ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

উপকূলে নারী-৪

বাল্যবিয়ের বোঝা নারীর কাঁধে

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাল্যবিয়ের বোঝা নারীর কাঁধে

উপকূলে নারী- অবহেলা, বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার ভাগ্য বিড়ম্বিত এক জীবন। যে জীবনে সংকট নিত্যদিনের, নেই সমাধান। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে সংসারের বোঝা চাপে নারীর ওপর। পুরুষবিহীন সংসারে নারী হয়ে ওঠেন পরিবারের প্রধান। অথচ কোথাও নেই এতটুকু স্বীকৃতি। তবুও টিকে থাকার লড়াইয়ে সে শামিল হয়। উপকূলে নারীর সংগ্রামের ইতিবৃত্ত নিয়ে প্রকাশিত হলো ‘উপকূলে নারী’ শীর্ষক ধারাবাহিকের চতুর্থ পর্ব। লিখেছেন রফিকুল ইসলাম মন্টু

বাল্যবিয়ে নারীর জীবন এলোমেলো করে দিচ্ছে। বাড়ছে পারিবারিক কলহ, নির্যাতন আর বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা। নারীর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে অতি অল্প বয়সেই, বাসা বাঁধছে নানান রোগবালাই। অল্প বয়সে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তারা নানান সমস্যায় ভুগছেন। ভোলার চরফ্যাসনের কুকরী মুকরীর সুমি বেগম, রেশমা বেগম, আয়শা বেগম, আছিয়া বেগম, পটুয়াখালীর চরমোন্তাজের মমতাজ বেগমসহ আরও অনেকের জীবন কাহিনী বলে দেয় শুধুমাত্র বাল্যবিয়ের কারণে তাদের জীবনে নেমে এসেছে কালো অন্ধকার। আবার কুকরীর কিশোরী জয়নব বেগমকে চিনি, কিছুদিন আগেই সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। যদিও এটা বাল্যবিয়ে। তাকেও হয়তো অল্প সময়ের ব্যবধানে জীবনের কঠিন সংকট মোকাবেলা করতে হবে।   

কুকরী মুকরীর দক্ষিণপ্রান্তে রসুলপুর গ্রামে স্বামীর সঙ্গে দুই যমজ শিশুকন্যা নিয়ে বসবাস করছেন সুমি। লেখাপড়ায় বেশ ভালো হলেও অষ্টম শ্রেণীর পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি নূরুল ইসলাম হাওলাদারের মা হারানো মেয়ে সুমির। মা পিয়ারা বেগমের মৃত্যুর পর ঘরে আসে সৎ মা নিলুফা বেগম। সুমিকে সইতে হয় নানান গঞ্জনা। লেখাপড়া বন্ধ করেই তাকে বিয়ে দেয়া হয়। এখন দুই সন্তানের মা সে। শুকিয়ে কঙ্কাল। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান রোগবালাই। সুমি বুঝতে পারছেন, বাল্যবিয়ে তার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। বেড়ি বাঁধের বাইরে সুমি বেগমের ছোট্ট ঘর থেকে বের হয়ে খানিক দূরে এলে আবদুল হক হাওলাদারের ঘরে এসে বাল্যবিয়ের আরও কাহিনী শুনি। বড় ছেলে জুয়েল হাওলাদার সাত বছর আগে যাকে বিয়ে করে ঘরে এনেছে, সেই রেশমা বেগমের বয়স এখন ২১ বছরের বেশি হবে না। অল্প বয়সে ঘরের সব কাজ সামাল দেওয়ার পর দুটো সন্তানও এসেছে তার কোলে। শরীর ভেঙে গেছে। কঙ্কালসার চেহারা দেখেই বোঝা যায়, শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান রোগ। এই ঘরেরই জয়নব বেগম ওরফে লাভলীর বিয়ে হয়ে গেল মাত্র কয়েকদিন আগে। পঞ্চম শ্রেণীতে সে কেবল বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছে। জয়নব এখনও বাবা আবদুল হকের ঘরেই আছে। হয়তো সে এখনও বুঝতে পারছে না, সামনের জীবনে সে কী সংকটে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু সে বিষয়ে জয়নবের মা আমেনা বেগমেরও এখন পর্যন্ত কোনো চিন্তা আসেনি।  তবে পাশের বাড়িতে বউ হয়ে আসা নূরনাহার, যার বয়স এখন ৩৩ বছর, তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে। তিন ছেলেমেয়ের মা এই নারী বলেন, আগে তো আমরা এতকিছু বুঝি নাই। বিয়ের পর বুঝতে পারছি ছোট বেলায় বিয়ে হলে কী সমস্যা দেখা দেয়। নিজের অল্প বয়সে বিয়ে হলেও মেয়েকে এই ভোগান্তিতে ফেলতে চান না তিনি।
 


