ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বাঙালির ঘরের খোলা জানালা

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ১৪ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাঙালির ঘরের খোলা জানালা

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

|| ড. শিহাব শাহরিয়ার ||

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান’ একটি বই, একটি জীবন, একটি ইতিহাস। বইটিকে বলা যায়, বাঙালির ঘরের খোলা জানালা, রৌদ্রজ্জ্বল বারান্দা, উন্মুক্ত প্রাণময় উঠোন, বিস্তৃত শ্যামল শস্যের মাঠ, শত শত স্রোতস্বিনী নদী, দূরের মনোমুগ্ধকর সবুজ পাহাড় আর ভালোলাগার বঙ্গোপসাগর। এই বইতে নদী মেঘলা মাটির গন্ধ আছে, মধুমতি নদীর কাদা মাখানো আছে এবং বাইঘার নদীর নির্যাস আছে। টুঙ্গিপাড়া অজগ্রামের আলো-বাতাসের মৌ মৌ গন্ধ আছে। সেই গ্রামের মানব শিশু ছোট্ট খোকার জন্ম ও বেড়ে উঠার নিবিড় বর্ণনা আছে। যে খোকা নিজেই তার কথা বলেছেন। বলেছেন নিজের ভাষায়, নিজের ভালোবাসায়। স্মৃতি থেকে তুলে এনে জাদুকরী বর্ণনায় সত্যকে সুন্দর করে বলার এক অসম্ভব, অসাধারণ শব্দগাথা এটি। কারাগারের বন্দী জীবনে নির্জন, বন্ধ, প্রকৃতির মায়াহীন ছায়াহীন ঘরে বসে, বেদনার্ত মনে কি করে এমন রূপময় বর্ণনায় বাঙালির মন, রূপ, রস, গন্ধ, আনন্দ, বেদনা আর এই স্নিগ্ধ জননী-জন্মভূমির কথা সহজ-সরল ও প্রবহমান ভাষায় নিজের আত্ম কথনের মাধ্যমে তুলে ধরলেন- আমি কিছুতেই ভেবে পাই না!

এতোদিন যাঁকে জানতাম বাঙালির কাণ্ডারী, তাঁকে এখন বইটির মাধ্যমে আবিষ্কার করলাম ইতিহাসের এক রাখাল রাজা, এক অসাধারণ কথক রূপে। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষকের মতো, ইতিহাসবিদের মতো, সমাজ বিজ্ঞানীর মতো, নৃ-তাত্ত্বিকের মতো এবং একজন গাল্পিকের মতো লিখেছেন বাঙালির হাজার বছরের পরাজয়, বীরত্ব, সংগ্রাম, সাধনা, ত্যাগ, হতাশা, আশা, ভালোবাসার কথা ইত্যাদি। আর এসবই উঠে এসেছে লেখকের নিজের জীবন সংগ্রামের কাহিনির মধ্য দিয়ে। যদিও কাহিনির পরিসর খুবই কম। সেটি ১৯২০ থেকে ১৯৫৫ সাল সময় অবধি। কিন্তু এই অল্প সময়ে তার সামগ্রিক বেড়ে ওঠার কাহিনি হলেও, ঐ যে বললাম, এতে উঠে এসেছে বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাস এবং অনেক অজানা তথ্য।

বায়োগ্রাফি এতো সুন্দর হতে পারে? তাও আবার একজন রাজনৈতিক নেতার! হবে না কেন? যাকে বলা হয়েছে ‘রাজনীতির কবি’। সেই মহান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভেতরে ছিল সত্যি এক অসাধারণ কাব্য মন। আমি সেই কাব্যিক মনের পরিচয় সামান্য তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। এটি ১৯৪৬ সালের কথা। দিল্লি কনভেনশনে যোগদান শেষে দল বেঁধে আগ্রা ও তাজমহল দেখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:

‘সূর্য যখন অস্ত গেল, সোনালি রঙ আকাশ থেকে ছুটে আসছে। মনে হলো, তাজের যেন আর একটা নতুন রূপ। সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করছে। কি অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ বৎসর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই, আর ভুলতেও পারবো না।’(পৃ:৫৯)।

