ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে রেষারেষি না হোক

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫০, ১৬ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে রেষারেষি না হোক

জাফর সোহেল : নি:সন্দেহে বাঙালির জন্য এক মাসের রসালো প্যাকেজ হাজির হয়ে গেল। বলের ছোটাছুটি চলবে দূরদেশ রাশিয়ায়, মাতামাতির প্রতিযোগিতা চলবে এই দেশে। সেই প্রতিযোগিতায় কে নেই? ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ, কর্মী-কর্তা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চালক-সহকারি, ডাক্তার-রোগী, সচিবালয়ের কর্তা থেকে নিয়ে পোশাক কারখানার কর্মী কিংবা চা দোকানের মামাসহ  তাবৎ বাঙালি মেতে থাকবে ফুটবল উন্মাদনায়। খেলা শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার তবে বাঙালির উন্মাদনা শুরু হয়ে গেছে অন্তত একমাস মাস আগে থেকে।

ঢাকা নগরীর বিভিন্ন ভবনের ছাদে রঙ-বেরঙয়ের পতাকা উড়তে শুরু করেছে তখন থেকেই। পতাকা অবশ্য ঠিক বলা যাবে না, বলতে হবে পতাকার রংয়ের আদলে ভালোবাসার প্রতীক। এই ভালোবাসা অবশ্য আবার সংশ্লিষ্ট দেশের জন্য নয়, তাদের জাতির জন্য নয়, জনগণের জন্য নয়- এটা কেবলই তাদের ফুটবল দলের জন্য।

পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশনের খবরের সুবাদে বাঙালির এমন কিছু ভালোবাসার প্রকাশ দেখে আমরা রীতিমতো বিস্মিত। কেউ প্রিয় দলের ৫ কিলোমিটার লম্বা পতাকার আদল বানাচ্ছেন, কেউ পতাকা দিয়ে জামা বানিয়ে নিচ্ছেন, কেউ নিজের পুরো বাড়িটা নির্দিষ্ট পতাকার রঙে রাঙিয়ে নিচ্ছেন, কেউ ভোজ আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কেউ সমর্থক গোষ্ঠীর সংগঠন বানিয়ে নিয়েছেন, কেউ অলংকারের সঙ্গেও প্রিয় দলের পতাকার মিল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সব মিলিয়ে একটা হৈহৈ রৈরৈ ব্যাপার।

এটা যে এবারই এরকম, তা অবশ্য নয়। ৪ বছর পরপর এরকম উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া অর্থাৎ বাংলাদেশের সর্বত্র। তবে এবার যেন মাত্রাটা একটু বেশি। এর পেছনে অনেক কারণের একটি আমার কাছে বেশি যুতসই মনে হয় আর তা হল, ফেসবুকীয় ব্যাপার-স্যাপার।

বাঙালি আজকাল ফেসবুককে জীবনের এত ঘনিষ্ঠ কিছুতে রূপ দিয়েছে যে, বিশ্বকাপ ফুটবলের মহা আয়োজনের সময় তার চিরাচরিত আবেগ আর উন্মাদনা এই ডিজিটাল প্লাটফর্মে প্রকাশ না করে পারেই না। তা শুরু হয়ে গেছে এবং ভয়ংকর রকমের উত্তেজনা চলছে সেখানে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে। পোস্ট, পাল্টা পোস্ট আর কমেন্ট রিয়েকশানে সেখানে ঝড় চলছে। আমি নিশ্চিত এদেশের ফোন কোম্পানিগুলোর ৬ মাসের ডাটা এই এক মাসেই হজম করবে বাঙালি।

উন্মাদনার কেন্দ্রে আছে দুটি দলের সমর্থকরা। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা ওরফে ‘ব্রাজেন্টিনা’ হাঙ্গামা বঙ্গদেশে এতটাই বেশি যে, এবার এ নিয়ে রিপোর্ট করতে হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও। তারা বাঙালির ফুটবল উন্মাদনা মানেই যে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা বিষয়ক পাগলামি- এটাকে বেশ রসালো চিত্রণে উপস্থাপন করেছে। পাশাপাশি খোঁচাও দিয়েছে। আমাদের সমর্থকদের রুচিবোধ আর অপরিণত এবং উগ্র অাচরণেরও কিছু নমুনা তারা বিশ্বাবসীকে জানিয়ে দিয়েছে! কী লজ্জা, একবার ভাবুন তো! যেখানে আমাদের মানুষ এত কষ্ট করে, এত ত্যাগ স্বীকার করে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করছে, সেখানে কোথায় ক্রেডিট পাবে, উল্টো রসিকতা করা হচ্ছে! এর জন্য কে দায়ী, কারা দায়ী?