কুকরী মুকরীর বাবুগঞ্জ এলাকায় আছিয়া বেগমের বয়স ২০ বছর পার হয়নি এখনও। বিয়ে হয়েছে ৫ বছর আগে। কোলে শিশু সন্তান নিয়ে বলছিলেন জীবনের গল্প। জানালেন, বিয়ের পর থেকে ভালো নেই। নানান রোগ বালাই বাসা বেঁধেছে শরীরে। কিন্তু এসব রোগ বাল্যবিয়ের কারণে কি না, তা বলতে পারেন না আছিয়া। খানিক দূরে শাহিনুর বেগমের ঘরে গিয়ে অবাক হতে হলো। তার মেয়েদের প্রায় সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে ছোটবেলা। পুতুল খেলার বয়স পেরোতে না পেরোতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। দরিদ্র পরিবারে ঘরের কাজ, বাইরের কাজ করতে গিয়ে এরা এখন খুব ক্লান্ত। এই শাহিনুরের এক ছেলে আল আমীন অল্প বয়সেই বিয়ে করে এনেছেন আরেক শিশু আয়শাকে। অল্প সময়ের ব্যবধানে তার জীবনটাও ন্যূয়ে পড়েছে। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া চরমোন্তাজের জাহাঙ্গীর হাওলাদারের মেয়ে মমতাজের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। এমন এক দূরারোগ্য ব্যধি বাসা বেঁধে, স্বামীও এখন তাকে নিতে অনীহা দেখাচ্ছে। তিন সন্তান নিয়ে মমতাজ পড়ে আছেন বাবার বাড়িতে। তার স্বামী নানান অজুহাত দেখাচ্ছে, যৌতুক দাবি করছেন। অথচ মমতাজের অসুস্থতাজনিত কারণেই আগ্রহ কমে গেছে স্বামী কবির হাওলাদারের। এমন হাজারো ঘটনার নীরব সাক্ষী উপকূলের জনপদ। বাবা তার ঘরের ‘বোঝা’ কমাতে মেয়েকে ছোট বেলায় বিয়ে দেওয়ার পর সে বোঝা আসলে কমে না।   

ভোলার চরফ্যাসনের সর্বদক্ষিণে সমুদ্র মোহনায় জেগে থাকা কুকরী মুকরীর ভেতর বাহির দেখি। তরতর করে এগোচ্ছে এ জনপদ। বাঁধ হয়েছে, রাস্তাঘাট হচ্ছে, ব্রীজ হচ্ছে, বসেছে সড়ক বাতি, বিলাসবহুল রেস্টহাউস হয়েছে। বিকাশের ধারায় পর্যটন সম্ভাবনা। বছরে বছরে বাড়ছে পর্যটক। আলো ঝলমল কুকরি দেখে ভালো লাগে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চিত্র কষ্ট দেয়। শুধু বাল্য বিয়ে নয়, আছে যৌতুক আর বিবাহ বিচ্ছেদের মত ঘটনা। শিক্ষায় অনগ্রসরতা এখনও বিদ্যমান। মানুষজনের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে খুব কম। বাল্যবিয়ে প্রসঙ্গে আলাপ হয় কুকরী মুকরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাল্যবিয়ে আমরা রোধ করতে পারিনি। কেন পারছি না, আমি সেটাও সঠিকভাবে বলতে পারছি না। আমি প্রায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বাল্যবিয়ে বিষয়ে ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে কথা বলি, বিভিন্ন সভা-সমিতিতে কথা বলি। এখানে বাল্যবিয়ের ধারণাগুলো বদলে গেছে। আমরা কাজী সাহেবদের ওপর চাপ প্রয়োগ করলে তারা বিয়ের রেজিষ্ট্রি করেন না। তারা বলেন, আকত হয়েছে, হুজুর দ্বারা কলমা পড়ানো হয়েছে। এ কারণে গত কয়েক বছরে কুকরিতে রেজিষ্ট্রিবিহীন বিয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আসলে এটা দারিদ্র্যই বলেন, আর শারীরিক ফিটনেসের কারণেই বলেন, হচ্ছে।’
 