তাজমহল, চাঁদ আর জ্যোৎস্নার রঙ নান্দনিকতার সাথে ফুটিয়ে তুলতে মনের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়েছেন। এখানেই প্রমাণ পাওয়া যায়, একজন আদর্শিক রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠার কালে একই সঙ্গে তিনি দুর্বার সংগ্রামী চেতনা এবং ভালোবাসার মনকে ধারণ করেছেন। বইটির পরতে পরতে আছে বাঙালির এই মহান অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের লেখায় নিজের জীবন। যে জীবনে ত্যাগ আছে, কষ্ট আছে, দুঃখ আছে, এগিয়ে যাবার দুর্বার সাধনা আছে, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ আছে, সহযোগিতা আছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস আছে, দাঙ্গা দমন করার মতো ঝুঁকি আছে, প্রেম আছে আর নিজেকে ও মানুষকে ভালোবাসার উদার মন আছে।

শয়নে-স্বপনে শুধু তিনি এ দেশ, এ মাটি, এ দেশের মানুষের মঙ্গল ও মুক্তির কামনা করেছেন। অসুস্থতা তাঁকে কাবু করতে পারেনি। মা এবং বাবা লুৎফর রহমান আর স্ত্রী রেনু তাকে ভালোবাসা দিয়ে, আদর দিয়ে, স্নেহ দিয়ে, অর্থ দিয়ে, সহযোগিতা দিয়ে প্রতিটি ধাপে ধাপে এগিয়ে দিয়েছেন- সেসব সহযোগিতাকে তিনি অকৃত্রিমভাবে স্বীকার করেছেন তাঁর জীবনীতে। রাজনৈতিক ও আদর্শিক গুরু গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সুযোগ্য উত্তরসুরি এই মানুষটি তখনই চারিত্রিক দৃঢ়তায় বেড়ে উঠেছেন। ভাবতে আরো অবাক লাগে, ওই বয়সে একজন মানুষ কীভাবে এতো পরিশ্রম করতে পারে। ক্লান্তিহীন, অদম্য অভিযাত্রা ছিল তাঁর। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’- এই অমর বাণী ধারণ করে তিনি সামনে চলেছেন। বাঙালির বেদনার কথা বলার পাশাপাশি বাঙালির ঈর্ষা কাতরতার কথাও বলেছেন। বলেছেন এজন্য যে, বাঙালির ভেতর পরশ্রীকাতরতা আছে, সেকারণে এদের উন্নতি হয় না। কি অসাধারণ সত্য কথা। তাঁর লেখা থেকেই তুলে ধরছি। উদ্ধৃতি :

‘আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হল আমরা বাঙালি।’ পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাঁকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব অল্প দেশে আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।’ (পৃ: ৪৭-৪৮)।

অথচ দেখেন, এই পরশ্রীকাতর, পিছিয়ে থাকা, শোষিত, অবহেলিত, গরিব, দুঃখি আর পরাধীন বাঙালিদের জন্য তাঁর আজীবন সংগ্রাম, আন্দোলন, জেল-জুলুম, ত্যাগ এবং তাদের মুক্তির জন্য এগিয়ে যাওয়া। মনে হওয়া নয়, সত্যিকার অর্থেই মুজিবের জন্ম হয়েছিল বাঙালির মুক্তির জন্য। যে মুক্তি এবং স্বাধীনতা তিনি এনে দিয়েছেন। এই স্বাধীনতা এনে দেওয়া তার পূর্ব প্রস্তুতিই যেন চলেছে ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত। বইটির এক জায়গায় আছে :

‘‘আমি কয়েকদিন বাড়িতে ছিলাম। আব্বা খুবই দুঃখ পেয়েছেন। আমি ল’ পড়ব না শুনে বললেন, ‘যদি ঢাকায় না পড়তে চাও, তবে বিলাতে যাও। সেখান থেকে বার এট ল’ ডিগ্রি নিয়ে এস। যদি দরকার হয় আমি জমি বিক্রি করে তোমাকে টাকা দিব।’ আমি বললাম, ‘এখন বিলাতে গিয়ে কি হবে, অর্থ উপার্জন করতে পারব না’ আমার ভীষণ জেদ হয়েছে মুসলিম নেতাদে বিরুদ্ধে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে।এর একটা পরিবর্তন করা দরকার।’ (পৃ: ১২৫-১২৬)।

যদি আমরা এই মহান নেতার পূর্ণাঙ্গ জীবনীটি পেতাম, তাহলে তাঁর সংগ্রামী আরো অনেক অজানা তথ্য জানতে পারতাম। সেটি কি পাওয়া সম্ভব? যদি না পাওয়া যায়, তাহলে যতটুকু পেয়েছি, সেই পাওয়া নেপথ্য কাহিনিটুকু আসুন জেনে নিই এবার।    

