ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বিলুপ্তপ্রায় শহরে খুলছে পর্যটনের জানালা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিলুপ্তপ্রায় শহরে খুলছে পর্যটনের জানালা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম: এখানে এক সময় ছিল বাণিজ্যিক শহরের প্রাণকেন্দ্র। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত বণিকদের মিলনমেলা বসত এখানে। হ্যাজাক লাইটের আলোকসজ্জা, হাজার হাজার মানুষের পদচারণা, নানান ভাষার কণ্ঠধ্বনিতে গমগম করতো শহর। গল্পটি পানাম নগরীর। এখানে রয়েছে বায়ান্নজন বণিকের শৈল্পিক কারুকাজখচিত বায়ান্নটি বাড়ি। যদিও সেগুলো এখন জরাজীর্ণ।

ঢাকার অদূরে পানাম সিটি। মাত্র ২৭ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে নারায়ণগঞ্জের খুব কাছে। ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ে গড়ে উঠেছিল এই নগর। পানাম নগর পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক নগরের একটি। এটি বাংলার প্রাচীনতম শহর। এখানেই হতো বিখ্যাত মসলিনের জমজমাট বাণিজ্য। প্রাচীন সেই নগরীর তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই। এখন আছে শুধু ঘুরে দেখার মতো ঐতিহাসিক কিছু পুরনো বাড়ি- দর্শনার্থীরা এমনটাই জানালেন।

চট্টগ্রাম থেকে আসা দর্শনার্থী এবিএম রেজাউল করিম বলেন, পানাম সিটি অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন। এখানে এসে আমাদের সমৃদ্ধ অতীত সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তবে পুরনো বাড়িগুলো ছাড়া এখানে আর কোনো নিদর্শন চোখে পড়েনি। জায়গাটি আরো আকর্ষণীয় করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
 


ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড-২০০৬ সালে পানাম নগরকে বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় স্থান দেয়। ঈশা খাঁর আমলে বাংলার প্রথম রাজধানী ছিল পানাম নগর। সোনারগাঁয়ের ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে। পানাম নগরীর দুই ধারে ঔপনিবেশিক আমলের ৫২টি স্থাপনা রয়েছে। এর উত্তর দিকে রয়েছে ৩১টি এবং দক্ষিণ দিকে ২১টি স্থাপনা। স্থাপনাগুলোর স্থাপত্যে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সাথে মুঘল শিল্পরীতির মিশ্রণ চোখে পড়ে। পানাম নগরী নিখুঁত নকশার মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কূপসহ বসবাস উপযোগী নিদর্শন রয়েছে। নগরীর পানি সরবরাহের জন্য দুই পাশে খাল ও পুকুরের অবস্থান এখনও স্পষ্ট। এখানে আবাসিক ভবন ছাড়াও উপাসনালয়, গোসলখানা, পান্থশালা, দরবার কক্ষ ইত্যাদি রয়েছে। পানাম নগরের আশপাশে আরো কিছু স্থাপনা আছে যেমন- ছোট সর্দারবাড়ি, ঈশা খাঁর তোরণ, নীলকুঠি, বণিক বসতি, ঠাকুরবাড়ি, পানাম নগর সেতু ইত্যাদি।

পনেরো শতকে ঈশা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনাগাঁয়ে। ঈশা খাঁর যাতায়াত ছিল এই নগরীতে। সেই সময়ে অর্থাৎ সুলতানি আমলে বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেতো মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনা ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়ত বড় বড় পালতোলা নৌকা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এখানে ইংরেজরা নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র খুলে বসে। সেই সাথে মসলিনের বাজার দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য।
 


যেভাবে ধ্বংস হলো পানাম নগরী: ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় হিন্দু ব্যবসায়ীদের এই রাজকীয় বসতি স্বাভাবিকভাবেই ছিলো লুটেরাদের লক্ষ্যবস্তু। ঐ সময় লুটেরারা দরজা-জানালা পর্যন্ত লুটে নিয়ে যায়। যুদ্ধের সময় বহু হিন্দু ব্যবসায়ী ভারতে পাড়ি জমালে পানাম প্রায় জনমানবহীন হয়ে পড়ে। সেই শুরু, তারপর থেকে আর জেগে ওঠেনি পানাম। এরপর কিছু বাড়ি দখল হয়ে যায়, কিছু বাড়িতে বসতি গড়ার জন্য অনুমতি দেয় সরকার। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কিছু বাড়ি ইজারা দেয়া হয়। মূল বাসিন্দাদের অবর্তমানে বাড়িগুলো অযত্নে ক্ষয়ে যেতে থাকে। ফলে ২০০৪ সালে আর ইজারা নবায়ন করা হয়নি।

