উপকূলে নারী-৯
‘বাঘ বিধবা’ নারীর নোনাকষ্ট
উপকূলে নারী-অবহেলা, বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার ভাগ্য বিড়ম্বিত এক জীবন। যে জীবনে সংকট নিত্যদিনের, নেই সমাধান। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে সংসারের বোঝা চাপে নারীর ওপর। পুরুষবিহীন সংসারে নারী হয়ে ওঠেন পরিবারের প্রধান। অথচ কোথাও নেই এতটুকু স্বীকৃতি। তবুও টিকে থাকার লড়াইয়ে সে শামিল হয়। উপকূলে নারীর সংগ্রামের ইতিবৃত্ত নিয়ে প্রকাশিত হলো ‘উপকূলে নারী’ শীর্ষক ধারাবাহিকের নবম পর্ব। লিখেছেন রফিকুল ইসলাম মন্টু
পশ্চিম-উপকূলের সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলোতে ‘বাঘ বিধবা’ নারীদের জীবন চলছে ধুঁকে ধুঁকে। স্বামী হারানোর কষ্টের সঙ্গে তাদের জীবনে যোগ হয় সামাজিক নিগ্রহ। পরিচিতি পায় ‘অপয়া’ হিসাবে। স্ত্রীর মন্দভাগ্য স্বামীকে বাঘের মুখে ফেলেছে বলে মনে করে স্থানীয় সমাজ। এই দায় মাথায় নিয়ে বহু ‘বাঘ বিধবা’ নারী বাধ্য হয় স্বামীর ঘর ছাড়তে। কিন্তু তারপরও বেঁচে থাকতে হয় তাদের। সন্তান লালন পালন করতে হয়, রোজগারে নামতে হয়। এমন হাজারো সংকটে ‘বাঘ বিধবাদের’ জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। সেখানে আলো ফেলার উদ্যোগ চোখে পড়ে সামান্যই।
‘বাড়ি নাই। ঘর নাই। কাজ নেই। অর্থকড়ি নেই। ছেলেপুলে নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবো। কী খাবো। কষ্টের তো শেষ নাই। নাম তো অনেকবার লিখল। কিছুই তো পাইলাম না। সমাজের কাছেও বোঝা হয়ে আছি। স্বামীকে বাঘে নিয়েছে বলে মানুষ ঘৃণার চোখে দেখে। মিশতে চায় না। পাশে দাঁড়ায় না।’ কথাগুলো বলছিলেন ‘বাঘ বিধবা’ সোনামনি। দুই স্বামীকে বাঘে নেওয়ার কারণে এই নামটি এখন অনেকের কাছেই পরিচিত। শ্যামনগরের পূর্ব ধানখালী গ্রামে তার বাড়ি। স্বামীকে বাঘে নেওয়ার দায় নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে জীবন চলছে তার।
‘বাঘ বিধবা’ সোনামনির প্রথম স্বামী বাঘে পেটে যাওয়ার পর মাত্র একমাস বয়সী শিশুসহ স্বামীর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় শাশুড়ি। শিশুটিকে নিয়ে পথে নামতে হয় তাকে। পরে সোনামনির বিয়ে হয় তার দেবরের সাথে। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে তাকেও বাঘে ধরে নিয়ে যায়। দুই স্বামী বাঘের পেটে যাওয়ার পর সোনামনি ‘স্বামীখেকো’ বলে পরিচিতি পায়। সমাজ তাকে দেখে ভিন্ন চোখে। সমাজে চলাফেরাই তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। শাশুড়ি তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখেন, যাতে সকালে ঘুম থেকে ওঠে সোনামনির মুখ দেখতে না হয়। একজন সোনামনির গল্প থেকেই হাজারো বাঘ বিধবা নারীর জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
শ্যামনগরের গাবুরার গ্রামে ঘুরে বহু ‘বাঘ বিধবা’ নারীর সঙ্গে দেখা মিলে। কেউ কাঠ কাটতে গিয়ে, কেউ মাছ ধরতে গিয়ে, কেউ মধু আহরণ করতে গিয়ে বাঘের পেটে গেছে। গল্পগুলো প্রায় একই রকম। ছয় বছর আগে রাবেয়া বেগমের স্বামী আতিয়ার রহমানকে বাঘে নিয়েছে। বনে মাছ ধরার বরশি ফেলছিল। হঠাৎ বাঘের আক্রমণ। খবর পেয়ে এলাকাবাসী গিয়ে আতিয়ারের মাথাটা উদ্ধার করতে পেরেছে। শরীরের বাকি অংশ খেয়ে ফেলে বাঘ। মাথাটা এনে সকলে মিলে দাফন করে। স্বামী হারানোর পর থেকে রাবেয়া বেগমের জীবন চলছে ধুঁকে ধুঁকে। দুই ছেলে দিনমজুরি করে সংসার চালায়। ঘটনাটি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া গ্রামের।
