ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বোধোদয় || ফিরোজ আলম

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২৯ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বোধোদয় || ফিরোজ আলম

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

অনেকক্ষণ ধরেই করিম গাড়িতে গড়বড় টের পাচ্ছিল কিন্তু স্যারকে বলার সাহস পাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর যামান সাহেব নিজেই যখন বললেন, গাড়িতে এত ঝাঁকুনি লাগছে কেন? তখন মুখ কাঁচুমাচু করে করিম বলল, পেছনের বাম চাক্কাটা মনে হয় লিক করছে স্যার। ভাবছিলাম একটানে বাগানে ঢুইক্কা চাক্কা বদলামু।

যামান সাহেব গাড়ি থামিয়ে চাকা বদলাতে বললেন। সম্প্রতি তিনি পাহাড়ের প্রেমে পড়েছেন। হবিগঞ্জের নির্জন পাহাড়ি এলাকায় একটি চা-বাগান কিনেছেন। ব্যবসার চেয়ে একাকী সময় কাটাতেই এখানে আসেন তিনি। আগে স্ত্রী রোকেয়াও সঙ্গে আসত। বছর খানেক হলো সে বড় ছেলের কাছে ইউএসএ চলে গেছে। বছরে দুই ঈদে সবাই আসে। কিছুদিন বেশ হইচই, এরপর আবার একাকী জীবন।

গাড়িটা যেখানে নষ্ট হয়েছে সেখান থেকে বাগান আরো প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ। তিনি গাড়ি থেকে নামলেন আশপাশের এলাকাটা একটু ঘুরে দেখবেন বলে। আজকাল আর কোনো কিছু ভালো করে দেখা হয় না। কাদেরটা সাথে থাকলে বেশ হতো। ওর সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে হাঁটতে বেশ লাগত। কিন্তু কাদের রাগ করে চাকরি ছেড়ে চলে গেছে।

কাদের সাহেব ছিল যামান সাহেবের ছায়ার মতো। সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে তারা একসঙ্গে বড় হয়েছেন। সত্যি বলতে কাদেরের কারণেই আজ তিনি চৌধুরী গ্রুপের মালিক হতে পেরেছেন। তিনি যখন ব্যবসা শুরু করবেন বলে ঠিক করলেন তখন শুধু মনোবল ছাড়া কিছুই হাতে নেই। শুধু মনোবলে কি আর ব্যবসা করা যায়? এ জন্য টাকা লাগে। তখন এই কাদেরই পৈতৃক জমিজমা বিক্রি করে বন্ধুর ব্যবসার মূলধনের যোগান দিয়েছিল। এরপর যামান সাহেব ওপরে ওঠার পথে কাদেরকে আর কখনো কাছ ছাড়া করেননি। কিন্তু একদিনের ঘটনা কাদেরকে তার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। কোথায় যে গেল আর যোগাযোগই করল না। বড় অভিমানী তার এই বাল্যবন্ধু। সময় এভাবে যামান সাহেবকে ধীরে ধীরে একা করে দিয়েছে। পুরোনো দিনগুলো এখন শুধুই দীর্ঘশ্বাস!

বিটুমিনের কালো প্রলেপ দেয়া রাস্তাটা ধরে যামান সাহেব কিছুদূর হাঁটলেন। সামান্য দূরেই কোনো এক চা-বাগানের শুরু। চা-গাছগুলোতে যত্নের ছাপ আছে। বোঝা যাচ্ছে কোনো এক দক্ষ চা ব্যবসায়ীর বাগান। ছোট ছোট টিলাগুলোর ওপর চা গাছগুলো কোঁকড়ানো সবুজ চুলের মতো মনে হচ্ছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় কোঁকড়ানো চুলের কেউ মাটিতে শুয়ে আছে। দুটো টিলার মাঝ দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা থেকে একটি সরু পায়ে হাঁটা পথ বাঁ দিকে নেমে গেছে। আর ডান দিকে ছোট একটা ঝিরি। তিনি অনমনে বাঁয়ের পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন। শেষ সকালের ক্রমেই তাতিয়ে ওঠা রোদ আর হাঁটার পরিশ্রমে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, সেদিকে খেয়াল নেই যামান সাহেবের। দূর থেকে কোনো এক একাকী ঘুঘুর ঘুঘু....র....ঘুঘ ডাক অনুসরণ করে প্রায় আধ কিলোমিটার পার হয়ে বুঝলেন যে তিনি ঘেমে নেয়ে উঠেছেন।

