ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বিশ্বাস এখন বাড়ির দরজায়

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৫, ২০ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বাস এখন বাড়ির দরজায়

তেল বিক্রি করছেন রাজ্জাক আর ঘানিতে সরিষা দিয়ে অপেক্ষায় আছেন জুয়েল

শাহেদ হোসেন : ইট-কাঠ-পাথরের এই নগরীতে একটু দূর থেকে দেখলে এটিকে অনেকেরই ছোটখাটো ইটভাঙার মেশিন বলে বিভ্রম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে কৌতুহলী হয়ে একটু কাছে গেলেই বিভ্রম কেটে যাবে। মেশিনের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন প্রাতঃভ্রমণ শেষে ঘরমুখী জনাদশেক নারী-পুরুষ। এদের প্রায় সবার হাতেই বোতল।

ভীড় ঠেলে উঁকি দিলেই দেখা যাবে এক তরুণ লোকজনের কাছ থেকে বোতল নিয়ে সরিষার তেল মেপে দিচ্ছেন আর অপরজন টাকা গুণে নিচ্ছেন। পাশেই মেশিনের ভট ভট শব্দের সাথে তেলের ঘানি চলছে। এক তরুণ সবার চোখের সামনে ঘানির চোঙায় সরিষা দানা ঢেলে দিচ্ছেন আর তা মুহূর্তের মধ্যেই যাতায় পিশে ঘানির নাক দিকে খাঁটি সরিষার তেল বের হয়ে নিচে রাখা বালতিতে জমা হচ্ছে।

পণ্য ভেজাল করার এন্তার অভিযোগের এই যুগে শতভাগ খাঁটির বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা অহরহই ঘটছে। তাই ‘খাঁটি’ শব্দটির ওপর আস্থা রাখা এখন মুশকিলই বলা যায়। পাবনার তিন তরুণ রুহুল, রাজ্জাক আর জুয়েল সেই খাঁটি পণ্যের ওপর আস্থা ফেরাতেই এখন ‘বিশ্বাস’ ফেরি করছেন রাজধানীতে। মেশিন নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ক্রেতার চোখের সামনে সরিষা, তিল ও কালোজিরা ভাঙিয়ে তার তেল বিক্রি করছেন তারা।

গত সপ্তাহে রাজধানীর সবুজবাগ থানার অধীন মানিকনগর এলাকায় চোখের সামনে মেশিনে সরিষা ভাঙিয়ে তেল বিক্রি করছিলেন রুহুল, রাজ্জাক ও জুয়েল। বেলা উঠে যাওয়ায় তাদের বিক্রি পর্বও তখন প্রায় শেষের দিকে। কাজের ফাঁকে রুহুল জানান, বছর দুয়েক হলো তারা তিনজনে এই ব্যবসা শুরু করেছেন। তিনজনের বাড়িই পাবনার ভাঙ্গুরা থানায়। রুহুল ও রাজ্জাকের বাড়ি নূরনগর গ্রামে আর পাশের শাহনগর গ্রামে জুয়েলের বাড়ি।

