ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বিরল রোগে আক্রান্ত শাহাদাত

অদিত্য রাসেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৭, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিরল রোগে আক্রান্ত শাহাদাত

পরিবারের সঙ্গে শাহাদাত

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি : সিরাজগঞ্জের তাঁত সমৃদ্ধ উপজেলা শাহজাদপুর। এই উপজেলার চরকাদাই গ্রামের শাহাদাত হোসেন (৫৩)। তিনি এক বিরল রোগে আক্রান্ত।

শাহাদাতের পরিবার বলছে, ১৩ বছর বয়সে একদিন খেলতে গিয়ে চোখের উপরে মার্বেলের আঘাত লাগে। কয়েকদিন পর সেখানে একটা গুটি ওঠে। এরপর থেকে পুরো শরীরে গুটি উঠতে শুরু করে। আস্তে আস্তে গত ৪০ বছরে শরীরের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে গুটিগুলো। এ কারণে এখন ঠিকমত চোখেও দেখতে পারেন না তিনি।

কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান এই রোগ বংশগত এবং এর নাম নিউরোফাইব্রোম্যাটোসিস (Neurofibromatosi)।

বর্তমানে শাহাদাতের মুখ বিকৃত হওয়ায় খেতে পারে না স্বাভাবিকভাবে। চলাচল করতে অনেক কষ্ট। আগে মাটি কেটে সংসার চালাতেন। এখন সেটাও পারেন না। বিভিন্ন সময় চিকিৎসা করলেও তিনি সুস্থ হননি। দুই মেয়েকে বিয়ে দিলেও এক ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন চলে তার। রোগটি থেকে মুক্তি পেতে চান দিনমজুর শাহাদাত।

মামুন বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার চালিয়ে এক লাখ চার হাজার ৮০০ টাকা সংগ্রহ করে জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার সিদ্দিকার মাধ্যমে গত ৭ ফেব্রুয়ারি শাহাদাতের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। আগামী ১ মার্চ উন্নত চিকিৎসার জন্য শাহাদাতকে ঢাকায় নেওয়া হবে।

বুদবুদের মত টিউমারে ৫৩ বছর বয়সী শাহাদাতের সারা শরীর ঢেকে রয়েছে। দীর্ঘ দিন এই রোগে ভুগতে ভুগতে এখন তিনি দৃষ্টি শক্তিও হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। তার শরীরের সম্পূর্ণ আবরণ জুড়ে টিউমার এতই গুরুতর যে, তিনি এখন শরীরের উপরের অর্ধেকে পোশাকে আবৃত করতে পারেন না। তার চেহারা দেখে যে কেউ ভয় পায়। এমনকি তার নিজের ১২ বছর বয়সী ছেলে আবদুল্লাহ তার দিকে তাকিয়ে দূরে সরে থাকে।



শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এতটা ব্যাথা নিয়ে বাস করা আমার জন্য খুব কঠিন। শরীর এবং ঘাড়ের ওপর চুলকানির সঙ্গে অনেক ভোগান্তি তো রয়েছেই। তার ওপর আমার শরীর ভারি অনুভব করি। যে কেউ আমাকে দেখে দূরে সরতে চেষ্টা করে। বাচ্চারা যখন আমাকে দেখে তারা শুধু ভূত বা দৈত্য বলে দৌড়ে পালায়। এই কারণে আমি খুব বেশি বাইরে বের হই না, শিশুরা আমাকে দেখলে ভয় পায়।’

শাহাদাত হোসেন আরো বলেন, ‘এক সময় আমার এ অবস্থা ছিল না, আমি আমার তরুণ বয়সে সুদর্শন ছিলাম। আজকাল আবদুল্লাহ (শাহাদাতের ছেলে) আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে না। আমি জানি, কেন সে এমন করে। আমি আমার ছেলে বা পরিবারের জন্য কিছুই করতে পারছি না। আমি খুব খারাপ বোধ করি, রাতে আমি চিন্তায় ঘুমাতে পারি না।’

শাহাদাত হোসেনের স্ত্রী তাজমহল খাতুন (৩৯) বলেন, তার মাথা থেকে শুরু হওয়া এ রোগের বিস্তার দিনে দিনে ভয়ঙ্কর হওয়ার পর্যায়গুলো দেখেছি। কিন্তু আর্থিক অভাবে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ আমরা। আমাদের করুণ অবস্থা দেখে গ্রামবাসী জামাকাপড় নিয়ে আসেন ও ছোট-খাট সাহায্যমূলক কাজকর্ম করেন। এর মাধ্যমে আমরা জীবিকা নির্বাহ করছি।

শাহাদাতের খবর পেয়ে মামুন বিশ্বাস চিকিৎসার জন্য পরিবারটির পক্ষে ফেসবুকে প্রচার চালিয়ে তহবিল সংগ্রহ করে যাচ্ছেন।

মামুন বিশ্বাস রাইজিংবিডিকে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম যদি আমাদের সহযোগিতা করেন তাহলে আশা করি সে সুস্থ একটা জীবন ফিরে পাবে। আমি সরকারের কাছে শাহাদাত হোসেনের যথাযথ চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি, যাতে তিনি একটি স্বাভাবিক জীবন ফিরে যেতে পারেন।

মামুন বিশ্বাসের ফেসবুকে পোস্ট দেখে জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার তাকে দেখতে যান এবং শাহাদাত হোসেনকে চিকিৎসার আর্থিক অনুদান দেন। একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ দেন তিনি। ইতিমধ্যেই শাহাদাত হোসেনের বাড়ি পরিদর্শন করেছেন জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা সিভিল সার্জন ডা. শেখ মো. মনজুর রহমান। পরিদর্শন শেষে শহীদ এম মনসুর আলী সরকারি মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ মনোয়ার আলীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেন। মেডিক্যাল বোর্ড তাকে উন্নত চিকিৎসার সুপারিশ করেছেন। বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. এম. আকরামুজ্জামান ও সার্জারি বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. আবু রায়হান।



সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জন যৌথ উদ্যোগে ঢাকায় নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউটে উন্নত চিকিৎসার জন্য রেফার্ড কাগজ শাহাদাতের পরিবারের হাতে দিয়েছেন। আগামী ১ মার্চে চিকিৎসার জন্য শাহাদাত হোসেনকে ঢাকায় নেওয়া হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. শেখ মো. মনজুর রহমান জানান, রোগটি কোনো অজানা রোগ নয়। এর সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এটি বিরল রোগের মধ্যে একটি। নিউরোফাইব্রোম্যাটোসিস বংশ গতভাবে হয়ে থাকলেও কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়।



রাইজিংবিডি/সিরাজগঞ্জ/২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/অদিত্য রাসেল/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়