গাড়ি ঠিক হয়েছে কি না জানার জন্য ফোন বের করতে গিয়ে খেয়াল করলেন ওটা গাড়িতেই ফেলে এসেছেন। আসলে নামার সময় ভেবেছিলেন সামান্য হাঁটবেন। এতদূর আসার ইচ্ছা তার ছিল না। ফিরে যাবেন বলে ঠিক করতেই হঠাৎ দূরে একটি স্কুলের সাইনবোর্ড দেখে থমকে গেলেন। ‘যামান বিদ্যায়তন’ নামটা দেখে তিনি আর সামনে না এগিয়ে থাকতে পারলেন না। কারণ যামান নামটা সবাই ‘জ’ দিয়েই লেখে। তিনিও ওভাবেই লিখতেন আগে। ‘য’ দিয়ে লেখা নামটা পেয়েছিলেন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাংলা স্যারের কাছ থেকে। ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন- বড় হয়ে ব্যবসায়ী হবেন। স্যার ক্লাসের সবাইকে রচনাটি পড়ে শুনিয়েছিলেন। ক্লাসের সবাই খুব হাসাহাসি করলেও স্যার তাকে কাছে ডেকে বলেছিলেন, তুই তো সাধারণ ছেলে না। তোর নামটা এখন থেকে ‘জামান’ না লিখে ‘যামান’ লিখবি। তোর নামও অসাধারণ বানিয়ে দিলাম।

সেই থেকে তিনি নামের বানান ওভাবেই লিখেন। তার সব সার্টিফিকেট কিংবা দলিলপত্রেও এভাবেই লেখা। জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় কর্তৃপক্ষ সঠিক নাম ভুল ভেবে, ভুল নামে পরিচয়পত্র ইস্যু করেছিল। পরে কাদের ঠিক করে এনে দিয়েছিল। তিনি ছাড়া আর কে এভাবে নামটা লিখতে পারে? ভাবতে ভাবতে যামান সাহেব স্কুলের পথে হাঁটতে লাগলেন। একসময় এমন একটা স্কুল করার কথা তিনিও ভাবতেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত করা হয়ে ওঠেনি। নামটাও তো এমনই ভেবেছিলেন- যামান বিদ্যায়তন।

স্কুলটা ছোট হলেও সাজানো। ইংরেজি এল অক্ষরের মতো লাল ইটের ওপর সবুজ টিনের চালা। বারান্দা ঘেঁষেই এ-মাথা ও-মাথা ফুলের বাগান, মাঝে ছোট্ট একটা সিঁড়ি। বকুলগাছের সারি দিয়ে স্কুলের সীমানা করা হয়েছে। মাঠের দুপাশে দুটো গোলপোস্ট আর এক পাশে দাঁড়িয়াবান্ধা খেলার দাগ কাটা। দাঁড়িয়াবান্ধা খেলার নিয়ম যেন কী ছিল? অনেক চেষ্টা করেও তিনি মনে করতে পারলেন না। আজকাল কিছুই মনে রাখতে পারছেন না। ঢাকা ফিরেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে ভাবতে ভাবতে তিনি স্কুলের বারান্দার কাছে চলে এলেন। স্কুলে তখন ক্লাস চলছে। কোনো এক ক্লাসরুম থেকে সমস্বরে শব্দ ভেসে আসছে- সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।

বাহ! কি চমৎকার কোরাসের সুর। যামান সাহেবের শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। এখনো কি স্কুলে ‘আদর্শলিপি’ পড়ানো হয়? শিশুদের সাথে তিনিও গলা মেলালেন। আজ শুধু পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে যে ঘরটার সামনে এলেন তার দরজার ওপর লেখা ‘অফিস কক্ষ’। কী ভেবে সেখানেই ঢুকলেন তিনি। পরিপাটি ঘরের এক পাশের পুরোটাজুড়ে বুকশেলফ। তাতে ঠাসা সব শিশুতোষ বই। ঠাকুরমার ঝুলি, ইশপের গল্প, হ্যান্স এন্ডারসন, জাফর ইকবাল কিংবা হালের কিশোর আলো কী নেই সেখানে? মুগ্ধ যামান সাহেব ঘরের চারপাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ দেয়ালের একটি ছবি দেখে চমকে উঠলেন। ছবিটা দেখার পর রক্তচাপ আকাশে উঠল। এমনিতেই তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী। কাছাকাছি থাকা বেতের চেয়ারটাতে বসে পড়লেন। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে কিছুটা ধাতস্থ হলেন। ছবিটার নিচে লেখা। কাছে গিয়ে পড়লেন- আমরা না বদলালে দেশ বদলাবে কী করে?

তিনিও সব সময় এ কথাটাই বলেন। নিজেরা না বদলালে দেশ বদলাবে কী করে? যামান সাহেব দরজার দিকে এগোলেন। ছবি, স্কুলের নাম এসবের রহস্য তার সমাধান করতেই হবে। তিনি দরজার দিকে ঘুরতেই স্তিমিত হওয়া রক্তের বান আবার লাফিয়ে উঠল।

‘আমার পরিবার’ ক্যাপশন লেখা যে ছবিটার ওপর চোখ পড়ল তা তাকে নিয়ে গেল ছয় বছর আগের কোনো এক দুপুরে।

চৌধুরী অ্যান্ড কোং-এর তেজগাঁওয়ের অফিসে আজ সাজ সাজ রব। অফিসটা তিন একর এলাকাজুড়ে, চারদিকে বড় বড় গাছপালায় ঢাকা। স্বাধীনতার পরপর এক পাঠান ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিনি কিনেছিলেন। আজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিবছর এই দিনে খুব জাঁকজমক অনুষ্ঠান হয়। সারা বছরের কর্মদক্ষতা বিবেচনা করে দেয়া হয় সেরা কর্মীর পুরস্কার। সবাই এই দিনটার অপেক্ষায় থাকেন, কারণ এই উপলক্ষে সবাই স্পেশাল বোনাস পান। এ ছাড়াও খাওয়া-দাওয়া, আনন্দফুর্তিতে ভরে থাকে সারা দিন। যামান সাহেব খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ির বাগানে হাঁটেন। এরপর গোসল সেরে নাশতা করে সকাল নয়টার মধ্যেই অফিসে চলে আসেন। সহসা এই নিয়মের ব্যত্যয় হয় না। আজ অবশ্য একটু আগে এসেছেন। অফিসে এসে নিজের কেবিনের পথে না গিয়ে পেছনে বাগানের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। ওখানেই রান্নাবান্নার কাজ চলছে। তাকে দেখেই নতুন সিইও জলিল সাহেব এগিয়ে এলেন। অন্যসব কোম্পানির মতো যামান সাহেব ইদানীং অফিসের বিভিন্ন দিকে আধুনিকায়নের চেষ্টা করছেন। সিইও নিয়োগের কারণ এটাই। আগে অফিসে তার পরেই ছিল কাদের। তিনি শুধু ব্যবসা দেখতেন আর কাদের সবকিছু সামাল দিত। এখন জলিল সাহেব আর কাদের সমপদে আছেন। ক্ষমতা না দিলে পরিবর্তন আসবে কী করে? তাই জলিল সাহেবকে বেশ ক্ষমতা তিনি দিয়েছেন। তবে জলিল সাহেবকে নিয়ে কাদের বোধ হয় একটু বিরক্ত। মনে মনে হাসলেন তিনি। নতুন জিনিস মেনে নিতে সবারই একটু সময় লাগে।

সিইওর কথা শুনতে শুনতেই তিনি রবিনের খোঁজ করলেন। রবিন এখনো আসেনি শুনে যামান সাহেব অবাকই হলেন। রবিন সাধারণত পৌনে নয়টার আগেই অফিসে চলে আসে। ছেলেটা যামান সাহেব আর কাদের দুজনেরই প্রিয়। চটপটে আমুদে যুবক। প্রায় ৬-৭ বছর ধরে চৌধুরী গ্রুপের অ্যাডমিনে কাজ করছে। অফিসে কাদের সাহেবের পরেই রবিনের অবস্থান। যামান সাহেবের পকেটে যে কাগজটাতে বেস্ট এমপ্লোয়ির মনোনীত নাম লেখা আছে, সেখানে রবিনের নাম সবার ওপরে। অবশ্য প্রতিবছর রবিনের নাম মনোনীত হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে পুরস্কারটা দেয়া হয় না নানা কারণে। অনেক বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেক কিছু করতে হয়। কিন্তু এবার তিনি ঠিক করেছেন রবিনকেই পুরস্কার দেবেন। কিছু দূরে কাদেরকে দেখলেন ডেকোরেটরের লোকদের কী যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে। তিনি চোখের ইশারায় তাকে কাছে ডাকলেন। কাজ কেমন চলছে- যামান সাহেব প্রশ্ন করলেন।

