ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বিজয়ের মাস ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দাদাগিরি

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৭, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিজয়ের মাস ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দাদাগিরি

অজয় দাশগুপ্ত : সাংস্কৃতিক আগ্রাসন যে কি বিষয় সেটা ঘাড়ের ওপর না চেপে বসা অবদি টের পাওয়া যায় না। একদা উর্দু হটানো বাংলাদেশের মানুষের ঘরে পাকিস্তানি টিভি নাটক এখন বেশ জনপ্রিয় । প্রায়ই শুনি ঐসব নাটকের নায়িকা বা অন্য চরিত্রের আদলে পোশাক বানায় মেয়েরা। পাকি ক্রিকেটের কথা আমরা বললেও বিষয়টি এখনো প্রকট নয় বলে মাথায় ঢোকেনি। তবে এ ব্যাপারে রেকর্ড ভেঙ্গে এগিয়ে আছে হিন্দী। ভারতের বলিউড এক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। সন্দেহ নাই হলিউডের পরেই তার জায়গা। কেনিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা সুদান থেকে মিশর সব দেশেই তাদের ছবির বাজার আছে। সিডনির সিনেমা হলে ইদানীং কয়েকটি বাংলাদেশী ছবি চললেও তার মেয়াদ নিতান্ত অল্প। বড়জোর দু’এক সপ্তাহ। তারপরই নামিয়ে আনতে হয়। আর হিন্দী সিনেমা চলে মাসের পর মাস। কিন্তু এটার সাথে আগ্রাসনের সম্পর্ক নাই। বেনিয়াবুদ্ধিসম্পন্ন ভারতীয়রা জানে কোথায় আগ্রাসন আর কোথায় করতে হবে বাণিজ্য।

আমরা পাশের দেশ। আয়তনে ছোট। জনসংখ্যা ও নানা বিচারে তারাই দাদা। কিন্তু দাদা অনুজকে কোন ভাগ দিতে রাজী না। আপনি কলকাতা যান প্রশ্ন করুন- কত বাঙালী বাংলাদেশের চ্যানেল দেখতে চায়? শুনে চমকে উঠবেন। এই চমকানোটা তারা বোঝেন তাই, সযত্নে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল আর প্রোগ্রামগুলো দূরে সরিয়ে রাখেন। এটা কি ন্যায়? আপনার বল বেশি, আপনি বড় বলে আমার মাথায় কাঁঠাল রেখে ভাঙ্গবেন আর আমি চুয়ে পড়া রসও খেতে পাবো না? এমন এক হাল, সন্ধ্যার পরপর বাংলাদেশের মানুষদের ফোনে পর্যন্ত পাই না। কেউ জি বাংলা, কেউ আনন্দ, কেউ ষ্টার প্লাস, কেউবা তারা টিভিতে মজে আছে। সময় নাই তাদের।

 

আগে নিজেদের সমালোচনা বা আত্মশুদ্ধির কথা বলি। আমরা এমন হাভাতে সংস্কৃতি পাগল কবে হলাম? এই দেশে নাই নাই করেও ষাট-সত্তর-আশি অবদি ভালো নাটক, ভালো গান, ভালো কবিতা বা ভালো কোন সৃষ্টির অভাব ছিল না। এখন আমরা কি দেখি? এক কবি আরেক কবির ভাত মারতে মাঠে নেমে পড়েছে। একজন নির্মলেন্দু গুণ শেষ কবে একটি চমৎকার মন জাগানিয়া কবিতে লিখেছেন? কবে আসাদ চৌধুরীর কবিতা মন ছুঁয়ে গেছে শেষবার? সবাই যার যার ধান্দায় ব্যস্ত। বলতে গেলে বিপদে পড়বেন। গুণদা তো আমাকে ইনবক্সে জানিয়েছেন আমার নাকি ৭১ ও ৭৫-এর আততায়ীদের প্রতি মনোভাব নরম। মানে আমিও মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ চেতনার বাইরের লোক। তা বটে। চেতনাধারীরা সব খেতে খেতে এখন সংস্কৃতিও নিঃশেষ করে এনেছেন।