২.
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান’ বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ থেকে তুলে ধরছি : ‘২০০৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা চারটি খাতা আকস্মিকভাবে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার হস্তগত হয়। খাতাগুলি অতি পুরানো, পাতাগুলি জীর্ণপ্রায় এবং লেখা প্রায়শ অস্পষ্ট। মূল্যবান সেই খাতাগুলি পাঠ করে জানা গেল এটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ করতে পারেননি। জেল-জুলুম, নিগ্রহ-নিপীড়ন যাঁকে সদা তাড়া করে ফিরেছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসর্গীকৃত-প্রাণ, সদাব্যস্ত বঙ্গবন্ধু যে আত্মজীবনী লেখায় হাত দিয়েছিলেন এবং কিছুটা লিখেছেনও, এই বইটি তারই সাক্ষর বহন করছে।

বইটিতে আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, লেখকের বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশ বিভাগ পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণ এবং এসব বিষয়ে লেখকের কারাজীবন, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তনি ও সর্বোপরি সর্বংসহা সহধর্মিণীর কথা, যিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সকল দুঃসমেয় অবিচল পাশে ছিলেন। একইসঙ্গে লেখকের চীন, ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের বর্ণনাও বইটিকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে।’

বইটির দ্বিতীয় ফ্ল্যাপে রয়েছে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী: ‘‘শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে অধ্যয়ন করেন। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। তিনি তাঁর দল আওয়ামী লীগকে ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী করেন। তাঁর এই অর্জন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অন্যতম প্রেক্ষাপট রচনা করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বধীনতার সংগ্রাম।’ ঐ সংগ্রামের জন্য তিনি জনগণকে ‘যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ প্রস্তুত থাকতে বলেন। তিনি ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। তাঁরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করেন এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন হলে শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি বীরের বেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান জীবদ্দশায় কিংবদন্তী হয়ে ওঠেন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুথানে তিনি শাহাদতবরণ করেন।’’

৩.
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান’ বইটির ভূমিকা লিখেছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি লিখেছেন, ‘আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবনের সব থেকে মূল্যবান সময়গুলো কারাবন্দী হিসেবেই কাটাতে হয়েছে। জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়েই তাঁর জীবনে বার বার এই দুঃসহ কারাজীবন নেমে আসে। তবে তিনি কখনও আপোস করেন নাই। ফাঁসির দড়িকেও ভয় করেন নাই। তাঁর জীবনে জনগণই ছিল অন্তঃপ্রাণ। মানুষের দুঃখে তাঁর মন কাঁদতো। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন- এটাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য- এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তাই ছিল প্রতিনিয়ত তাঁর মনে। যে কারণে তিনি নিজের জীবনের সব সুখ আরাম আয়েশ ত্যাগ করে জনগণের দাবি আদায়ের জন্য এক আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা। বাঙালি জাতিকে বীর হিসেবে বিশ্বে দিয়েছেন অনন্য মর্যাদা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে বিশ্বে এক রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন সফল করেছেন। বাংলার মানুষের মুক্তির এই মহানায়ক স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে যখন জাতীয় পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন নিশ্চিত করছিলেন তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেট তাঁকে জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। স্বাধীন বাংলার সবুজ ঘাস তাঁর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। বাঙালি জাতির ললাটে চিরদিনের জন্য কলঙ্কের টিকা এঁকে দিয়েছে খুনিরা।

এই মহান নেতা নিজের হাতে স্মৃতিকথা লিখে গেছেন যা তাঁর মহাপ্রয়াণের উনত্রিশ বছর পর হাতে পেয়েছি। সে লেখা তাঁর ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া, পরিবারের কথা, ছাত্র জীবনের আন্দোলন, সংগ্রামসহ তাঁর জীবনের অনেক অজনা ঘটনা জানার সুযোগ এনে দেবে। তাঁর বিশাল রাজনৈতিক জীবনের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা এই গ্রন্থে তাঁর লেখনীর ভাষায় আমরা পাই। তিনি যা দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন এবং রাজনৈতিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন সবই সরল সহজ ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই সংগ্রাম, অধ্যাবসায় ও আত্মত্যাগের মহিমা থেকে যে সত্য জানা যাবে তা আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। ইতিহাস বিকৃতির কবলে পড়ে যারা বিভ্রান্ত হয়েছেন তাদের সত্য ইতিহাস জানার সুযোগ করে দেবে। গবেষক ও ইতিহাসবিদদের কাছে এ গ্রন্থ মূল্যবান তথ্য ও সত্য তুলে ধরবে।