কয়রার গোলখালী গ্রামের আ. হাকিম মোল্লা পাঁচ বছর আগে বাঘের পেটে গেছে। দু’মেয়ে রাফেজা ও আফেজাকে নিয়ে ফজরের সময় বনের খালে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। মেয়ে দুটো তার কাছ থেকে একটু দূরে ছিল। এরইমধ্যে আকস্মিকভাবে বাঘের আক্রমণে পড়েন হাকিম। মেয়েরা বাড়ি ফিরে খবর জানালে এলাকা থেকে একদল লোক সেখানে যায় আ. হাকিমকে উদ্ধার করতে। মুখমণ্ডল আর একখানা পা উদ্ধার করা সম্ভব হয়। বাকিটা খেয়ে ফেলেছিল। একই গ্রামের গোলখালীর ওয়াসকুরুনি আরেকজন বাঘের পেটে গেছে ঘূর্ণিঝড় আইলার পরপরই। সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন ভোরে। মাছ ধরার পাশাপাশি মধুও আহরণ করেন। সঙ্গে ছিল দুই ভাই আর জামাতা। গাছে ওঠে মৌচাক কাটতে গেলে ওয়াসকুরুনিকে বাঘে ধরে। সঙ্গে থাকা অন্যরা ফিরে এলাকায় খবর জানায়। লোকজন গিয়ে বাঘের মুখ থেকে মাত্র একটি হাত উদ্ধার করতে পেরেছে।
সুন্দরবনে শামুক সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রায় দশ বছর আগে বাঘের পেটে গেছেন আ. রশিদ মোল্লার বাবা আব্বাস মোল্লা। বনে ‘জোংরা’ নামের এক প্রকার শামুক সংগ্রহ করতেন। এ শামুক দিয়ে চুন তৈরি করা হয়। প্রতিদিনের মত সেদিনও বনে কাজে যান আব্বাস। আকস্মিকভাবে বাঘের আক্রমণ। খবর পেলে এলাকার লোকজন ছুটে গেলেও তাকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। আব্বাস মোল্লাকে বাঘে নেওয়ার পর তার পরিবারে নেমে আসে চরম সংকট। সংসারের বোঝা ওঠে স্ত্রী মরিয়ম বেগমের কাঁধে। কিশোর রশিদ মোল্লা লেখাপড়া ছেড়ে মাকে সাহায্য করে। তাকেও জীবিকার প্রয়োজনে ছুটতে হয় সুন্দরবনে। এখনও তিনি বনের কাজেই জীবিকা নির্বাহ করেন।
সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলোর বিভিন্ন স্থানে আলাপে ‘বাঘ বিধবা’ নারীদের গল্প কানে আসে। একজন বলেন, স্বামীকে বাঘে নেওয়ার পর শশুর বাড়িতে নির্যাতিত হতে থাকি। নির্যাতনের এক পর্যায়ে স্বামীর ঘর ছাড়তে হয়। দরিদ্র বাবার ঘরে গিয়ে উঠি। বাবার সংসারেও টানাটানি। তাই আমি সেখানে থেকে বাইরের কাজে নামি। আরেকজন বলেন, স্বামীর রোজগারে সংসার চলতো। স্বামী বাঘের পেটে যাওয়ার পরে নিজেই রোজগারে নেমেছি। নদীতে রেনু পোনা ধরি, অন্যের বাড়িতে কাজ করি। অনেক কষ্টে দুটো সন্তান নিয়ে কোনভাবে টিকে আছি।
সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, পশ্চিম-উপকূলে সুন্দরবনের আশপাশের এলাকায় নোনাজলের আগ্রাসন বদলে দিয়েছে মানুষের জীবন। এক সময় এ এলাকার জমিতে প্রচুর পরিমাণে ফসল হলেও তা গ্রাস করেছে নোনাজল। চিংড়ি চাষ মানুষের সবুজ স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। মুন্সীগঞ্জের প্রান্তিক কৃষক আবুল হোসেন বলেন, নব্বাইয়ের দশক থেকে এখানকার মানুষ চিংড়ি চাষের কারণে কৃষি থেকে উৎখাত হতে থাকে। কৃষকেরা বেকার হতে থাকে। বর্গাচাষী, কৃষি মজুর হিসাবে যারা কৃষিতে জীবিকা নির্বাহ করতো, এরা কাজ হারান। অবশেষে এদের একটি বড় অংশ সুন্দরবনে কাজে যায়। আর সুন্দরবনের আশপাশের এলাকা পরিণত হয় লবণ ভূমিতে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর জরিপ বলছে, সুন্দরবন প্রভাবিত সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ সুন্দরবনের সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনে জীবিকা নির্বাহকারীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি উপজেলার গাবুরা, মুন্সিগঞ্জ ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে। এসব ইউনিয়নের প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবার সুন্দরবন নির্ভর। সুন্দরবন সংলগ্ন দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার চারিদিকে নদীবেস্টিত। এখানকার জনগোষ্ঠীকে বেঁচে থাকতে হয় সুন্দরবনের ওপর নির্ভর করে। এখানকার অধিকাংশ মানুষ জেলে, বাওয়ালী, মৌয়ালী, পোনা সংগ্রহকারী। এই কাজের জন্য মানুষগুলোকে সুন্দরবনে যেতে হয়। জীবিকার জন্যে সুন্দরবনে গিয়ে বহু মানুষ বাঘের আক্রমণের শিকার হয়। অথচ কৃষি জমিতে এদের জীবিকার সুযোগ থাকলে এরা বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পারতো। ‘বাঘ বিধবা’ সমাজের কাছে ‘অপয়া’ বলে আখ্যায়িত হতেন না।
বাঘের আক্রমণের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারে চরম বিপর্যয় নেমে আসার কথা উল্লেখ করে শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কাশেম মোড়ল বলেন, পরিবারের কর্মক্ষম মানুষটিকে বাঘে নেওয়া ফলে পরিবারে আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়। তবে এলাকায় শিক্ষার হার অনেক কম ছিল বলে স্বামীকে বাঘে ধরলে শ্বশুর বাড়ির লোকজন দোষ দিত স্ত্রীকে। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তরফে এসব বিধবা নারীদের কর্মসংস্থানেরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘বাঘ বিধবা’ নারীদের সামাজিক মর্যাদা ও পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন। গঠিত হয়েছে ‘বাঘ বিধবা এসোসিয়েশন'। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে এসব বিধবা নারীদের সংগঠিত করা হচ্ছে। এসোসিয়েশনের সাপ্তাহিক বৈঠকে নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন, জমি চাষ, সেলাইয়ের কাজ শেখা থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়। বিধবা নারীরা একত্রিত হয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিকল্পনা করেন। তবে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের বিভিন্ন কার্যক্রম গৃহিত হলেও তার অর্জন সামান্যই।
শামনগরের সুন্দরবন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রনজিৎ বর্মন বলেন, এক সময় এ এলাকায় মাঠে ফলতো ধান। চাষাবাদের মাধ্যমেই বহু মানুষের জীবিকা নির্বাহ হতো। সময়ের বদলে ধানের স্থান দখল করে নিয়েছে চিংড়ি। চিংড়ি চাষের কারণে মাঠে লবণ পানি ঢোকানো হচ্ছে। বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। এদের একটি বড় অংশ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সুন্দরবনে যাওয়ার কারণেই তাদের বিপদ বাড়ছে। নারীরা বিধবা হয়ে সমাজের কাছে নিগৃহীত হচ্ছে। তবে অবস্থা আগের চেয়ে বদলাচ্ছে।
সুন্দরবন সুরক্ষায় কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রূপান্তর-এর নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, বাঘ বিধবা নারীরা সামাজিক নিগ্রহের শিকার। স্বামীকে বাঘে নেওয়ার পর তাকে শুনতে হয় নানান কথা। এমনকি অনেকে স্বামীর ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। বিধবা নারীদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। যাতে তারা স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারে।
পড়ুন :
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮/সাইফ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন