ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বেইজিংয়ের উপকণ্ঠে || শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৭, ২০ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বেইজিংয়ের উপকণ্ঠে || শান্তা মারিয়া

চকবাজার টু চায়না : পর্ব-২২

বেইজিং শান্ত ও সবুজঘেরা শহর। তারপরও শহর তো শহরই। তাই মাঝে মধ্যেই ইচ্ছা করতো নগরের কোলাহল ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যেতে।

 

শিজিংশানে আমার বাসভবনের কাছেই ছিল কালো পাথরের গ্রাম। আর ছিল তুংশান। মানে মাউনটেনিয়ারিং ক্যাম্প। দুটোই পশ্চিম পাহাড় মানে ওয়েস্টার্ন হিলসে। পাহাড় আমার এমনিতেই দারুণ প্রিয়। সিআরআই বাসভবনে আমার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায় লাওশান বাবাওশান টিলা। কি যে ভালো লাগে সেদিকে চেয়ে থাকতে।

 

কালো পাথরের গ্রাম বেইজিংয়ের পশ্চিমদিকের উপকণ্ঠে। বাসে চড়ে তিন/চার ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম আমরা দুই ইবনে বতুতা।

 

এখানে রয়েছে বসতি, চারণভূমি, কমিউন, চাষের জমি। সত্যিকারের এক চীনা গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর। এক বৃদ্ধকে দেখতাম ছাগল চড়াতে। ছোট্ট একটি নালার মতো ছিল। বসন্তে সেখান দিয়ে বয়ে যেত বরফগলা পানি। কালো পাথরের গ্রাম আবিষ্কারের গল্পটাও মজার। আমার বাসার কাছের বাস স্টপেজে দাঁড়ালে প্রায়ই দেখতাম একটা বাস পশ্চিমে যায়। কতদূর যায় এই বাস? জানার খুব কৌতূহল হতো।

 

একদিন চেপে বসলাম ওই বাসে। দেখি যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ক্রমে সেটা শহর ছাড়িয়ে গেল। পাহাড়ের কোলে এসে থামল বাসটা। শেষ স্টপেজে নেমে বুঝতে পারলাম গ্রামে এসে পড়েছি। নামলাম তো বাস থেকে আমরাই শেষ যাত্রী। বাসটা ঢুকে পড়লো ডিপোতে। তার মানে এটা এখন আর যাবে না।

 

তখন বিকেল। ফিরতি বাস কোথা থেকে ছাড়ে বুঝতে পারছি না। হাঁটা ধরলাম শহরের দিকে। জনমনিষ্যি নেই যে পথের দিশা জিজ্ঞাসা করব। হেঁটে হেঁটে এক কিলোমিটার পথ এসে তবে ফিরতি স্টপেজের দেখা পেয়েছিলাম সেদিন। ভারি ভালো লাগছিল পাহাড়ি পথ দিয়ে হেঁটে আসতে। সেদিনের পর থেকেই কালো পাথরের গ্রাম আমাদের প্রিয় জায়গা হয়ে গিয়েছিল। শীত, গ্রীষ্ম আর শরতে এর রূপ পাল্টে যেত। ঠিক একই জায়গায় তিন ঋতুতে ছবি তুলে দেখেছি কিভাবে পাল্টে যায় প্রকৃতির রূপ।

 

 

তুংশানে ছিল আপেল বাগান। ফিংগুইউয়ান। এই সব আপেল বাগানে গাছে গাছে আপেল ধরে থাকতে দেখে অবাক হতাম। তেমন কোনো পাহারা বা মানুষজন চোখে পড়তো না। অথচ চুরি হচ্ছে না কিছুই। বিকেলে দেখা যেত বাস থেকে নামছে শিশু-কিশোররা। ওরা ফিরছে স্কুল থেকে। চারিদিকে শান্তিময় জীবনের ছবি। চীনা গ্রাম এবং গ্রামের মানুষদের সঙ্গে টুকটাক কিছু আলাপ হয়েছে এবং দেখেছিও কয়েকটা গ্রাম। মানুষজন কিন্তু সত্যিই বেশ শান্তিতে আছে। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, তরুণরা কাজে আর বৃদ্ধরা উপভোগ করছে অবসর। অবকাঠামোগতভাবেও গ্রামগুলো উন্নত। পাশ্চাত্যের হাজারো প্রচারণা আছে চীনের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমি নিজের চোখে যা দেখেছি সেটা যথেষ্ট ইতিবাচক। সন্ত্রাস, খুন ইত্যাদি অপরাধ নাই বললেই চলে। সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থাও যে যথেষ্ট ভালো সেটা তাদের কাপড়চোপড় আর খাবারের বহর দেখলেই বোঝা যায়। কৃষকরা আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ফলে শস্যের উৎপাদন প্রচুর। বাজারে খাদ্য সামগ্রীর বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই। নিত্যপণ্যের দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই।

 

বেইজিংয়ের উপকণ্ঠে ওয়েস্টার্ন হিলসেরই এক অংশে ছিল পাতাছু টেম্পল। আটটি মন্দির রয়েছে এখানে। একটির পিছনে একটি। তার মানে পাহাড়ের নিচু অংশে প্রথম মন্দির। তারপর সে মন্দির থেকে বেরিয়ে চোখে পড়বে সিঁড়ি উঠে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে আরো উঁচুতে দ্বিতীয় মন্দিরের দিকে। ক্রমে ক্রমে এইভাবে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছালে যাওয়া যাবে অষ্টম বা শেষ মন্দিরটিতে| এই পাহাড়টির নাম ফ্র্যাগর‌্যান্স হিল। পাতাছু মন্দিরের এলাকা টুরিস্ট স্পট। এগুলো বৌদ্ধ মন্দির। কথিত আছে এখানে গৌতম বুদ্ধের একটি দাঁত রয়েছে স্মারক হিসেবে। এই দাঁত সম্রাট অশোকের সময় রাজকন্যা সংঘমিত্রা উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীলংকায়। সেখান থেকে পরে চীনের রাজ দরবারে পাঠানো হয় এই স্মারক। গৌতম বুদ্ধের স্মরণেই গড়ে ওঠে পাতাছু টেম্পল। এই আটটি মন্দির প্রকৃতপক্ষে সাধনার স্তরকে নির্দেশ করে। চীনের পাহাড়ের ওপর স্থাপিত বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে এমন ব্যবস্থা রয়েছে। পাহাড়ে যেমন একবারে ওঠা যায় না, ধাপে ধাপে উঠতে হয়। তেমনি জীবনের সাধনায় একবারে সিদ্ধি অর্জন করা যায় না। ধীরে ধীরে বা স্তরে স্তরে মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে আত্মার উন্নয়ন করতে হয়।

 

মন্দিরের পরিবেশও দারুণ শান্ত ও সুন্দর। অনেক মানুষ আসে। কেউ নিবেদন করে অর্ঘ্য। কেউ বা এমনিই ঘুরে বেড়ায়। ভিক্ষুকের ভিড়, পুরোহিতের তর্জন-গর্জন বা কোনো ধরনের অপ্রীতিকর কিছুই নেই। আমি প্রায়ই বিভিন্ন মন্দিরে যেতাম। ভালো লাগতো শান্ত পরিবেশে গাছের ছায়ায় বসে থাকতে, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যশৈলী দেখতে। লেকের পানিতে রঙিন মাছের খেলা আর পদ্মফুলের শোভা দেখতাম।

 

 

শীতকালে আবার অন্যরকম সৌন্দর্য। পাহাড়ের চূড়োয় তুষার জমে থাকে। পাতাছুর লেক জমে যায়। সেখানে স্কি আর স্লেজগাড়ির খেলা জমে।

 

সুরভিত পাহাড়ে আলাদাভাবেও যাওয়া যায়। এখানেও রয়েছে বিশাল জাতীয় সংরক্ষিত বন ও উদ্যান। রয়েছে রাজাদের প্রাসাদ, বাগানবাড়ি, লেক, রঙিন মাছের খেলা। শরতে এই সুরভিত পাহাড় এক অসাধারণ রূপ ধারণ করে। গাছের পাতাগুলো রঙিন হয়ে ওঠে। চারিদিকে পাকা ফলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। পুরো পাহাড় সেজে ওঠে নানা রঙে। সে যে কী সুন্দর দৃশ্য। মনে হয় পরীর দেশ। বিভূতিভূষণের আরণ্যক আমার প্রিয় বই হওয়ায় চিরদিনই অরণ্য প্রকৃতি আমার বড় প্রিয়। প্রকৃতির সান্নিধ্যে যে শান্তি পাওয়া যায় তা কোনো জম্পেশ পার্টি বা বিলাসবহুল হোটেলে আমি পাই না। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য পাওয়ার লোভেই চলে যেতাম পাতাছু পাহাড়ে, সুরভিত পাহাড়ে, তুংশানে এবং কালো পাথরের গ্রামের নিভৃত নির্জনে।

 

আরেকটা উপকণ্ঠেও আমরা যেতাম। সেখানে গ্রামের মধ্যে ছোট্ট একটা পার্ক আর টিলা ছিল। সেই সবুজ টিলায় উঠে বসে থাকতাম। পুরো টিলা ভরে যেত ছোট ছোট হলুদ ফুলে। ইংছুনহুয়া ফুল। এই ফুল বসন্তের দূত। বসন্তের প্রকৃতি দেখতাম দুচোখ মেলে। সেই পার্কে গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যায় নাচের আসর বসতো। সেই আসরে অনেকবার অংশ নিয়েছি।

 

উপকণ্ঠে কখনো গেলে ওখানেই কোনো রেস্টুরেন্টে বরবটি ভাজা খেয়ে নিতাম।

 

মনে মনে ভাবতাম এমনি কোনো চীনা গ্রামে নির্জন সবুজ পাহাড়ের কোলে যদি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ নভেম্বর ২০১৬/মারিয়া/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়