এই আত্মজীবনী আমার পিতার নিজ হাতে লেখা। খাতাগুলো প্রাপ্তির পিছনে রয়েছে এক লম্বা ইতিহাস। এই বইটা যে শেষ পর্যন্ত ছাপাতে পারব, আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারব সে আশা একদম ছেড়েই দিয়েছিলাম।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পরপরই আমাদের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে (পুরাতন), (বর্তমান সড়ক নম্বর ১১, বাড়ি নম্বর ১০) পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হানা দেয় এবং আমার পিতাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাঁকে গ্রেফতারের পর আমার মা ছোট দুই ভাই রাসেল ও জামালকে নিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এরপর আবার ২৬শে মার্চ রাতে পুনরায় সেনারা হানা দেয় এবং সমগ্র বাড়ি লুটপাট করে, ভাঙচুর করে। বাড়িটা ওদের দখলেই থাকে। এই বাড়িতে আব্বার শোবার ঘরের সাথে একটা ড্রেসিংরুম রয়েছে, সেখানে একটা আলমারির উপরে এক কোণে খাতাগুলো আমার মা যত্ন করে রেখেছিলেন। যেহেতু পুরনো মলাটের অনেকগুলো খাত, যার মধ্যে এই আত্মজীবনী ছাড়াও স্মৃতিকথা, ডায়েরি, ভ্রমণ কাহিনী এবং আমার মায়ের হিসাব লেখার খাতাও ছিল, সে কারণে ওদের কাছে আর এগুলো লুটপাট করার মতো মূল্যবান মনে হয়নি। তারা সেগুলো ওভাবে ফেলে রেখে যায়, খাতাগুলো আমরা অক্ষত অবস্থায় পাই।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে পরিবারের সকলকে হত্যার পর তৎকালীন সরকার বাড়িটা বন্ধ করে রেখেছিল। ১৯৮১ সালের ১৭ মে আমি প্রবাস থেকে দেশে ফিরে আসি। তখনও বাড়িটা জিয়া সরকার সিল করে রেখেছিল। আমাকে ঐ বাড়িতে প্রবেশ করতে দেয় নাই। এরপর ওই বছরের ১২ জুন সাত্তার সরকার আমাদের কাছে বাড়িটা হস্তান্তর করে। তখন আব্বার লেখা স্মৃতিকথা, ডায়েরি ও চীন ভ্রমণের খাতাগুলো পাই। আত্মজীবনী লেখা খাতাগুলো পাইনি। কিছু টাইপ করা কাগজ পাই যা উইপোকা খেয়ে ছেলেছে। ফুলস্কেপ পেপারের অর্ধেক অংশই নেই শুধু উপরের অংশ আছে। এসব অংশ পড়ে বোঝা যাচ্ছিল যে, এটি আব্বার আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি, কিন্তু যেহেতু অর্ধেকটা নাই সেহেতু কোন কাজেই আসবে না। এরপর অনেক খোঁজ করেছি। মূল খাতা কোথায় কার কাছে আছে জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন লাভ হয় নাই। এক পর্যায়ে এগুলোর আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।

ইতোমধ্যে ২০০০ সাল থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর লেখা স্মৃতিকথা, নয়াচীন ভ্রমণ ও ডায়েরি প্রকাশের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। আমেরিকার জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়ার’- এ যোগ দেন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ গবেষণার জন্য। এই গবেষণা কাজ করার সময় বঙ্গবন্ধুর জীবন, স্মৃতিকথা ও ডায়েরি নিয়েও কাজ শুরু করেন। আমি ও সাংবাদিক বেবী মওদুদ তাঁকে সহায়তা করি। ড. এনায়েতুর রহিম বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর অকাল মৃত্যুতে এই কাজে বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়। এভাবে হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন তা স্বপ্নেও ভাবতে পারি নাই।   