ব্রাজেন্টিনা বিষয়ে আমি নিজেও একটা আস্ত পাগল। ব্রাজিল আর্জেন্টিনা নিয়ে লোকের এই পাগলামি আমি বেশ রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করি এবং এবারও করছি। আমি অন্যদেরও বলি, আসুন, খেলাটা উপভোগ করি। তবে, অহেতুক উত্তেজনা যেন না ছড়াই। ব্রাজিল সমর্থক হোন আর আর্জেন্টিনা- আচরণে পরিমিতি বোধের পরিচয় দেয়া উচিত। আপনার দল জিতলে অনেক খুশি যেমন হবেন তেমনি হারলে অনেক দু:খ পাবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে একই অনুভূতি কিন্তু অন্য দলের সমর্থকের বেলায়ও থাকে। প্রিয় দলের পরাজয়ে সবারই খারাপ লাগে, সেই খারাপ সময়ে আপনাকে যদি আরো খারাপ কিছু কেউ শোনায়, তির্যক মন্তব্য করে কিংবা গালমন্দ করে তখন আপনার কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না, মন চাইবে অতি আক্রমণাত্মক কিছু করে বসতে। সবার ক্ষেত্রেই একই ব্যাপার হবে। সুতরাং কারো প্রতি বিরূপ আচরণ থেকে দুরে থাকুন, তাহলে নিজেও ভাল থাকবেন, আরেকজনও ভাল থাকবে। আর ফুটবল তো একটা খেলা, এটা নিয়ে নিজেদের পরিচিত মানুষজনের মনে কষ্ট দেয়ার কি কোন দরকার আছে? আমরা যাদের জন্য এত ফাইট করি, তারা দেখবেন খেলা শেষে ঠিকই হাত মেলাচ্ছে, জয়ী দলকে অভিনন্দন জানাচ্ছে বিজিত দল। আর বিজয়ী দল বিজিত দলকে আগামীর জন্য শুভকামনা জানাচ্ছে! এটাই যে কোন খেলার মূল চেতনা, সৌন্দর্য। ফুটবল একটা সুন্দর খেলা, নান্দনিক খেলা।

আর আমরা কী করি? আমরা এই সুন্দরের উৎসবটাকে নোংরা বানানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই। আমরা খেলার মাঠের বিষয়গুলো নিয়ে এমন সব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিতে থাকি যা দৃষ্টিকটু এবং শুনতেও ভাল লাগে না। পত্রিকায় খবর হয়েছে, নারায়ণগঞ্জে নাকি বিশ্বকাপ শুরুর এক সপ্তাহ আগেই ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনাকে সাপোর্ট করা নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে কয়েকজনকে। এটা কী ধরনের আচরণ? প্রকৃত ক্রিড়াপ্রেমীরা কখনোই এমন হিংস্র আচরণ করতে পারেন না। খেলাধুলা মানেই উৎসবের উপলক্ষ। এটা উপভোগের বিষয়, এখানে পারষ্পরিক রেষারেষি কী করে আসে? আমরা যার যার সমর্থিত দল নিয়ে মাতামাতি করতেই পারি, ১০-২০টা পতাকা বাড়ির ছাদে লাগাতেই পারি, নিজে সারাদিন প্রিয় দলের জার্সি গায়ে বসে থাকতে পারি, একই দলের সমর্থকদের দল বেঁধে খাওয়াতে পারি; কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা যেন এটা চিন্তা করি যে, আমি যেমন ব্রাজিলের জন্য পাগল, তেমনি আমার প্রতিবেশী একইভাবে আর্জেন্টিনার জন্য দিওয়ানা হতেই পারে। এতে তাকে বাঁকা চোখে দেখা বা তিরষ্কার করার তো কিছু নেই।