কাদের সাহেব বললেন, ভাল স্যার।

দুই বন্ধু একা থাকলে তুমি সম্বোধন করলেও তৃতীয় পক্ষের সামনে প্রটোকল মেনেই তারা কথা বলে। যামান সাহেব এবার রবিনের অফিসে লেট করার কারণ জানতে চাইলেন। কাদের সাহেব জলিল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, রবিন আসবে না স্যার।

যামান সাহেব কিছুটা অবাক হলেও সামলে নিয়ে বললেন, অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে ওকে আসতে বলো। ওর সাথে আমার কথা আছে।

যামান সাহেবের চেম্বারে মাথা নিচু করে রবিন দাঁড়িয়ে আছে। রাগান্বিত কণ্ঠে যামান সাহেব প্রশ্ন করলেন, এই গুরুত্বপূর্ণ দিনে তুমি অফিসে আসবে না, এই সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছো? তুমি জানো না অসুস্থতা ছাড়া এই দিনে ছুটি নেয়ার অনুমতি নেই।

রবিন চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রাইল। রবিনের নীরবতা যামান সাহেবকে আরো রাগিয়ে দিল। তিনি পকেট থেকে বেস্ট এমপ্লোয়ির তালিকা বের করে রবিনের নামটা কেটে দিয়ে বললেন, এমন অনিয়মকারী কখনোই বেস্ট এমপ্লোয়ি হতে পারে না। এরপর চিৎকার করে বললেন, বেরিয়ে যাও আমার সামনে থেকে।

চোখের কোণে জল নিয়ে রবিন সেই যে বেরিয়ে গেল, চৌধুরী গ্রুপের কেউ আর তাকে কখনো দেখেনি। অফিসে রিজাইন লেটার দিতে কিংবা ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিতেও আসেনি। প্রভিডেন্ট ফান্ড কিংবা গ্র্যাচুইটির টাকাও নিতে আসেনি। এতদিন রবিনের নামে জলিল সাহেব যেসব অভিযোগ করে এসেছেন, তার সবই ঠিক মনে হচ্ছিল। নিশ্চয়ই অনেক টাকা লোপাট করেছে। তা না হলে চাকরির মায়া ছেড়ে চলে গেল কেন? তিনি অডিট বিভাগকে রবিনের সব হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মিলিয়ে দেখতে বললেন। প্রয়োজনে তাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেবেন। অতিরিক্ত স্নেহের কারণে জলিল সাহেব বারবার বলা সত্ত্বেও রবিনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। কিন্তু এবার আর ছাড় নেই। সব শুনে লাঞ্চের সময় কাদের সাহেব যামান সাহেবকে বললেন, তুমি নাকি রবিনকে পুলিশে দেবে বলেছো?

এমনিতেই যামান সাহেবের মনের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। এমন আচমকা প্রশ্নে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। আমার অফিসে আমি যা খুশি করব, তাতে কার কী? ক্রোধ মানুষকে কতটা অন্ধ করে দেয়, চৌধুরী গ্রুপ সেদিন দেখল। যামান সাহেবের চিৎকার শুনে জলিল সাহেব রুমে ঢুকলেন। তিনি যামান সাহেবের ক্রোধ উসকে দিয়ে বললেন, স্যার আমার মনে হয় উনিও রবিনের সঙ্গে জড়িত।

যামান সাহেব কিছুটা শান্ত হয়ে বললেন, জলিল সাহেব, আপনারা এখান থেকে যান। আর একটা নোটিশ করে দিন অফিসে কেউ যেন আমাকে আর ‘তুমি’ করে না বলে। কাদের সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে জলিল সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আজ যে তার বড় খুশির দিন। এমন দিনের জন্যই তিনি অপেক্ষায় ছিলেন।

রবিন চলে যাওয়ার পর প্রথম দিকে রাগের কারণে তার অভাববোধ করেননি যামান সাহেব। কিন্তু কাদের সাহেব চলে যাওয়ার পর কিছুটা ভেঙে পড়লেন। তার সাথে থাকতে থাকতে বিয়েটাও করেনি মানুষটা। গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়েও কাদের সাহেবকে পাওয়া যায়নি। কিছুই না বলে কোথায় চলে গেল ওরা? কিছু একটা তো বলে যেতে পারত, নাকি? না হয় রাগের মাথায় দুটো কথা বলেই ফেলেছেন তিনি। তাই বলে এমন করে ছেড়ে যেতে হবে? কেউ বোঝে না যে এত বড় ব্যবসা চালাতে গিয়ে মাঝে মাঝে কিছুটা এলোমেলো হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। রোকেয়াও ভালো করে কথা বলে না আজকাল। ছেলেমেয়েরা সবাই বিদেশ থাকে ছোটবেলা থেকেই। ইদানিং বড় একা লাগে।

পিয়ন এসে একগাদা খাম দিয়ে যায়। নিজের চিঠি অন্য কারো খোলা পছন্দ নয় যামান সাহেবের। টেবিলের ওপর ছড়ানো কাগজ থেকে চেনা হাতের লেখার একটা খাম ছোঁ মেরে তুলে নিলেন যামান সাহেব। কম্পিত হাতে খুলতে গিয়ে চিঠির একটা অংশ ছিঁড়েও ফেললেন। পড়ার আর দেরি সইছে না। রবিনের লেখা চিঠি। চিঠিতে কাদেরের খোঁজও পাওয়া যেতে পারে।

শ্রদ্ধেয় স্যার,

আসসালামুআলাইকুম।

আপনি যখন এই চিঠি পড়ছেন তখন আমি অনেক দূরে। আপনি আপনার রুম থেকে বের করে দেবার পর নিজের রুমে এসে অনেকক্ষণ ভাবলাম। আমার কী করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। আপনি তো জানেন স্যার, আমার আপনজন বলতে তেমন কেউ নেই। কাদের স্যার আর আপনি ছাড়া পরামর্শ দিতে পারবে এমন একটি মুখও খুঁজে পেলাম না। রিজাইন লেটার লিখে হঠাৎ মনে হলো আমি চৌধুরী গ্রুপ থেকে রিজাইন দেব কী করে? এটা তো আমার পরিবার। পরিবার থেকে কি রিজাইন দেয়া যায়? আবার পরিবারের বড়কর্তার স্নেহবঞ্চিত হয়ে ওই পরিবারে পড়ে থাকি কী করে? তাই রিজাইন না দিয়েই চলে এলাম। যেহেতু অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা আমার আর সম্ভব নয়, তাই ক্লিয়ারেন্স নেয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। সেই ছেলেবেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মা মারা যাওয়ার পর নিঃসন্তান চাচা-চাচির কাছেই মানুষ হয়েছি। স্যার আপনার মনে আছে কি না জানি না, আমার শেষ আশ্রয় চাচা যেদিন মারা গেলেন সেদিন আপনি বলেছিলেন, আমরা তো আছি। সেদিন থেকে আপনারাই ছিলেন আমার সব। চাচি সব সময় বলতেন চাকরি না করে যেন তার কাছে গিয়ে থাকি। কিন্তু আপনাদের স্নেহের বাঁধনে এমনভাবে আটকা পড়েছিলাম যে আর সরে আসতে পারিনি। সেই আপনি জলিল স্যারের কথায় আমাকে ভুল বুঝলেন। জানতে চাইলেন না পেছনের কারণ। সেদিন জলিল স্যারই আমাকে অফিসে আসতে মানা করেছিলেন। আমার নামে নাকি তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন অফিসে না আসি- তিনি বলেছিলেন। কাদের স্যার আপনাকে ঘটনাটা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি স্যারকে বলেছিলাম, প্রশ্ন যখন উঠেছে তখন তদন্তের মাধ্যমে সব পরিষ্কার হওয়াই শ্রেয়। সেই পরিষ্কার হতে গিয়ে একেবারে ছিটকে বাইরে চলে এলাম আমি। দুঃখ শুধু আপনার কাছ থেকে শেখার সুযোগটা হারালাম। আমার যে ব্যাংক ব্যালেন্স নিয়ে কথা উঠেছিল, তা ছিল প্রতি মাসে আমার নিঃসন্তান চাচির পাঠানো পকেটমানি। আমার মধ্যবিত্ত চাচার সাথে ধনাঢ্য চাচির বনিবনা না হলেও তিনি আমাকে নিজ সন্তান বলেই মনে করেন সব সময়। তাই প্রতি মাসে আমার হাত খরচের জন্য মোটা টাকা পাঠাতেন। আর আপনার প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে মোটা টাকা বেতন পেতাম। একা আমার এত টাকা খরচ করার জায়গা কই? তাই জমতে থাকে টাকা। জলিল স্যার কোনোভাবে এই টাকা আর চাচির খবর পেয়েছিলেন। তিনি আমাকে প্রতিদিন তার সঙ্গে ব্যবসা শুরুর পরামর্শ দিতেন। আমার টাকা আর তার বুদ্ধি এক করলে নাকি চৌধুরী গ্রুপের চেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান করে ফেলতে পারবেন। আমি হাসিমুখে তাকে না বলে দিয়েছি বারবার। আর তাতেই তিনি আমার পেছনে লাগলেন। সিইও হিসেবে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন। সে ক্ষেত্রে আমার পতন ঠেকানোর জন্য আর কেউ রইল না।