ব্যবসা শুরুর গল্পটি জানতে চাইলে রুহুল বলেন, ‘আমি ও রাজ্জাক দুবাইয়ে নির্মাণ খাতে কাজ করতাম। সেখানে ছিলাম প্রায় সাত বছর। তিন বছর আগে দেশে ফিরি। পারিবারিক ও অর্থণৈতিক কারণে আর বিদেশ যাওয়ার সুযোগ ছিল না আমাদের। ওই সময় আমরা দুজন চাকরির আশায় ঢাকায় আসি। একদিন দুজনেই ক্যান্টনেমেন্ট এলাকা দিয়ে হেঁটে ফিরছিলাম। হঠাৎ করে আমাদের চোখে পড়ে এক লোক মেশিনে ভাঙিয়ে তেল বিক্রি করছে। সেই দোকানের সামনে ভীড়ও দেখলাম অনেক। তখন আমরা বিভিন্ন এলাকায় মেশিন নিয়ে গিয়ে ক্রেতার চোখের সামনে সরিষা ভাঙিয়ে তেল বিক্রি করার পরিকল্পনা করি। এরপর আমরা দুজন পাবনা চলে যাই। শাহনগরে জুয়েলদের সরিষার তেল ভাঙার দোকান ছিল। আমি আর রাজ্জাক সেখানে গিয়ে জুয়েলের কাছে মেশিনটি কিনতে চাইলাম। মেশিন নিয়ে কী করবো, কোথায় বসাবো, জানতে চাইলে আমরা জুয়েলকে আমাদের পরিকল্পনার কথা বলি। সব শুনে জুয়েল ব্যবসায় অংশীদার হিসেবে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করলে আমরাও রাজী হয়ে যাই। এরপর আর কয়েকদিন গ্রামে ছিলাম। ট্রাকে করে ৩/৪ মন সরিষা আর মেশিন নিয়ে সোজা চলে আসি ঢাকার ধোলাইপাড়ের গীত-সংগীত সিনেমা হলের কাছে একটি গ্যারেজে।’

হুট করেই এলেন নাকি আগে থেকে গ্যারেজের কারো সঙ্গে পরিচয় ছিল জানতে চাইলে জুয়েল বলেন, ‘ওই এলাকায় আমাদের গ্রামের এক লোক কাজ করতেন। আমরা ঢাকায় থাকতেই তার সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ করেছিলাম। পরে সব কিছু চূড়ান্ত হলে তাকে ফোনে মেশিন আনার বিষয়টি জানিয়ে দেই। উনিই আমাদের জন্য গ্যারেজটি ভাড়া করে দিয়েছিলেন।

 

তেল ভাঙ্গার মেশিন

অনেকটা ইট ভাঙার মেশিনের মতো দেখতে এই যন্ত্রটি রাস্তায় নামাতে প্রথমে একটু শঙ্কাতেই ছিলেন তিন তরুণ। না জানি কী হয়? তেল বিক্রি হবে তো? তবে বুকে সাহস বেধেছিলেন তিনজনই। কারণ, জমানো অর্থের প্রায় পুরোটা নিয়েই রাস্তায় নামা। হেরে গেলে তো সব শেষ!
প্রথম দিনে তিনজনের ভাগ্য অবশ্য একেবারেই অপ্রসন্ন ছিল না। কোনো ঝামেলা ছাড়াই কয়েক কেজি তেল বিক্রি হয়েছে। তবে হতাশ হননি রুহুলরা। পরের দিন অন্য জায়গায় নিয়ে গেছেন মেশিন। তারপরের দিন আরেক জায়গায়। প্রতিদিন নতুন নতুন জায়গা খুঁজে বের করেছেন। দিনে দিনে বিক্রি আর পরিচিতি দুটোই বেড়েছে। এখন প্রতিদিন ২/৩ মন সরিষা ভাঙা হয়। প্রতি কেজি সরিষার তেল তারা বিক্রি করেন ২০০ টাকা দরে। দোকানের চেয়ে বেশি দাম হলেও চোখের সামনে ভাঙাতে দেখে অতটুকু বাড়তি দাম দিতে দ্বিধা করেন না ক্রেতারা। কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় ১০ হাজার টাকা বেতনে একজন সহকারীও রাখা হয়েছে। প্রতি মাসে এখন ট্রাকে করে গ্রাম থেকে ৭০/৮০ মন সরিষা নিয়ে আসতে হয়।

রুহুল জানান, বিক্রির জন্য তারা প্রতিদিন একই জায়গায় বসেন না। পরের দিন কোথায় কোথায় যাবেন সেটা আগের রাতেই তিনজন মিলে ঠিক করে নেন। ফজরে নামাজের পর চলে যান নির্ধারিত সেই গন্তব্যে। বেলা ওঠা পর্যন্ত সেখানে বিক্রি-বাট্টা চলে। পরে আবার সেখান থেকে চলে যান আরেক জায়গায়।