মাঠ থেকে পাওয়া তথ্য এবং বিভিন্ন গবেষণা সূত্র বলছে, সাধারণত মেয়েদের ক্ষেত্রে শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যসেবার অভাবে বাল্যবিয়ে হয়। এ ছাড়া চরম দরিদ্র, দুর্বল বিচারব্যবস্থা ও আইন প্রয়োগ প্রক্রিয়ার অভাবকে বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে ধরা হয়। দেশের আইন অনুযায়ী বিয়ের ন্যূততম বয়স বরের ক্ষেত্রে ২১ আর কনের ক্ষেত্রে ১৮। এর চেয়ে কম বয়সে বিয়ে হলে তা বাল্যবিয়ে বলে বিবেচিত হয় এবং আইনের দৃষ্টিতে অপরাধের শামিল। কিন্তু বাল্যবিয়ে আইন অনুযায়ী অবৈধ হলেও এ আইনের কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। আইন প্রয়োগের দায়িত্ব যাদের সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিতদের নজরদারি ও তৎপরতার অভাবে বাল্যবিয়ে বন্ধে পুরোপুরি সাফল্য আসছে না বলে অনেকে মনে করেন। বাল্যবিয়ের মাঠচিত্র আর জাতীয় পর্যায়ের জরিপের তথ্য একেবারেই মিলে যায়। ‘বাল্যবিবাহ নিরোধকল্পে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা-২০১৮’-এর অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়েছে, বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকারের ব্যাপক তৎপরতা সত্বেও এখনও শতকরা ৪৭ ভাগ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের নিচে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোরম ইন্টারন্যাশনালের গবেষণা জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের ৭৩ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় অল্প বয়সে। ইউনিসেফ বলছে, বাল্যবিয়ের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু এখনও সেটা ৫০ শতাংশের উপরেই রয়ে গেছে। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বে বাল্য বিবাহের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে পৃথিবীতে আড়াই কোটি বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। বাল্য বিয়ের হার বাংলাদেশেও খুব বেশি ছিল, সর্বশেষ ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫২ শতাংশ মেয়ে বাল্য বিয়ের শিকার হতো। কিন্তু বর্তমানে এই হার কতো নিশ্চিত করে জানা না গেলেও ইউনিসেফের মতে, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এক ধরনের উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। অল্পবয়সী মেয়েরাও এখন নিজেদের বিয়ে প্রতিরোধে এগিয়ে আসছেন। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। নারীদের অধিকার নিয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশী কেন্দ্র বলছে, বাল্যবিয়ে বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। যেটুকু হয়েছে, সেটাও হয়েছে সরকারি বেসরকারি সংস্থার দীর্ঘদিনের তৎপরতার কারণে।

কুকরী মুকরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন বলেন, ‘বাল্যবিয়ে আমাদের সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ থেকে আমাদের উত্তরণ হওয়া উচিত। বাল্যবিয়ের সাথেই কিন্তু জড়িত তালাক। বাল্যবিয়ের পর দেখা গেল অল্প বয়সেই বাচ্চা হলো। আবার বাচ্চা না হলেও বিভিন্নভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লো। ফলে শরীর ভেঙে যায়। এক পর্যায়ে মেয়েটি ওই পুরুষের কাছে বোঝা হয়ে যায়। তখন বিভিন্ন অজুহাতে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে এবং ইউনিয়ন পরিষদে এ বিষয়ে বিচার সালিশি হয়। আবার প্রতিটি বাল্যবিয়ের আগে লেনদেন হয়- ২০ হাজার, ৩০ হাজার, ৫০ হাজার কিংবা ১ লাখ টাকা। যৌতুকের বিষয়টি গোপন থাকে, অনেকেই জানে না। অভিভাবক পর্যায়ে এটা দরকষাকষি এবং ফয়সালা হয়। এগুলো থেকে উত্তরণের সবচেয়ে ভালো পন্থা হচ্ছে সচেতনতা সৃষ্টি। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে কী সমস্যা হচ্ছে, তা বাবা-মাকে বোঝাতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ মাঠে নিয়ে যেতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনকেও এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়