ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিরাট হাটের বিষাক্ত গরুতে বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি

ডা. সজল আশফাক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ২৬ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিরাট হাটের বিষাক্ত গরুতে বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি

ডা. সজল আশফাক: কোরবানির ঈদ সামনে রেখে আমাদের দেশের খামারীরা গরু মোটাতাজাকরণের পরিকল্পনা নেয়। যদিও এজন্য স্বীকৃত স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু গরুকে দ্রুত মোটা, ওজনদার করার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই খামারীরা অনৈতিকভাবে স্টেরয়েডসহ বেশ কিছু হরমোন প্রয়োগ করে। বেশি ওজন মানেই বেশি মাংস; বেশি মাংস মানেই বেশি লাভ।  গবেষকরা বলছেন, হরমোন প্রয়োগে মোটা-তাজা করা এসব পশুর মাংস খেলে মানুষের ব্রেস্ট, কোলন, প্রোস্টেট এবং ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

গরু মোটাতাজাকরণ একটি নিয়মিত ও প্রচলিত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত দুই থেকে আড়াই কেজি ইউরিয়া, লালিগুড় ও খড়ের একটি বিশেষ ধরনের মিকশ্চার খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়ে থাকে সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগ। টানা ৮দিন কোনো পাত্রে এই মিকশ্চার মুখবন্ধ অবস্থায় রাখার পর, তা রোদে শুকিয়ে গরুকে খাওয়াতে হয়। একটানা ৬মাস এটা খাওয়ালে গরু খুব দ্রুত মোটাতাজা হয়ে ওঠে। কিন্তু আরো দ্রুত এবং আরো বেশি মোটা করার আশায় খামারীরা প্রয়োগ করে থাকে স্টেরয়েডসহ আরো কিছু হরমোন এবং মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া।

গরুকে কয়েকমাস ধরে ইউরিয়া খাওয়ালে গরু দ্রুত দানব আকৃতি ধারণ করে। কিন্তু ইতোমধ্যে গরুর শরীরের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিডনি, লিভার, ব্রেইন নষ্ট হয়ে গরুর মৃত্যু অনিবার্য করে তোলে। অতিরিক্ত ইউরিয়া বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে এগুলো প্রাকৃতিকভাবে বেঁচে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় হাটেই এইসব গরু মারা যায়। এই ধরনের গরু ‘বিষাক্ত গরু’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউরিয়ার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গরুর মাংস খেলে মানুষও ইউরিয়ার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। যার ফলে মূলত কিডনি বিকল হওয়ার মতো ঝুঁকি থাকে।

গরু মোটাতাজাকরণের ইতিহাস খুঁজলে অনেক আগে থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃত্রিমভাবে তৈরি হরমোন প্রয়োগ করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গরুর মাংসপেশিতে হরমোন ইনজেকশন দেয়া হয় কিংবা কানের চামড়ার নিচে পুঁতে দেয়া হয়। কানের চামড়ার নিচে পুঁতে দেয়া এই হরমোন ধীরে ধীরে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করে। কৃত্রিমভাবে তৈরি ইস্ট্রোজেন এবং টেস্টোস্টেরন ইনজেকশনই একসময় বেশি প্রয়োগ করা হতো।  ৭০ দশকের দিকে এই হরমোনে একটি উপাদান ডাইইথাইলস্টিলবেস্টেরল-এর সাথে যোনীপথের ক্যানসার সৃষ্টির যোগসূত্র ধরা পড়লে তা নিষিদ্ধ করা হয়। এদিকে ইস্ট্রোজেন-এর সাথে স্তন ক্যানসারের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পর এই হরমোনটির প্রয়োগও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

