বাংলাদেশের সেরা আবিষ্কার ‘হরিধান’
শাহ মতিন টিপু : চলে গেলেন হরিধানের আবিষ্কারক হরিপদ কাপালি। লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে, বাংলাদেশের সেরা আবিষ্কার হরিধান। সম্প্রতি শাহবাগে ‘সায়েন্স ফিকশন বইমেলা’ উদ্বোধনকালে তিনি এই মত ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি ওই অনুষ্ঠানে হরিধানকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার বলে বর্ণনা করেন। হরিধানের আবিষ্কারকে দৃষ্টান্ত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘বাংলাদেশে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার কী জিজ্ঞেস করলে, আমি বলবো হরিধান। যশোরে এক কৃষক এ ধান উদ্বোধন করেছেন। ধান লাগানো খেতে কৃষক দেখলেন, একটা নির্দিষ্ট ধানের গোছায় অনেকগুলো ধান। সাধারণ মানুষের মতো তিনি না গিয়ে সেটা নিয়ে আসলেন, আবার নতুন করে রোপণ করলেন। সেই হরিধান এখন ওই অঞ্চলে ব্যাপক আকারে চাষ করা হচ্ছে।’
বিশেষ জাতের উচ্চ ফলনশীল 'হরিধানে'র জনক হরিপদ কাপালি বুধবার দিনগত রাত ১টা ১০ মিনিটে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের আসাননগর গ্রামের নিজ বাড়িতে বার্ধক্যজনিত কারণে ৯৫ বছর বয়সে মারা গেলেন।
এই গুণী ব্যক্তির জন্ম ১৯২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের আসাননগর গ্রামে। ১৯৯৬ সালে তিনি এই হরিধান অাবিষ্কার করেন। তার নামানুসারে ওই ধানের নাম রাখা হয় 'হরিধান'।
তার ধান আবিষ্কারের ঘটনাটিও চমকপ্রদ। ১৯৯৯ সালে নিজের ধানের জমিতে একটি ছড়া তার নজর কাড়ে। ধানের গোছা বেশ পুষ্ট এবং গাছের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এ ছড়াটি তিনি নজরদারিতে রাখেন। ধানের ছড়া বের হলে তিনি দেখতে পান ছড়াগুলো তুলনামূলকভাবে অন্য ধানের চেয়ে দীর্ঘ এবং প্রতিটি ছড়ায় ধানের সংখ্যাও বেশি। ধান পাকলে তিনি আলাদা করে বীজ ধান হিসেবে রেখে দিলেন। পরের মৌসুমে এগুলো আলাদা করে আবাদ করলেন এবং আশাতীত ফলন লাভ করেন। এভাবে তিনি ধানের আবাদ বাড়িয়ে চললেন। আর নিজের অজান্তেই উদ্ভাবন করলেন এক নতুন প্রজাতির ধান। তার উদ্ভাবন আসাননগর গ্রামের মানুষের ছিল ধারণার বাইরে। রাস্তার পাশে জমি হওয়ার কারণে চারদিক এ ধানের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ধান কাটা শুরু হলে আশপাশ গ্রামের কৃষকও বীজ নিয়ে বাম্পার ফলন পান। কৃষক এ ধানের কোনো নাম না পেয়ে নাম দেন 'হরিধান'। এর পর থেকে হরি ধানের আবাদ বিস্তার ঘটে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, জেলা থেকে জেলায়। সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে হরি ধানের বীজ সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলকভাবে মহেশপুরের দত্তনগর কৃষি ফার্ম ও সাধুহাটি খামারে চাষ করা হয়। হরি ধানের বৈশিষ্ট্য দেখে অনেকটা অবাক হয়ে যান কৃষিবিজ্ঞানীরা। তারা জানান হরি ধানে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং অতিবৃষ্টি সহনীয়।
ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া জেলার অনেক জমিতে এখন এই ধান চাষ হচ্ছে। বিঘাপ্রতি ফলন ১৮ থেকে ২০ মণ। ধানের কান্ড পুরু ও বিচালি শক্ত। মোটা চাল। ভাত মোটা হলেও অনেক সুস্বাদু।
কৃষিতে অন্যন্য অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। এছাড়া সরকার তাকে একটি বাড়ি তৈরি করে দেয়। সেই বাড়িতেই স্ত্রী সুনিতা রানী (৭৫) ও পলিত পুত্র রুপকুমারকে নিয়ে থাকতেন তিনি। এলাকার মানুষ তাকে নিয়ে গর্ব করতেন।
হরিধান’ উদ্ভাবনের পরই মূলত হরিপদ কাপালীর নাম গণমাধ্যমে আসে এবং সারা দেশে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি তিনি কৃষিসংশ্লিষ্ট গবেষকদেরও নজর কাড়েন। মানুষ তার ধান সম্পর্কে আগ্রহী হন এবং এ ধানের চাষ শুরু করেন। তবে এখন আরো উচ্চফলনশীল ধান বাজারে আসায় ‘হরিধানের’ চাষ তুলনামূলকভাবে কমে গেছে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ জুলাই ২০১৭/টিপু
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন