ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বাঘ বিধবাদের ঠাঁই হয়না স্বামীর সংসারে

এম.শাহীন গোলদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ১ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাঘ বিধবাদের  ঠাঁই হয়না স্বামীর সংসারে

কয়েকজন বাঘ বিধবা

এম.শাহীন গোলদার, সাতক্ষীরা : সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে স্বামী নিহত হলে স্ত্রীর ঠাঁই হয়না স্বামীর সংসারে। এসব নারীদের বাঘ বিধবা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সামাজিক কুসংস্কারের কারণে অপয়া, অলক্ষ্মী, স্বামী খেকো অপবাদ দিয়ে স্বামীর ভিটা থেকে বিতাড়িত করা হয়।

সুন্দরবনের এসব বাঘ বিধবাদের সামাজিক মর্যাদা সংরক্ষণ ও পুনর্বাসনে কাজ করে যাচ্ছে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন অনির্বাণ, দুর্জয়, জাগ্রত ও বাঘ বিধবা নারী সংগঠন লির্ডাস।

বাঘের আক্রমণে স্বামী নিহত হলে তার দায়ভার নিতে হয় নারীদেরই। সুন্দরবন সংলগ্ন মুন্সিগঞ্জ জেলে পাড়ার  ‘সোনামনি’। একে একে তার দুই স্বামীকেই বাঘে খেয়েছে। এজন্য কোন শুভ কাজে যাওয়ার আগে তার মুখ দেখে কেউ বের হয় না। বাঘ বিধবা সোনামনি বলেন, ‘১৯৯৯ সালে আমার স্বামীকে বাঘে ধরে এজন্য আমার শাশুড়ি আমাকে ১ মাস বয়সী এক বাচ্চাসহ তাড়িয়ে দেয়। আমি সেই বাচ্চাকে নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম। আমার কষ্ট দেখে আমার স্বামীর ছোট ভাই আমাকে বিয়ে করে। ২০০৩ সালে তাকেও বাঘে ধরে। এর পর থেকে আমাকে শুনতে হয় অপয়া-অলক্ষ্মী-স্বামী খেকোসহ নানা কথা।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত দেওয়া হয়না। দাওয়াত দিলেও সবার শেষে খেতে দেওয়া হয় আমাকে। কেউ আমার মুখে দেখে কাজে বের হয় না। বেঁচে থেকেও মৃত মানুষের মতো মনে হয়।’

শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ এলাকার ‘বাঘ বিধবা’ বুলি দাশী বললেন, ‘আমার স্বামী অরুণ মন্ডল ২০০২ সালে সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরতে যেয়ে বাঘের আক্রমনে নিহত হয়। এর পর থেকে আমার শাশুড়ি আমাকে বলতে থাকে তুই অপয়া, তোর কারণে আমার ছেলেকে বাঘে খেয়েছে, বলে নির্যাতন করতো। দুইমাসের মাথায় তিন ছেলে মেয়েসহ শ্বাশুড়ি আমাকে তাড়িয়ে দেয়। তাড়িয়ে দেওয়ার সময় আমার ছোট মেয়ের বয়স মাত্র এক মাস। আমার বাবা মারা গেছে অনেক আগেই। তারপর ভাইয়ের সংসার ঠিকমতো চলেনা । ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে উঠলাম। এর পর থেকে বিভিন্ন কাজ করে এবং নদীতে রেণু পোনা ও কাকড়া ধরে সংসার চালাতে শুরু করলাম। এমনিভাবে ছেলে মেয়েগুলোকে বড় করছি।’

তিনি বলেন, ‘ আমাদের গ্রামের অনেকেরই যাদের স্বামীকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে, তাদের অলক্ষ্মী-অপয়া বলে বাপের বাড়ি তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার স্বামীর ছোট ভাইও বাঘের আক্রমণে নিহত হয়। তার স্ত্রী দিপালিকেও স্বামীর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’

সুন্দরবনের কোলঘেঁষা মুন্সিগঞ্জ এলাকার বাঘ বিধবা শাহিদা খাতুনও বলেন একই কথা। এই বিধবা নারী নদীতে জাল টেনে আর অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান । এখন তিনি সুন্দরবন সংলগ্ন চুনা নদীর ধারে তার কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে বাস করছেন।

শ্যামনগর উপজেলার লিডার্সের কর্মকর্তা মোহন কুমার মন্ডল জানান, ‘সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় বর্তমানে প্রায় সাড়ে এগারশ’ বাঘ বিধবা নারী রয়েছে। এর মধ্যে শ্যামনগর উপজেলার গাবুরায় ইউনিয়নে ১০৯, বুড়িগোয়ালীনি  ইউনিয়নে ৩৯,  মুন্সিগঞ্জে ১০৭, রমাননগরে ৪১ জনসহ সুন্দরবনের কোলে প্রায় ১১০০ বাঘ বিধবা রয়েছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ সালেই সুন্দরবনে গিয়ে মারা যায় ১২০ জন বনজীবী। তবে স্থানীয়দের ভাষ্যমতে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। যারা অবৈধভাবে সুন্দরবনে গিয়ে মারা যায় তাদের নাম সরকারি খাতায় ওঠে না। ফলে স্বামী হারা বিধবার সংখ্যা অনেক।

শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো.আবুল কাশেম মোড়ল বলেন, ‘সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা মানুষ আমরা। আমাদের এলাকার মানুষের শিক্ষার হার অনেক কম। তবে এখন অনেকটা উন্নত হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে কিছু কুসংস্কার ছিলো কারো স্বামীকে বাঘে খেলে পুরো দোষটা স্ত্রীকে দিয়ে তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হতো। মানুষ এখন অনেক সচেতন, এখন আর এটি শোনা যায় না।’

তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের কারণে সুন্দরবন প্রাকৃতিক ভারসাম্য বদলে যাওয়ায় সুন্দরবনের বাঘের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সুন্দরবন বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন বাঘের আক্রমণে নিহতের ঘটনা খুবই কম শোনা যায়। এই বছর তিন জন বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছে বলে জেনেছি।’

স্থানীয়ভাবে সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত পিযুস বাউলিয়া পিন্টু বলেন, ‘সুন্দরবনে প্রবেশের আগে বনজীবীরা বনবিবির পুজা-অর্চনা দিয়ে বনে প্রবেশ করে। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের মধ্যে আদিকাল থেকে কিছু কুসংস্কার চলে আসছে। কারো স্বামী বনে মধু সংগ্রহ, কাঠ কাটা, মাছ ধরার জন্য প্রবেশ করলে সেই নারীকে কিছু নিয়ম মানতে হয়। যেমন- অন্যপুরুষের সাথে কথা বলা যাবে না, চুল আচড়ানো যাবে না, শরীরে তেল মাখা যাবেনা ইত্যাদি। তবে এখন মানুষ সচেতন হয়েছে।তার পরও সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল অনেক পরিবার এটি ধরে রেখেছে।

উল্লেখ্য, বেসরকারি সংস্থা লিডার্সের তথ্যমতে, ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাঘের আক্রমণে মারা গেছে এক হাজারের অধিক বনজীবী। ২০১২ সালের পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাঘের আক্রমণে নিহত খবর না পাওয়া গেলেও ২০১৭ সালে ৩জন নিহত এবং একজন আহতের খবর পাওয়া গেছে।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/সাতক্ষীরা/ ১ আগস্ট ২০১৭/এম.শাহীন গোলদার/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়