আরো বেশি নিরাপদ হরমোন খুঁজতে গিয়ে তৈরি হয় বোভাইন সোমাটোট্রপিন (বিএসটি) অথবা রিকম্বিনেন্ট বোভাইন গ্রোথ হরমোন (আরবিজিএইচ)। ১৯৯৩ সালে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) গরুর দুধ ও গরুর দৈহিক বৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য কৃত্রিমভাবে তৈরি এই হরমোনের প্রয়োগকে অনুমোদন দিলেও, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডাসহ বেশ কিছু দেশ অনুমোদন দেয়নি।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বে খাবার হিসেবে গ্রহণযোগ্য প্রাণীতে হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে ভোক্তারা সোচ্চার ও সচেতন ভূমিকা রাখছেন। অভিভাবকরা মনে করছেন, হরমোনযুক্ত মাংস গ্রহণের কারণে শিশুদের, বিশেষ করে কন্যাশিশুদের মধ্যে আগাম যৌবনপ্রাপ্তি ঘটছে। কিন্তু হরমোন প্রয়োগ করার পর কিছুটা হরমোন যে পশুর মাংসে উচ্ছিষ্ট হিসেবে রয়ে যায়, এই বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে কোনো মতভেদ না থাকলেও, উচ্ছিষ্ট হরমোনের কার্যকারিতা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞই।

খামারীদের পক্ষ অবলম্বনকারী গবেষকদের কথা হচ্ছে, গরুর দুধ ও মাংসে উচ্ছিষ্ট এই হরমোনের মাত্রা এতটাই কম যে, তা ভোক্তার দেহে কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না। আবার একইপক্ষের আরেকদল গবেষক বলছেন, উচ্ছিষ্ট অবস্থায় বিদ্যমান বোভাইন সোমাটোট্রপিন (বিএসটি) প্রকৃতপক্ষে একটি মৃত হরমোন, এর কোনো কার্যকারিতা থাকার কথা নয়। কিন্তু হরমোন নিয়ে এই বিতর্ক এখনো চলমান। কিছু  কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, হরমোনের এই ব্যবহার গরুর জন্যই ক্ষতিকর। এইসব হরমোন ব্যবহারে গরুর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশনের প্রবণতা বেড়ে যায়। ফলে গরুকে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের উচ্ছিষ্ট অংশ গরুর মাংসেও বিদ্যমান থাকে। এই ধরনের গরুর মাংস খাওয়ার কারণে উচ্ছিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে মানুষের শরীর উক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জনকারী (রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া) জীবাণুদ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। এই ধরনের রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিকে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সুস্থ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার প্রভাব তো রয়েছেই। স্টেরয়েড এবং গ্রোথ হরমোন শিশুর আগাম যৌবনপ্রাপ্তি ও মুটিয়ে যাওয়ার কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্টেরয়েড শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে। বেশ কিছু গবেষণায়, গরুর মাংসের উচ্ছিষ্ট হরমোনের সাথে মানুষের ব্রেস্ট, কোলন, প্রোস্টেট এবং ফুসফুসের ক্যানসার সৃষ্টির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

আমাদের দেশে গরু মোটা-তাজা করার বিজ্ঞানসম্মত ফর্মূলাকে উপেক্ষা করে কিছু অসাধু খামারী বেশি মুনাফার লোভে গরুর শরীরে ২৫ থেকে ৩০ আউন্স উচ্চমাত্রার স্টেরয়েড ইনজেকশন দিয়ে থাকে। ওরাডেকসন ও ডেকাসনের মতো স্টেরয়েড দিলে ২-৩ মাসের মধ্যেই গরুগুলো বিশাল আকৃতি ধারণ করে। গরুর শরীরে পানি জমতে থাকে। গরু ফুলে ফেঁপে বিশাল অস্বাভাবিক বেঢপ আকৃতির দানবে পরিণত হয়। প্রাণিবিদরা বলছেন, এ ধরনের গরু দেখলেই চেনা যায়। প্রাকৃতিকভাবে শক্তি সামর্থের কোনো গরু যেমন তেজি ও গোয়ার প্রকৃতির হয়, এই গরুগুলো ঠিক উল্টোভাব, ধীর ও শান্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে। শরীরে ও আচরণে কোনো তেজী ভাবই লক্ষ করা যায় না। এইসব হরমোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের দেশেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, রয়েছে শাস্তির বিধান। কিন্তু আইনের প্রয়োগ কতটুকু হবে সে বিষয়ে সন্দিহান জনগোষ্ঠীর উচিত হবে, বিশাল আকৃতির অস্বাভাবিক মোটা গরুর প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে স্বাভাবিক আকৃতি ও গঠনের গরুকেই কোরবানির জন্য বেছে নেয়া।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়