ব্রাজিল আর্জেন্টিনা দুদলই চমৎকার ফুটবল খেলে। তাদের ফুটবলাররা পৃথিবীর সেরা ফুটবলারদের তালিকায় আছে। বিশ্বের সেরা সেরা ক্লাবে তারা খেলে। কেউ কারো থেকে কম নয়। মেসি যেমন সেরা ফুটবলারদের একজন, তেমনি নেইমারও বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম সেরা হওয়ার দৌড়ে আছে। পর্তুগালের রোনালদো তো মেসির সঙ্গে সমান তালে সেরার লড়াইয়ে আছেন। আমরা নিজেদের পছন্দের জয়গান গাইতে গিয়ে এসব বিশ্বসেরা ফুটবলারদের এত নোংরা ভাষায় নিন্দা ও সমালোচনা করি যে, মনে হয় এরা বুঝি খেলাই পারে না! কিংবা অমুক প্লেয়ার বুঝি একটা আস্ত বজ্জাৎ! কারো কারো চরিত্র নিয়ে এবং বর্ণ নিয়ে এত ফালতু মন্তব্য আসে যে সেটি কোন ভদ্রলোক উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারবেন না। যেমন ব্রাজিল সমর্থকরা মেসিকে ‘মাছি’ ‘প্রতিবন্ধী’ ইত্যাদি বলে নিন্দা করেন। একজন গ্রেট প্লেয়ারের সমালোচনা এভাবে করা কতটা সমীচীন? আশ্চর্য আমাদের বিচার-বিবেচনা বোধ!

এতটা রেষরেষির কি খুব দরকার আছে? আসুন, ফুটবলটা উপভোগ করি। শেষপর্যন্ত এটা তো একটা খেলা, এখানে আবেগের সবটুকু যদি ঢেলে দেন, জীবনের জন্য আর কী রাখবেন? বিশ্বকাপ ফুটবলের বাইরেও তো আমাদের সবার সঙ্গে সবার একটা সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্ক রক্ষা করার দায়ও আছে। শুধু শুধু কেন খেলার মতো একটা স্বল্পমেয়াদি মোহের কাছে সব ধরনের সম্পর্ককে হার মানাবেন? ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, ব্রাজিল আর্জেন্টিনার এই সমর্থনগত উন্মাদনা। তবে, তখন এতটা খারাপভাবে পরষ্পরকে আক্রমণ করতে দেখিনি। কারও দল জিতলে উচ্ছ্বাস দেখেছি, হারলে প্রতিপক্ষের সমবেদনাও দেখেছি। এখন আর সে অবস্থা নেই। এখন মনে হচ্ছে, মাঠের খেলা বাদ দিয়ে বরং সমর্থনের প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতায় কে কত বড় হবে, কে কত অন্যকে পচাতে পারবে, লজ্জা দিতে পারবে- এসব নিয়েই সবার যত চিন্তা। আরে ভাই, ভালোবাসার প্রকাশটা ভালোকিছু দিয়ে ভালোভাবেও তো হতে পারে। ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে চারপাশে তিক্ততা ছড়িয়ে দিয়ে কী লাভ? পত্রিকায় এসেছে, ব্রাজিলের ৬০ শতাংশ মানুষই তাদের খেলা নিয়ে এতবেশি খোঁজখবর রাখে না। অথচ আমরা এখানে একে অপরের জান নেয়ার জন্য প্রস্তত! এ কেমন সমর্থক আমরা?

আসুন, আনন্দ আর উৎসবের আবেশে খেলা দেখি। উগ্রতা উন্মত্ততা না দেখাই। তাহলে সবাই মিলে বিশ্বকাপটা উপভোগ করতে পারবো। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দুদলের জন্য এবং দুদলের সমর্থকদের জন্যই শুভ কামনা। জয় হোক ফুটবলের।

লেখক: সাংবাদিক, আরটিভি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
       

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জুন ২০১৮/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়