দখলদারদের একজন ইয়ানুছ মাঝি (৮৫)। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দুরা যখন ভারত পালিয়েছিল, তখন অনেক দখলদারের মতো ইয়ানুছ মাঝি পরিবার সমেত দখল করেন একটি বাড়ি। ৪০ বছর তিনি খুব আরামে বসবাসও করেছেন। ২০০৭ সালে অনেকের মতো তিনিও উচ্ছেদের শিকার হন। এখন তিনি পাশের খাগুটিয়া গ্রামে থাকেন। ইয়ানুছ মাঝির সাথে কথা হয় পানাম সিটিতে। তিনি স্মৃতিচারণ করলেন অনেক কথার। হাত তুলে দেখালেন যে বাড়ি দখল করে তিনি থেকেছেন এক সময়। বাড়ির কোন দিকে নদী ছিল, কোন পাশে ঘাট ছিল সবই বললেন তিনি। পানাম নগরের মূল প্রবেশ পথের ছোট্ট খালটির উপরে একটি সেতু ছিলো, যার কোনো অস্তিত্ব এখন অবশিষ্ট নেই। অযত্ন আর অবহেলায় পানাম নগরের বাড়িঘরগুলোতে শ্যাওলা ধরেছে, ভেতরের পরিবেশ স্যাঁতস্যাঁতে, গুমট। বাড়িগুলোর দেয়ালে গজাচ্ছে গাছপালা, অনেক বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেছে গাছের শিকড়। অনেক ঘরের চৌকাঠ ও রেলিং খুলে পড়েছে। ফলে বিভিন্ন সময় বাড়িগুলোর ছাদ ধ্বসে পড়ছে, ভেঙে পড়ছে সিঁড়ি ও দেয়াল। অনেক বাড়ির সিরামিক টাইল্‌সে ভাঙন ধরেছে, খিলানে ধরেছে মরিচা। কোনো কোনো বাড়ির কার্ণিশে গজিয়েছে আগাছা। এমনকি ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে দুটো বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বসেও পড়েছে।
 


জীর্ন হলেও অধিকাংশ বাড়ি শতাব্দীর পর শতাব্দী দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। একটি বাড়ির বিশাল নাচঘর এখনও টিকে আছে, যার চারদিকে একতলা ও দোতলায় দর্শকের বসার ব্যবস্থা আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী পানাম নগরের সৌন্দর্য অনেককে মুগ্ধ করেছে। বিভিন্ন শতকে পৃথিবীর বহু পর্যটক এসেছেন এই নগরে। পানাম নগর দেখে তারা মুগ্ধ হয়েছেন। কয়েক দশক বিরতির পর আবারও পর্যটক বান্ধব হয়ে উঠেছে ঐতিহাসিক বিলুপ্ত এই নগরী। ১৯৬৫ সালের পর থেকে ক্রমেই বেদখল হতে থাকা পানাম সিটি ২০০৬-০৭ সালে পুরোপুরি দখল উচ্ছেদ করেন সরকার। বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পানাম সিটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়, নির্ধারণ করে সীমানা প্রাচীর। ২০১৪ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয় পানাম সিটির উপর দিয়ে যাওয়া স্থানীয়দের যাতায়াতের রাস্তা। সিটির নিরাপত্তার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় ২০ সদস্যের আনসার টিমকে। ২০১৫ সালে টিকেট চালু করে দর্শনার্থীদের জন্য পানাম সিটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

পুরনো ঢাকার গৃহিণী খাদিজা আক্তার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে নুসরাতকে নিয়ে দেখতে এসেছিলেন পানাম সিটি। খাদিজা আক্তার জানান, মধ্য যুগে বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য যে কত সমৃদ্ধ ছিল তা দেখাতে মেয়েকে নিয়ে এসেছি। মেয়ে নুসরাত জানান, বইয়ে পানাম সিটির কথা পড়েছি। এখন সরাসরি দেখার সুযোগ পেলাম। সুদূর গ্রীস থেকে পানাম সিটি দেখতে এসছেন গের্ক (৪৫) ও লিলি (৩৭)। তারা জানালেন, পানাম নগরীর সৌন্দর্যে তারা মুগ্ধ হয়েছেন। ভিন্ন ধর্মের ভিন্ন সংস্কৃতির এই নগরে এসে তারা অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। পানাম নগরী দেখতে এসেছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক শবনম জান্নাত। তিনি বলেন, পানাম সিটির ভবনগুলো এমন চমৎকার নির্মাণশৈলীতে তৈরি, বিশ্বাসই হয় না এগুলো ৭০০ বছর আগে নির্মিত। তৎকালীন নির্মাণ শিল্পীরা যদি আধুনিক কালের প্রযুক্তিগত সুবিধা পেতেন তাহলে পৃথিবীতে বিখ্যাত অনেক কিছুই তারা করতে পারতেন। পানাম সিটিকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগের প্রশংসা করলেন তিনি। তবে তিনি জানালেন, পানাম সিটির সীমানা প্রাচীর তৈরি, তথ্য নির্দেশিকা ও ভবনগুলোর সামনে তথ্য প্রদর্শনী থাকলে আরও ভালো হতো।

পানাম সিটিতে টিকেট চালু করার পর থেকেই ইনচার্জের দায়িত্বে আছেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, জায়গাটি দেশের অন্যতম প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনগুলোর একটি। পানাম সিটিকে পর্যটন বান্ধব করার জন্য নানা উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। পরিকল্পনা আছে তথ্য নির্দেশিকাসহ বিলবোর্ড স্থাপন, ভবন সংস্কার, ভ্রমণ গাইড তৈরি ও পুলিশ ক্যাম্প করার।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়