ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বুদ্ধিজীবীদের নামে বিভিন্ন স্থাপনা ও সড়ক বিস্মৃতির পথে

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বুদ্ধিজীবীদের নামে বিভিন্ন স্থাপনা ও সড়ক বিস্মৃতির পথে

‘শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক’ নামটি বাংলাদেশ পুলিশের সাইনবোর্ডেও নেই

হাসান মাহামুদ : একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি এবং তাদের এদেশীয় দোসররা বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্তে বাছাই করে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। তাদের স্মরণে বিভিন্ন সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু স্থাপনা ও সড়কের নামকরণ করা হয়। কিন্তু প্রচারণার অভাবে সেসব নামকরণ থেকে গেলেও সাধারণ মানুষ সেগুলো যেন ভুলেই বসে আছে। সরকারি দলিলপত্রে সেসব নাম ব্যবহার করা হলেও বাস্তবজীবনে তাদের ব্যবহার নেই বললেই চলে।

জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান হিসেবে আখ্যা পাওয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামকরণে বিভিন্ন স্থাপনা ও সড়কের বর্তমান অবস্থা সর্ম্পকে অনুসন্ধানে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। এই অবস্থায় যথাযোগ্য মর্যাদায় আজ সারা দেশে পালিত হচ্ছে ‘৪৬তম শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) থেকে শহীদ মিনারের দিককার সড়কটির নামকরণ করা হয়েছিল প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর নামানুসারে ‘শহীদ মুনীর চৌধুরী সড়ক’। কিন্তু এ বিষয়ে কখনোই কোনো রকম প্রচারণা চালানো হয়নি। এমনকি এই সড়কের আশপাশে বড় কোনো অফিস বা কার্যালয় না থাকায় সড়কটির নাম উচ্চারিতও হয় কম। ফলে এই সড়কের নামটি জানেনই না অনেকে। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, এই সড়কের কোনো অংশে সড়কটির নামফলক নেই। কোনো ভবনের সাইনবোর্ডেও সড়কটির নাম উল্লেখ নেই।

রাজধানীর মগবাজার থেকে মালিবাগ মোড় পর্যন্ত সড়কের সরকারি নাম ‘শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক’। এই সড়কের নামটি মোটামুটি পরিচিত। কিন্তু পুরো সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন সাইনবোর্ডের দিকে তাকালে আসল দৈন্যদশাটি লক্ষ্য করা যায়। রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এই সড়কের দুই পাশের দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে সড়কের নামের স্থানে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক কথাটি নেই। দুয়েকটি দোকানের সাইনবোর্ডে সড়কটির নাম থাকলেও তা ব্রাকেটবন্দিতে রাখতে দেখা গেছে।

‘শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক’ এর পরিবর্তে এসব সাইনবোর্ডে রয়েছে ‘নিউ সার্কুলার রোড’ এবং ‘আউটার সার্কুলার রোড’।
 


প্রসঙ্গত, মগবাজার থেকে মৌচাকগামী সড়কের আগের নাম ছিল ‘নিউ সার্কুলার রোড’ আর মৌচাক থেকে মগবাজারগামী সড়কের নাম ছিল ‘আউটার সার্কুলার রোড’। এই দুটো পরিবর্তন করে পুরো মগবাজার-মৌচাক সড়কটির নামকরণ করা হয় ‘শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক’।

সরেজমিন ঘুরে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কের দুই পাশের বেশিরভাগ দোকান বা স্থাপনার ঠিকানায় দুটি নাম পাওয়া গেছে। মগবাজার থেকে মৌচাকগামী সড়কের আগের নাম ‘নিউ সার্কুলার রোড’ আর মৌচাক থেকে মগবাজারগামী সড়কের নাম ‘আউটার সার্কুলার রোড’।

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কের মগবাজার থেকে মৌচাকগামী অংশে পুলিশের রমনা জোনের উপপুলিশ কমিশনার কার্যালয় অবস্থিত। খোদ উপপুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের সাইনবোর্ডে ঠিকানার স্থানে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কের পরিবর্তে ‘নিউ সার্কুলার রোড’ লেখা রয়েছে। প্রসঙ্গত, এই সাইনবোর্ডে ঠিকানার স্থানে আগেও ‘নিউ সার্কুলার রোড’ লেখা ছিল। এখনো সেই নামই রয়ে গেছে।

১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বর নিহত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েকটি ভবনের নামও বুদ্ধিজীবীদের নামে নামকরণ করা হয়। কিন্তু ওসব নামও কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। কিন্তু আগের নামেই সেসব ভবন এখনো পরিচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষকদের টাওয়ার ভবনের নামকরণ করা হয় ‘এএনএম মুনীরুজ্জামান ভবন’। কিন্তু এই নামটি কখনো উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে পাঠকক্ষটির নামকরণ করা হয় শহীদ সাংবাদিক চিশতি শাহ হেলালুর রহমানের নামে। কিন্তু এখনো সেটি ‘এক্সটেনশন রিডিং রুম’ নামেই পরিচিত। ওই হলের মিলনায়তনের নামকরণ করা হয় শহীদ শিক্ষক আবুল খায়েরের নামে। কিন্তু সেটি এখনো ‘হল অডিটোরিয়াম’ নামে পরিচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে তিনটি ভবন ছিল। পরবর্তীকালে আরো একটি ভবন নির্মাণ হয়। এই হলের চারটি হলের মধ্যে দুটো হলের নাম ছিল যথাক্রমে ‘দক্ষিণ বাড়ি’ ও ‘উত্তর বাড়ি’। এই দুটো ভবনের নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে ‘জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ভবন’ এবং ‘গোবিন্দচন্দ্র দেব ভবন’ নামকরণ করা হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনো এই দুটো ভবন ‘দক্ষিণ বাড়ি’ ও ‘উত্তর বাড়ি’ নামেই পরিচিত। জগন্নাথ হলের বাকি দুটো ভবন হচ্ছে- অক্টোবর স্মৃতি ভবন এবং জোতির্ময় গুহঠাকুরতা ভবন। এ ছাড়া ‘নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ভবন’ নির্মাণাধীন রয়েছে।

প্রসঙ্গত, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষক ছিলেন এবং তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী। আর গোবিন্দচন্দ্র দেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনবিদ্যার একজন অধ্যাপক ছিলেন। তিনি জি সি দেব নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনিও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী।

টাওয়ার ভবনসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের নাম শহীদ শিক্ষকদের নামে করায় কর্তৃপক্ষকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির ধন্যবাদ জানানো হয়। একইসঙ্গে এসব ভবনকে নতুন নামে ডাকার জন্য সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদও দেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো রকম প্রচারণাও হয়নি বলে জানা গেছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পাকিস্তানিদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন থেকে বুঝা যায়, এসব বুদ্ধিজীবী আমাদের জাতির জন্য কতটা প্রয়োজনীয় ও জরুরি ছিল। তাদের কোনো বিষয়ে সম্মানিত করা হলে, তা জাতি হিসেবে আমাদেরও সম্মান জানানো জাতীয় দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আর এতেই আমাদের জাতীয় চেতনা প্রকাশ পায়।’

 

আরো পড়ুন : 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়