মাসের শেষে কেমন লাভ থাকে? জানতে চাইলে রাজ্জাক এগিয়ে আসেন। তিনি জানান, প্রতি মাসে একেকজনের ভাগে ১৪/১৫ হাজার টাকা লাভ পড়ে। লাভের একটি বড় অংশ আসে সরিষার খৈল থেকে। মূলত: মাছের খামারিরাই প্রতি কেজি ৩০/৩২ টাকা দরে এটা কিনে নেন। আবার যারা বাসার ছাদে বাগান করেন, তারাও গাছের গোড়ায় দেয়ার জন্য খৈল কিনে নিয়ে যান।

রাজ্জাক যে ইতিমধ্যে নানা হয়ে গেছেন সেটা কিন্তু তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। ১৭ বছর বয়সে বিয়ে করে সংসারের হাল ধরেছেন। গত বছর বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তাও সেই ১৭ বছর বয়সে। পরের ছেলেটি একটি মাদ্রাসায় হেফজ পড়ছে, তার পরের জন চতুর্থ শ্রেণিতে আর কনিষ্ঠ মেয়েটি পড়ছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। রহুল তিন বছর আগে বিয়ে করেছেন। এখানে সংসারে নতুন অতিথি আসেনি। আর জুয়েল? এখনো অবিবাহিত। বোনের সংসার হওয়ার পর নিজেকে নিয়ে ভাবতে চান তিনি।

 

বাম দিক থেকে রাজ্জাক, রুহুল, জুয়েল ও তাদের সহকারী

তিন তরুণের সঙ্গে কথা বলার সময় কয়েকজন ক্রেতা চলে এলেন। এদেরই একজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গাড়ি চালক মিজান জানালেন, এই নিয়ে তিনি দ্বিতীয়বার এখানে তেল কিনতে এলেন। খরচ একটু বেশি হলেও সয়াবিনের পরিবর্তে রান্নায় তিনি এখান থেকে কেনা সরিষার তেল ব্যবহার করেন। চোখের সামনে সরিষা ভাঙানো দেখার পর অন্য কোথাও থেকে তিনি আর সরিষার তেল কেনেন না।

দেলোয়ার হোসেন নামের এক প্রবীণ বলেন, ‘বাসায় ছোট দুটি নাতনি রয়েছে। প্রায়ই ওদের সর্দির সমস্যা হয়। খাঁটি সরিষার তেল সর্দির জন্য বেশ উপকারী। নামি-দামি কোম্পানির নামে বিক্রি করা বোতলজাত সরিষার তেল শুধু নামেই খাঁটি। সকালে প্রাতঃভ্রমণ শেষে বাসায় ফেরার সময় দাঁড়িয়ে থেকে ওদের কাছ থেকে তেল নিয়ে যাই।’

বেলা তখন দুপুরের দিকে। রুহুল-রাজ্জাকরা সেদিনের মতো এই স্থানের বেচাকেনা শেষ করেছেন। এখন মেশিন নিয়ে অন্য জায়গায় ছুটতে হবে। গোছগাছ প্রায় শেষ। এরই মধ্যে রুহুল অভিযোগ করে বললেন, ভাই কোথাও কোথাও বসতে গেলে স্থানীয় মাস্তানদের দু’একশ করে টাকা দিতে হয়। রাস্তায় কখনো কখনো চাঁদাবাজির শিকার হতে হয়। বলে কয়েও ছাড় মেলে না।’

তবে এতো কিছুর পরেও হতাশ নন পাবনার এই অসম বয়সী তিন তরুণ উদ্যোক্তা। তারা এখন ব্যবসার পরিধি বাড়াতে চাইছেন। সরিষা, তিল আর কালোজিরার তেল বিক্রির মধ্যে তারা সীমাবদ্ধ থাকতে চান না। পাবনায় হাঁস-মুরগির ডিমের উৎপাদন ভাল। আগামীতে তেলের পাশাপাশি পাবনা থেকে ডিম আর খাঁটি গাওয়া ঘি এনে বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জানুয়ারি ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়