আমি এ অবস্থায় হতাশ হয়ে পরেছিলাম। এ সময় ইতিহাসবিদ প্রফেসর এ. এফ. সালাহ্উদ্দীন আহমদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর শামসুল হুদা হারুন, লোকসাহিত্যবিদ ও গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান এ ব্যাপারে আমাদের মূল্যবান পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়েছেন। পরবর্তীকালে প্রফেসর সালাহ্উদ্দীন আহমদ ও শামসুল হুদা হারুন অনুবাদের দায়িত্ব গ্রহণ  করেন। শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে আমি ও বেবী মওদুদ মূল বাংলা পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা, কম্পোজ ও সংশোধনসহ অন্যান্য কাজগুলো সম্পন্ন করি। মূল খাতার সঙ্গে মিলিয়ে পড়ি বারো-চৌদ্দ বার। অনেক বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করেই কাজ এগোতে থাকে। ছাপাতে দেবার একটা সময়সীমাও ঠিক করা হয়।

যখন ‘স্মৃতিকথা’ ও ‘ডায়েরি’র কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে সেই সময় আমার হাতে এল নতুন চারখানা খাতা, যা আত্মজীবনী হিসেবে লেখা হয়েছিল। এই খাতাগুলো পাবার পিছনে একটা ঘটনা রয়েছে। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভী রহমানসহ চব্বিশজন মৃত্যুবরণ করেন। আমি আশ্চর্যজনকভাবে বেচেঁ যাই। এই ঘটনার পর শোক-কষ্ট-বেদনায় যখন জর্জরিত ঠিক তখন আমার কাছে এই খাতাগুলো এসে পৌছায়। এ এক আশ্চর্য ঘটনা। এত দুঃখ-কষ্ট-বেদনার মাঝেও যেন একটু আলোর ঝলকানি। আমি ২১ আগস্ট মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। মনে হয় যেন নতুন জন্ম হয়েছে। আর সেই সময় আমার হাতে এল আব্বার হাতের লেখা এই অমূল্য আত্মজীবনীর চারখানা খাতা! শেষ পর্যন্ত এই খাতাগুলো আমার এক ফুফাতো ভাই এনে আমাকে দিল। আমার আরেক ফুফাতো ভাই ‘বাংলার বাণী’ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে সে এই খাতাগুলো পেয়েছিল। সম্ভবত আব্বা শেখ মণিকে টাইপ করতে দিয়েছিলেন, আত্মজীবনী ছাপাবেন এই চিন্তা করে। কিন্তু  ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনিও শাহাদাৎবরণ করায় তা করতে পারেন নাই। কাজটা অসমাপ্ত রয়ে যায়।

খাতাগুলো হাতে পেয়ে আমি তো প্রায় বাকরুদ্ধ। এই হাতের লেখা আমার অতি চেনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে ডাকলাম। দুই বোন চোখের পানিতে ভাসলাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিতার স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি; তারপরই এই প্রাপ্তি। মনে হল যেন পিতার আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছি। আমার যে এখনও দেশের মানুষের জন্য-সেই মানুষ, যারা আমার পিতার ভাষায় বাংলার ‘দুঃখী মানুষ’- সেই দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজ বাকি, তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ  বাকি, সেই বার্তাই যেন আমাকে পৌঁছে দিচ্ছেন। যখন খাতাগুলোর পাতা উল্টাচ্ছিলাম আর হাতের লেখাগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আব্বা আমাকে যেন বলছেল, ভয় নেই মা, আমি আছি, তুই এগিয়ে যা, সাহস রাখ। আমার মনে হচ্ছিল, আল্লাহর তরফ থেকে ঐশ্বরিক অভয় বাণী এসে পৌঁছাল আমার কাছে। এত দুঃখ-কষ্ট-বেদনার মাঝে যেন আলোর দিশা পেলাম।