সেই সুযোগে কলকাতা আর হিন্দীর দাপটে অবস্হা হয়ে উঠেছে ভয়াবহ। কেউ আপনাকে সুনীল, শীর্ষেন্দু বা সমরেশ পড়তে নিষেধ করছে না। জয় গোস্বামীও চালু থাক। আমরা শ্রীকান্ত, শ্রাবণী বা অরিন্দমের গান শুনবো। কিন্তু আমাদেরগুলোও শুনতে হবে। জানতে হবে একমাত্র বাংলা রাষ্ট্রে কী হচ্ছে? কী ভাবছে এখানকার সংস্কৃতি। সেটা কি তারা করেন? দুই-একজনকে একটু আধটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই কি লেনদেন বা আদান-প্রদান হয়ে যায়? আর আগ্রাসন বলছি কেন? কারণ বাংলা তো আপনাদের সিলেবাস থেকেই বাদ। আমাদের দেশে যেমন এক শ্রেণির মানুষ নাটকে ভাষা পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাষাদূষণ করছেন বা করা হচ্ছে তেমনি ওপার বাংলায় বাংলাকে করা হচ্ছে বলৎকার। গান নাটক কবিতা যা কিছু হয় সব কিছুতেই আধা বাংলা, আধা হিন্দী। এখন দেখি বেশিরভাগই হিন্দী দুই-একটা বাংলা বিষয় । একটি বাংলা গানের প্রতিযোগিতায় উঠতি গায়ক-গায়িকা হিন্দী গাইছে অথচ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলে বাদ। নজরুল, ডিএল রায় বা অতুলপ্রসাদের নাম জানে না কেউ। আগ্রাসনটা শুধু আমাদের বেলায়? আপনারা ভারতীয় কত ভাষা, কত বিচিত্র সংস্কৃতি আপনাদের। কই? আর কোন ভাষা তো নাই কেবল হিন্দীময় সবকিছু। আর এর চাপে আমাদের অবস্থা এখন করুণ।

ইংরেজি নামের এক আপদ আর হিন্দী নামের এক বিপদ আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মতো ঘাড়ে চেপে আছে। কোনটাই কিন্তু ভাষা বা তার নিজস্ব সৌন্দর্যে জায়গা নেয় না। ভালো ইংরেজি জানাটা অপরাধ না। হিন্দী বা উর্দু শেখাটাও মন্দ না। কিন্তু তাকে দখলদারিত্ব দিতে গিয়ে জগাখিচুড়ি আর বাণিজ্য করার কারণে আজ বাংলাদেশের সংস্কৃতির নাভিঃশ্বাস উঠছে। এভাবে চলতে থাকলে একটি বিকলাঙ্গ জাতি ছাড়া আমরা কিছুই হতে পারবো না। খেয়াল করবেন এর কুফলে সংস্কৃতি আজ চরম দুর্দিনের মুখোমুখি। ঐ বাংলার সস্তাতম হাসির অনুষ্ঠান মিরাক্কেলে জায়গা নিতে এক বাংলাদেশী যুবকের কৌতুক দেখেছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। আমাদের টাইগার তথা গর্বের ক্রিকেটকে এমন অপমান করা কৌতুক শুনে দাদাদের এবং  মীরের সেকি বিকট অট্টহাসি। আর আমরা সেটা দেখার জন্য ডিশ লাইনের বিল দিয়ে ঘরে টিভি খুলে বসে থাকি। আরো আছে। এসব প্রোগ্রামের অডিশন দেখি ঢাকা, চট্টগ্রামসহ নানা জেলায় হয় এখন। আর বাকী কী তবে? আমাদের চ্যানেলগুলো তাদের বিটিম বললেই ল্যাঠা চুকে যায়।

এরপরও দেশে আসলে যারা সংস্কৃতির অতন্দ্র প্রহরী সেই নাটকের দল, উদীচী, খেলাঘর, লালন ফকিরের গানের মানুষ হাছন রাজার দিওয়ানা বা রবীন্দ্র সংগীত ও নজরুল গাইয়েরা পাত্তা পায় না। কর্পোরেটের কালো থাবায় নকলবাজী আর ধার করা সংস্কৃতিই ঘরে ঘরে জনপ্রিয়। রাজনীতি যদি হাঁটু ভেঙ্গে দিয়ে থাকে তো সংস্কৃতির এই নকলবাজী ও আগ্রাসন কোমর বা মাজা ভেঙ্গে দিচ্ছে আমাদের। কৌশলে গোপনে অতীতের বন্ধু শত্রূ দুই দেশ বেশ জোশের সাথে তা করে যাচ্ছে। আমরা মাঝে মাঝে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করি আবার সে বেদনা বা দুঃখ ভুলতে তাদের টিভিতে আছড়ে পড়ি।

বিজয়ের মাসে এই পরাজয়ের কথা আর কতদিন লিখতে হবে আমাদের?

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়