ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বাবা ঠেলেছেন এখন ছেলেও ঠেলছেন

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৭, ১৬ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাবা ঠেলেছেন এখন ছেলেও ঠেলছেন

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : সুরমা নদীর ঢেউহীন জলরাশি। একদিকে সার্কিট হাউজ, লন্ডনের ক্লক টাওয়ারের আদলে নির্মিত জমিদার আলী আমজাদের ঘড়ি, চাঁদনীঘাটে ভাসমান রেস্তরাঁ সুরমা রিভার ক্রুজ। অপরপাশে কদমতলী ও রেলস্টেশন। দুপাশে দুটি সুউচ্চ গেইট। লোহার তৈরি ধনুকের মতো বাঁকানো সংযোগ সেতু। এই হলো সিলেট শহরের প্রবেশদ্বার বলে খ্যাত কিন ব্রিজের দৃশ্যপট।

 

ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ১১৫০ ফুট। প্রস্থ ১৮ ফুট। স্থাপত্যশৈলীর নান্দনিকতা কিন ব্রিজকে করেছে আকর্ষণীয়। কালের বিবর্তনে কিন ব্রিজ হয়ে উঠেছে সিলেট নগরীর ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়স বেড়েছে তার। ব্রিজের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় কিন ব্রিজ দিয়ে এখন আর ভারী যানবাহন চলাচল করে না। বয়সের ভারে সে যেন ক্লান্ত তবুও পর্যটকদের কাছে তার আকর্ষণ এখনও কমেনি। প্রতিদিনই কিন ব্রিজের নান্দনিকতা প্রত্যক্ষ করেন হাজার হাজার মানুষ।

 

বিট্রিশ আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক ব্রিজটি কেবল সৌন্দর্যের কারণেই বিখ্যাত নয়। বরং সাত যুগ ধরে কিন ব্রিজকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে বহু মানুষের জীবন। এই ব্রিজ ঘিরে গড়ে উঠেছে এক অভিনব পেশা, স্থানীয় ভাষায় ‘ঠেলা’ নামে পরিচিত। ব্রিজটি খুব উঁচু হওয়ায় হালকা যানবাহন যেমন রিকশা, ভ্যান ব্রিজের ওপরে উঠাতে চালককে খুব বেগ পেতে হয়। যানবাহনগুলোকে ঠেলে ওপরে উঠাতে সহযোগিতা করেন ব্রিজের দুপাশের কিছু শ্রমজীবী মানুষ। বিনিময়ে তারা নেয় খুব সামান্য টাকা। ঠেলা পেশায় জড়িত শতাধিক বিভিন্ন বয়সের মানুষ রয়েছে। সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত তাদের সরব উপস্থিতি থাকে। এমন পেশা বাংলাদেশের আর কোথাও চোখে পড়ে না।

 

 

ঠেলাকে পেশা হিসেবে নিয়ে বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে বছরের পর বছর। অনেকেই আছেন বংশ পরম্পরায় এ পেশায় নিয়োজিত। কিন ব্রিজে বাবা ঠেলেছেন এখন পুত্রও ঠেলছেন। এই পেশার বিভিন্ন লোকজনের অধিকাংশ বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছেন কামাল উদ্দিন (৩২)। তিনি সাত বছর ধরে এ পেশায় আছেন। তিনি জানান, দৈনিক তার আয় ৩০০-৪০০ টাকা। সুনামগঞ্জের নয়ন (১৮) এক বছর ধরে এ কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘কাজের খোঁজে সিলেট এসেছিলাম। দুই-তিন দিন ঘুরে কাজ পাই নাই। রিকশা চালাতে গেলেও পরিচিত লোক লাগে। এখানে দেখলাম রিকশা ঠেললে পাঁচ টাকা করে পাওয়া যায়, তাই রিকশা ঠেলি।’ বরিশালের বাদলের গল্পও এক। কাজের খোঁজে এসেছিলেন, কাজ না পেয়ে এখন রিকশা ঠেলছেন। রংপুর থেকে এসেছেন সবুজ (৩০)। পাঁচ-ছয় বছর ধরে তিনিও কিন ব্রিজে রিকশা, ভ্যান ঠেলেন। কিন ব্রিজেই রাতে ঘুমিয়ে পড়েন। তার আলাদা কোনো ঠিকানা নেই। মইর উদ্দিন (৪০) রাজমিস্ত্রির কাজের যোগালী। তিনি দিনে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, পরিবারের বাড়তি খরচ মেটাতে রাতে রিকশা ঠেলেন।

 

 

রিকশাচালক আবদুল আলিম (৩০) কয়েক বছর ধরে সিলেটে রিকশা চালান। তিনি বলেন, ওরা রিকশা ঠেলায় আমাদের উপকার হয়। এত উঁচু ব্রিজে কারো সহযোগিতা ছাড়া রিকশা ওঠানো খুব কষ্ট। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সালমান সাঁকো। তার শৈশব কেটেছে কিন ব্রিজের পাশে দক্ষিণ সুরমা এলাকায়। তিনি বলেন, ১২ বছর আগে মায়ের সঙ্গে যখন বাজার করতে যেতাম, তখন কিন ব্রিজে ঠেলাদের দেখতাম। তাদের কেউ ফরমায়েশ করতো না, তারা নিজ থেকেই এগিয়ে এসে রিকশা ঠেলত। তখন প্রতি রিকশা ঠেলায় তারা দুই টাকা পেতেন।

 

কিন ব্রিজ এলাকায় পাকিস্তান আমল থেকে পত্রিকা বিক্রি করেন হকার নুরুল ইসলাম। তিনি জানান, পাকিস্তান আমল থেকেই তিনি ঠেলাদের দেখছেন। কেউ কেউ ঠেলাদের ‘পুল ঠেলা’ নামে ডাকেন। এমন রীতি ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে এসেছে। প্রথম দিকে প্রতি যানবাহন ঠেলার বিনিময় মূল্য ছিল দুই আনা, পরবর্তীতে আট আনা, একটাকা, দুইটাকা এবং বর্তমানে পাঁচ টাকা। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কিন ব্রিজ অতিক্রমকালে দুইজন আরোহী হলে মূল ভাড়ার সঙ্গে ঠেলা ভাড়া হিসেবে পরিশোধ করতে হবে পাঁচ টাকা। তবে মালামাল ব্যতীত একজন যাত্রী হলে এটি প্রযোজ্য হবে না।

 

কিন ব্রিজ তৈরি ও বিবর্তনের ইতিহাস : আসাম প্রদেশের গভর্ণর মাইকেল কিন সিলেট সফরে আসার জন্য সুরমা নদীতে ব্রিজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কারণ তখন আসামের সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ট্রেন। ফলে রেলওয়ে বিভাগ ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এবং নির্মাণ শেষে ১৯৩৬ সালে ব্রিজটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। ব্রিজ নির্মাণে তখনকার দিনে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫৬ লাখ টাকা।

 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে ব্রিজের উত্তর পাশের একাংশ উড়িয়ে দেয়, যা স্বাধীনতার পর মেরামত করা হয়। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহযোগিতায় ব্রিজের বিধ্বস্ত অংশটি কংক্রিট দিয়ে পুনঃনির্মাণ করা হয়। এরপর পুনরায় ব্রিজ দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়। ২০০৫ সালে ঐতিহ্যবাহী কিন ব্রিজসহ সুরমাপাড়ের সৌন্দর্য্য বর্ধন করা হয়।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ নভেম্বর ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়