আব্বার হাতে লেখা চারখানা খাতা। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খাতাগুলো নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। খাতাগুলোর পাতা হলুদ, জীর্ণ ও খুবই নরম হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় লেখাগুলো এত ঝাপসা যে পড়া খুবই কঠিন। একটা খাতার মাঝখানের কয়েকটা পাতা একেবারেই নষ্ট, পাঠোদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন। পরদিন আমি, বেবী মওদুদ ও রেহানা কাজ শুরু করলাম। রেহানা খুব ভেঙে পড়ে যখন খাতাগুলো পড়তে চেষ্টা করে। ওর কান্না বাঁধ মানে না। প্রথম কয়েক মাস আমারও এমন হয়েছিল, যখন স্মৃতিকথা ও ডায়েরি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। ধীরে ধীরে মনকে শক্ত করেছি। প্রথমে খাতাগুলো ফটোকপি করলাম। আবদুর রহমান (রমা) এই কাজে আমাদের সাহায্য করল। খুবই সাবধানে কপি করতে হয়েছে। একটু বেশি নাড়াচাড়া করলেই পাতা ছিঁড়ে যায়। এরপর মূল খাতা থেকে আমি ও বেবী পালা করে রিডিং পড়েছি আর মনিরুন নেছা নিনু কম্পোজ করেছে। এতে কাজ  দ্রুত হয়েছে। হাতের লেখা দেখে কম্পোজ করতে অনেক বেশি সময় লাগে। সময় বাঁচাতে এই ব্যবস্থা । কোথাও কোথাও লেখার পাঠ অস্পষ্ট। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে উদ্ধারের চেষ্ট করা হয়েছে। তবে চারখানা খাতার সবটুকু লেখাই কম্পিউটারে কম্পোজ করা হয়েছে। খাতাগুলোতে জেলারের স্বাক্ষর দেয়া অনুমোদনের পৃষ্ঠা ঠিকমত আছে। তাতে সময়টা জানা যায়।

এরপর আমি ও বেবী মওদুদ মূল খাতার সঙ্গে মিলিয়ে পড়ে সম্পাদনা ও সংশোধনের কাজটা প্রথমে শেষ করি। তারপর অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে আমি ও বেবী মওদুদ পাণ্ডুলিপির সম্পাদনা, প্রুফ দেখা, টিকা লেখা, স্ক্যান, ছবি নির্বাচন ইত্যাদি যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করি। শেখ রেহানা আমাদের এসব কাজে অংশ নিয়ে সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করে।

এই লেখাগুলো বারবার পড়লেও যেন শেষ হয় না। আবার পড়তে ইচ্ছা হয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য, একজন মানুষ কিভাবে কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন, জেল জুলুম নির্যাতন সহ্য করতে পারেন তা জানা যায়। জীবনের সুখ-স্বস্তি, আরাম আয়েশ, মোহ, ধনদৌলত, সবকিছু ত্যাগ করার এক মহান ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পাওয়া যায়। শুধু সাধারণ গরিব দুঃখী মানুষের কল্যাণ চেয়ে কিভাবে তিনি নিজের সব চাওয়া-পাওয়া বিসর্জন দিয়েছেন তা একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে অনুধাবন করা যাবে। এই লেখার সূত্র ধরে গবেষণা করলে আরও বহু অজানা তথ্য সংগ্রহ করা যাবে। জানা যাবে অনেক অজানা কাহিনী। তথ্যবহুল লেখায় পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, বাঙালির স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নানা চক্রান্ত ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনা ও ইতিহাস জানার সুযোগ হবে।’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত। মজার বিষয় তিনি বেঁচেও ছিলেন ৫৫ বছর। যদি নরপশু খুনিচক্র তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা না করতো, তাহলে তিনি দীর্ঘ জীবন পেতেন আর লাভ হতো আমাদের, আমরা তাঁর সম্পূর্ণ আত্মজীবনীর লিখিত রূপ পেতাম। সেজন্য ধিক্কার দিই সেইসব ঘাতক নরপশুদের, যারা ইতিহাসের কলঙ্কের ফাঁসিতে ঝুলেছে এবং ঝুলবে।

বইটির শেষপ্রান্তে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন’ শিরোনামে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সময়কাল ১৯৫৫ সালের পর থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বছর ধরে ধরে রাজনৈতিক জীবনের কথা বা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এটি বইতে সংযোজন করা অত্যন্ত সমীচীন হয়েছে। কেননা নতুন প্রজন্মের মানুষেরা একই মলাটে বন্দী এই গুরুত্বপূর্ণ বইটিতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাবেন।

সকল বাঙালিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বইটি পড়ার জন্য বিশেষ অনুরোধ করছি। কারণ, বঙ্গবন্ধু হলেন বাংলাদেশের আকাশ। সেই বাংলাদেশের আকাশের ত্যাগের একটি উদাহরণ দিয়েই বইটির আলোচনা শেষ করতে চাই। বঙ্গবন্ধুর লেখা থেকে উদ্ধৃতি :

‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” আমি আর রেণু দু’জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তোমারও আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝাবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।” (পৃ: ২০৯)।
 


অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান ॥ প্রকাশক : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ॥ প্রচ্ছদ : সমর মজুমদার ॥ প্রথম প্রকাশ : ২০১২ ॥   





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ আগস্ট ২০১৫/তাপস রায়
 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়