ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

বাঙালির আত্মশক্তির খোঁজ দিয়ে গেলেন কলিম খান

কবি স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১৪ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাঙালির আত্মশক্তির খোঁজ দিয়ে গেলেন কলিম খান

স্বরলিপি : বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক ও গবেষক কলিম খান বাঙালিকে আত্মশক্তি যোগাতে যে অবদান রেখে গেলেন তা শোধ হবার নয়। এই আত্মশক্তি নামক বৃক্ষের গোড়ায় জল সেচনের জন্য তিনি খনন করেছেন ভাষার শরীর। অবশেষে বাঙালির সামনে উন্মুক্ত করে দিয়ে গেছেন তার গৌরবের ইতিহাস, ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন শেঁকড়ের ঘ্রাণ। তিনি দেখিয়ে গেছেন, ভাষা অতীত চিহ্নবাহী। মানুষ যে-যে যুগের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে বর্তমানে এসে পৌঁছায়,  সেই-সেই যুগের বহু বিলুপ্ত বিষয় মানুষের ভাষায় থেকে যায়।

ভারত সমাজে ধনসঞ্চয় বিষয়ে আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের বিরাগমূলক ধরাণ ছিল। তার প্রমাণ মেলে এখানে—‘তার চিহ্ন বহন করে সংসারের পাঁকে থাকলেও পাঁকাল মাছের মতো গায়ে পাঁক লাগতে দিয়ো না।’ এখনও ধনী মানুষের উল্লেখ করতে গিয়ে এমনও বলা হয়- ও হলো রাঘব বোয়াল। ধনী যখন গরিবকে গ্রাস করে তখন বলা হয়- বড় মাছ ছোট মাছকে এভাবেই খায়; এটাইতো মাৎস্যন্যায়। এখানে প্রশ্ন হলো, জলপ্রাণীদের উল্লেখ করা হয় কেন? উত্তর হলো, আদিম যৌথসমাজের স্বাভাবিক নিয়মে পরিচালিত সেকালের সম্প্রদায়ের জনসাধারণকে তখন ‘জল’ বলা হতো। আর্থিক অবস্থাভেদে এরা কেউ বড় আবার কেউ ছোট মৎস বিবেচিত হতো। প্রাচীন যৌথ সমাজে নগদ-নারায়ণ বা পুঁজির আবির্ভাব হয়েছিল মৎস অবতার হিসেবে। ‘টাকার কুমির’ ‘ঘোড়েল’ ‘রাঘব বোয়াল’ প্রভৃতি প্রাচীন ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন আজও বাঙালির ভাষায় থেকে গেছে। ভাষায় ভেসে থাকা স্মৃতিচিহ্নগুলো সরোবরের জলে ভেসে থাকা পদ্মপাতার সাথে তুলনা করেছেন কলিম খান। এই ধারণাগুলোকে তিনি দেখিয়েছেন বদ্ধমূল ধারণা হিসেবে। সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হিসেবেও দেখিয়েছেন বদ্ধমূল ধারণাকেই।

এই ধারণাগুলো অর্থনীতি-রাজনীতি-ইতিহাস-আধ্যাত্মধারণা-এক কথায় সমগ্র সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। আর এগুলোই নিয়ন্ত্রণ করছে সমাজের অগ্রগতির প্রায় সবকিছুই। আর এই বদ্ধমূল ধারণাগুলো টিকে থাকে ভাষা-ব্যবহারকারীদের মনে কী অবস্থায় রয়েছে, তার ওপর। অসামঞ্জস্য সবটুকুই ভাষা ব্যবহারকারী সমাজ ফেলে দেয়। তারপর নির্ধারিত হয় সমকালীন ভাষার চেহারা। কলিম খান দেখাতে চেয়েছেন, পরম্পরাগতভাবে অজস্র ‘বদ্ধমূল-ধারণা’ রয়েছে কিন্তু সেগুলো আমরা বুঝবার কৌশল ভুলে গেছি। তারই একটি হলো- ‘আত্মনং বিদ্ধি’ বা ‘নিজেকে জানো’। আমাদের মহর্ষিরা তাই বলে গেছেন। আর পাশ্চাত্য বলেছে, ‘know thyself.’

আমি বা আমিত্বকে জানার বিদ্যাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়ই সর্বোচ্চ বিদ্যা বলে মনে করে। কলিম খানের মতে, মানুষ নিজের ভেতরে পম্পূর্ণ নয়; তার দেহমনের অজস্র চাহিদা বা প্রয়োজন আছে। তাই নিজের বাইরে হাত বাড়াতে হয়। এভাবে মানুষ বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের সীমানাও পেরিয়ে যায়। মানুষে দেহে সীমাবদ্ধ থাকে না, নেই। মন যেতে পারে না এমন স্থান নেই। মানুষের অস্তিত্ব তাই সমগ্র বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের বাইরেও। এই যে অসীম মানুষ এই বিদ্যাকেই আধ্যাত্মবিদ্যা বলা হতো। পূর্বপুরুষেরা জগৎটাকে তিনভাগে ভাগ করেছেন— প্রয়োজনের জগৎ, অপ্রয়োজনের জগৎ, অতি প্রয়োজনের জগৎ। বিদ্যাও দেখিয়েছেন তিন ভাগে— পরাবিদ্যা, অপরবিদ্যা, পরাৎপরাবিদ্যা। পরের থেকে যে পর, প্রয়োজনীয় থেকে যে বেশি প্রযোজনীয়, যার পরে আর পর নাই সে অপর। সে অমূল্য— যার কোন দাম নেই এবং যার এত দাম যে দেওয়াই যায় না- অপর হলো তাই।

এখানে এসে পাশ্চাত্য ধারণা হোঁচট খায়। এখন যারা ইউরোপের other ধারণাটি ‘অপর’ নামে  চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তারা ‘অপর’ বিষয়ে বাংলাভাষীর নিজস্ব যে উত্তরাধিকার তা দেখতে পাননি বলে উল্লেখ করেছেন কলিম খান।

তিনি আরও দেখিছেন যে, ভারতীয় সমাজে জাতিভেদের সূত্রপাত হয়েছে ১৯৬২সালে, ভারত-চীন যুদ্ধের পর। এর আগে, ভারত সমাজের মনের গভীরে তান্ত্রিক-বৈদিক, বৌদ্ধ-হিন্দু, হিন্দু-মুসলমান, হিন্দু-শিখ, হিন্দু-জৈন, এবং হিন্দুধর্মের নিজস্ব ব্রাক্ষ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র-শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব-সহজিয়-কর্তাভজা ইত্যাদি ভেদ (বন্ধমূল ধারণা) ছিল। চীনযুদ্ধের পর শক হুন দল পাঠান মোগল এবং ইংরেজরা ভারত মনন সমাজে ঝড়-ঝাপটারূপে আবির্ভূত হয়েছিল। ফলে ভারতের নিজস্ব বদ্ধমূল ধারণা গতিরোধের মুখে পড়ে যায়।

ততোদিনে ভারত পরিবারের কিছু সদস্যও আর ব্রিটিশদের দাপটে হয়ে উঠছিল না। ভারত স্বাধীন হবার পর বহিঃশত্রু যখন স্তিমিত হয়ে গেল তখন নিজের পরিবারের মধ্যেই শুরু হলো সমস্যা। প্রাধানত সাহিত্য ও রাজনীতিতে জাতপাতের সমস্যা সমাধানের (প্রতিক্রিয়ামূলক বদ্ধমূল-ধারণার) ডাক দেওয়া হলো। সেই ডাকেই আজকের ভারত এখানে এসে পৌঁছেছে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, ভারত-সরোবরের উপরিতলে এখন সূর্যের বা জ্ঞানের আলো আর সরাসরি পড়ে না, নানা জাতের শৈবালে তা আটকে যায়। অথচ এই ভারতীয় সমাজেই পূর্বজনেরা ‘বিশ্বায়ন’ দেখেছিলেন। তারা একে নাম দিয়েছিলেন ‘একার্ণব’। কলিম খান দেখালেন যে, মৎস্যাবতারের প্রলয়কালে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীগুলি যখন একত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন তারা তখন বিশ্বায়ন দেখেছিলেন। পুরাণাদি অনুযায়ী, বিশ্বায়নের ফলাফল প্রথমে শুভ পরে অত্যন্ত অশুভ।

একই জোয়ারে ভাসছে মানুষ। না ভেসে উপায় নেই। কারও কর্মবিমূখ হয়ে বেঁচে থাকার পরিবেশ অবশিষ্ট নেই। দেওয়া আর নেওয়ার এখন মহোৎসব। সাহিত্য-সাহিত্যিক, রাজনীতি-রাজনীতিক কেউই আর ‘নরই নারায়ণ’ কিংবা ‘যত্র জীব তত্র শিব’-এর গান গাইছেন না। পণ্যস্রোত, সেবাস্রোত, মজাস্রোত, আর মেধাস্রোতে গা-ভাসানোকে সঠিক মনে করেছেন তারা। কিন্তু যখন এই জোয়ার থেমে যাবে, জল নেমে যাবে তখন কী হবে? মনে রাখা দরকার এই যাবৎ যা দেখা গেছে, বেশিরভাগ সময়ই ‘ক্রমক্ষীয়মাণ নীতি’ মান্য করে চলেছে সব ঝড়। সামাজিক ঝড়গুলোর জীবৎকার প্রথমত ৫০০ বছর টিকতো পরবর্তী সময়ে সেই ঝড়ের আয়ুষ্কাল হয়ে গেছে ২৫০ বছর, আরও পরে ১০০ বছর। সমাজতন্ত্রের ঝড়ো হাওয়া ৫০ বছরও টেকেনি। এই সময়ের ঝড়ের নাম বিশ্বায়ন। ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে এই ঝড়। গড়ে উঠেছে পরস্পরনির্ভরতা। স্রোতটা কেটে গেলেই ‘ডিসকানেক্টেড’ হয়ে যাব আমরা। বিদেশগামী পণ্য-সেবা-মেধা-মজা সব, সবকিছুই শ্মশান আর গোরস্থানের দিকে মিছিল করবে।

কিন্তু প্রাচীন ভারতবাসী আবিষ্কার করে গেছেন,  প্রাবণ-কালের (বিশ্বায়নের) মন্ত্র। তারা দেখিয়ে গেছেন যে, মানবদেহের গ্রহণ-বর্জনই সমাজদেহের আমদানি ও রপ্তানি। অভাবের বস্তুগুলোকে বাইরে থেকে আনা হয় এবং উৎপন্নের উদ্বৃত্তকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া সমাজশরীরের গ্রহণ-বর্জন। এটির পরিমাণ যত কমানো যাবে, সমাজশরীরের কাঠামো ততই দীর্ঘজীবী হবে। তার অর্থ দাঁড়ায়, সামাজিক উৎপাদন কর্মযজ্ঞ এমনভাবে চালাতে হবে যাতে করে উদ্বৃত্ত না হয়, অভাবও না হয়। ঠিক থাকে যেন সমাজদেহের গ্রহণ বর্জনের মাত্রা। প্রাচীন ভারতবাসীর এই আবিষ্কারকে কলিম খান সামনে নিয়ে আসেন যে, কোন জীব কত দিন বাঁচবে তার দৈহিক গ্রহণ-বর্জনের, বিশেষত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের একটি সম্পর্ক আছে- ‘যে জীব যতো বেশি সময়ে যত কম বার শ্বাস নেয়, সে জীব তত বেশি দিন বাঁচে’। আত্মশক্তি অনুসন্ধানই নয়, তিনি দিয়ে গেছেন, বিশ্বায়নের-জোয়ারের জল নেমে গেলে কীভাবে টিকে থাকতে হবে তার পূর্বাভাস।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়