-৪০ টাকা লাভ হয়। অর্ডার দিয়েও তার কাছে চাহিদা মতো বাঁশি কিনতে পাওয়া যায়। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা থেকে বাঁশি কিনে আনেন। তার বাঁশির সুর শুনে অনেক মেয়ে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছেন এই কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাঁশির সুরে বিরহ-বিচ্ছেদ বেশি থাকে। মেয়েরা সুরের প্রেমে পড়ে। জীবনে অনেক মেয়ে আমার বাঁশির সুর শুনে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে প্রেম করা হয়ে ওঠেনি। পারিবারিক প্রস্তাবেই বিয়ে হয়েছে।’ যারা আগামীতে বাঁশি বাজানো শিখতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘বাঁশি বাজানো সাধনার বিষয়। এক মাস বা দুই মাসে বাঁশি বাজানো শেখা যায়। তবে বংশীবাদক হয়ে উঠতে হলে যুগ যুগ ধরে সুরের সাধনা করতে হবে।’

সবশেষে তিনি জানান, ইন্টারনেটের প্রভাবে বর্তমানে আগের মতো তেমন কদর নেই বাঁশির। ১০ বছর আগে প্রচুর বাঁশি বিক্রি হতো। এখন আর তেমন বাঁশি বিক্রি হয় না। প্রসঙ্গত, যে কেউ বাঁশি বাজানো শিখতে অথবা বাঁশির অর্ডার দিতে রাজু মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন এই নাম্বারে: ০১৯৩৩৪১৫৫০১





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জুলাই ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়