ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বৃক্ষশিশু রিপনের খোঁজ কেউ রাখে না!

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৃক্ষশিশু রিপনের খোঁজ কেউ রাখে না!

রিপন রায়, ছবি : আমিনুর রহমান হৃদয়

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : জন্ম তার অন্য দশজন স্বাভাবিক শিশুর মতোই। কিন্তু তিন মাস বয়সে তার হাত-পা কালো হয়ে যায়। দেখা দেয় গুটি বসন্তের মতো আচিঁল। হাত পায়ের কালো আচিঁলগুলো এক সময় গাছের শেকড়ের মতো রুপ নেয়। যত দিন যায় তত শেকড় বাড়তে থাকে। বলছিলাম বৃক্ষশিশু রিপন রায়ের কথা।

রিপন রায়ের (৯) বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার কেটগাঁও গ্রামে। রিপনের বাবা মাহেন্দ্র দাস জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন। মা গোলাপী রানী দাস গৃহিণী। পরিবারের তিন ভাই বোনের মধ্য রিপন সবার ছোট। সে বর্তমানে কেটগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণীর শিক্ষার্থী।

রিপনের মা গোলাপী রানী জানান, এই আজব রোগ দেখা দিলে, তারা রিপনকে গ্রামের এক কবিরাজের কাছে নিয়ে যান। কবিরাজ বলেন ‘রিপনকে চোরা চুন্নি (ভূত-পেত) ধরেছে।’ কবিরাজ বিশেষ তেল ব্যবহার করতে বলেন, এতে রিপনের হাতে পায়ে গুটি উঠার প্রবণতা আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায়। রিপনের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। ভয় পেয়ে যায় বৃক্ষশিশুর পরিবার।

পাড়া প্রতিবেশী স্কুলের সহপাঠীরা রিপনের সঙ্গে বিরুপ আচরণ শুরু করে। অজানা রোগ সংক্রমণের ভয়ে শিক্ষকেরা রিপনকে আলাদা ব্যাঞ্চে বসাতো। শিক্ষকেরা বলতো ‘তুমি দূরে বসবা, অন্য বাচ্চাদের ধরবা না।’ প্রতিবেশীরা তাদের ছেলে মেয়েদের রিপনের সঙ্গে মিশতে দিতো না। স্কুলের বন্ধুরা তাকে খেলায় নিতো না।

বৃক্ষশিশু রিপনের অবস্থা আরো ভয়াবহ খারাপ হতে থাকে। হাত-পা ফেটে রক্ত বের হয়। হাত দিয়ে সে কিছু ধরতে পারে না, খেতে পারে না। এ সময় স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
 


পাঁচ বছর বয়সে রিপনকে প্রথম পীরগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে যায় তার পরিবার। কিন্তু এই আজব রোগের চিকিৎসা দিতে পারেনি ডাক্তারেরা। এরপর একে একে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর হাসপাতালে। কোথাও কোনো সমাধান নেই, দিশেহারা বৃক্ষশিশু রিপনের পরিবার। এদিকে রিপনের জন্য দৌড়াদৌড়িতে দরিদ্র পরিবার পড়েন কঠিন অর্থ সংকটে। স্বামীর পাশাপাশি অর্থ যোগাতে ক্ষেতে খামারে কাজ শুরু করেন গোলাপী রানী দাস।

বৃক্ষশিশু রিপনের খোঁজ পায় হ্যালোবিডিনিউজের স্থানীয় শিশু সাংবাদিক আমিনুর রহমান হৃদয়। তিনিই প্রথম ২০১৬ সালে রিপনকে নিয়ে সংবাদ করেন। পরে বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজরে আসে। খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশের সবগুলো পত্রিকা থেকে শুরু করে বিবিসি, সিএনএন পর্যন্ত। রিপনের খবর ভাইরাল হয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। এগিয়ে আসে অনেকেই। ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় রিপনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়।

বৃক্ষশিশু রিপন এক বছর তিন মাস ধরে রয়েছে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের ৬১৮ নম্বর বেডে। হিন্দু ধর্মের বড় ধর্মীয় উৎসব দূর্গা পূজো রিপনকে কাটাতে হচ্ছে হাসপাতালের বেডে শুয়ে।

ইতিমধ্যে রিপনের হাতে পায়ে দুই বার সফল অপারেশন করা হয়েছে। অবস্থার বেশ উন্নতিও হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছে পুরোপুরি সুস্থ হতে রিপনকে আরো কয়েকবার অপারেশন করতে হবে।


রিপনের মা গোলাপী রানী অভিযোগ করেন, প্রথম দিকে সবাই রিপনের খোঁজ নিলেও, এখন আর রিপনের খোঁজ কেউ রাখে না। সরকারি খরচে চিকিৎসা চললেও, ওষুধ পথ্য কিনতে পড়তে হচ্ছে তীব্র অর্থ সংকটে।

বর্তমানের বৃক্ষশিশু রিমন ঢাকা মেডিক্যালে ডা. রোমানা পারভীনের (রেসিডেন্ট, এম. এস প্লাস্টিক সার্জারি) অধীনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ডা. রোমানা পারভীন রাইজিংবিডিকে বলেন, বৃক্ষশিশু রিপন ‘এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ (epidermodysplasia verruciformis) নামের বিরল রোগে ভুগছে। রিপন আগের চেয়ে ভালো আছে। দুইবার তার হাতে পায়ে অপারেশন করানো হয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ করতে আরো কয়েকবার অপারেশন করাতে হবে।

ঢাকা মেডিক্যালের হাসপাতালের বেডে কথা হয় বৃক্ষশিশু রিপনের সঙ্গে, সে জানায় তার স্বপ্নের কথা। রিপন রায় রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি সুস্থ হলে, বড় হয়ে আমার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা। কারণ ডাক্তারেরা আমার চিকিৎসা করছে। ভবিষ্যতে আমিও মানুষের চিকিৎসা করতে চাই।’

প্রসঙ্গত, আবুল বাজানদার নামে বাংলাদেশে প্রথম এক বৃক্ষ মানবের সন্ধান পায় চিকিৎসকেরা। তার হাতে-পায়ে ‘শেকড়ের মতো’ আঁচিল নিয়ে দেশ জুড়ে আলোচিত হয়ে ওঠেন। পরে তার চিকিৎসায় এগিয়ে আসে সরকার। এক বছরে কমপক্ষে ১৬টি অপারেশন শেষে তার শরীর থেকে ১০ কেজি বর্ধিত আচিঁল (গাছের শিকড় টাইপের) অপসারণ করা হয়েছে। তিনি এখন ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে ঢাকা মেডিকেলে অনেকটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়