তবে স্যার আপনার কাছ থেকে আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে উপকারই করেছেন তিনি। আমি এখন জীবনের মানে ও আমার জমানো টাকার সঠিক ব্যয়ের পথ খুঁজে পেয়েছি। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। তাই শুধুই সীমাহীন শুভকামনা জানিয়ে শেষ করছি।

আপনার স্নেহধন্য

রবিন

চিঠিটা পড়ে কিছু সময় ঝিম ধরে বসে রইলেন যামান সাহেব। অডিট বিভাগের প্রধান ইমতিয়াজ সাহেবকে ডেকে আনলেন তিনি। এরপর রবিনের বিরুদ্ধে তদন্তের কি অবস্থা জানতে চাইলেন। ইমতিয়াজ সাহেব বললেন, তেমন কোনো সমস্যা পাইনি স্যার।

তাহলে রিপোর্ট দেননি কেন? ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানতে চাইলেন যামান সাহেব।

ইমতিয়াজ সাহেব মাথা নিচু করে বসে রইলেন। এরপর নিচু স্বরেই বললেন, সিইও স্যারের নিষেধ ছিল।

যামান সাহেব তার ৩৫ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে এমন পরিস্থিতিতে পড়েননি। অফিসের সবাইকে নিজের পরিবার বলেই জানতেন তিনি। এমন করে তার অফিস কবে কুটিল যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে গেল? একটু দেরিতে হলেও আজই তিনি সবকিছুর সমাধান করবেন। প্রথমেই পিএকে ডেকে জলিল সাহেবকে বরখাস্তের চিঠি দিতে বললেন। ইমতিয়াজ সাহেবকে ভারপ্রাপ্ত সিইও করে রবিন ও কাদের সাহেবকে খুঁজে বের করার আদেশ দিলেন তিনি।

ঢং ঢং ঘণ্টার শব্দে যামান সাহেব বর্তমান সময়ে ফিরে এলেন। একজন তরুণ শিক্ষক ঘরে ঢুকে যামান সাহেবকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।

স্যার আপনি!

যামান সাহেব অবাক কণ্ঠে বললেন, আপনি আমাকে চেনেন?

চিনব না কেন? স্কুলের সবাই আপনাকে চেনে। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আপনি।

যামান সাহেবের মাথা ঘুরতে লাগল। তার নিজের নামে স্কুল, স্কুলের দেয়ালে তার বাণীসমৃদ্ধ ছবি, চৌধুরী গ্রুপের অফিস স্টাফদের গ্রুপ ছবির নিচে লেখা ‘আমার পরিবার’। এসবের মানে কী? কে আছে এসবের পেছনে? যামান সাহেবের মনে হচ্ছে তিনি একটা ঘোরের মাঝে পড়ে গেছেন। তিনি জানতে চাইলেন, এই স্কুলের জন্য টাকা কে দিয়েছে?

আপনিই তো দিয়েছেন স্যার। আর আপনার পক্ষ থেকে রবিন ভাই এই স্কুল পরিচালনা করেন- তরুণ শিক্ষকের সহাস্য উত্তর।

কী বললেন নামটা?

রবিন।

যামান সাহেবের মনের ভেতরে অজানা খুশির জোয়ার উথলে উঠল।

তরুণ শিক্ষকটি বললেন, মোহিনীছড়া চা-বাগানের বর্তমান এমডি হলেন আমাদের রবিন ভাই। আর তার চাচি এই বাগানের মালিক। বাগানের শ্রমিক ও আশপাশের সব দরিদ্র ছেলেমেয়েরা এই স্কুলে বিনা মূল্যে পড়াশোনা করে। খুব তাড়াতাড়ি এটা আবাসিক স্কুল হয়ে যাবে। একটানা স্কুলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে লাগল ছেলেটি। কিন্তু যামান সাহেবের সেদিকে খেয়াল নেই। তার মনে শুধুই রবিনের নামটা ঘুরছিল। রবিন এখানে আছে মানে কাদেরও থাকতে পারে!

যামান সাহেব তরুণ শিক্ষকটিকে থামিয়ে বললেন, আমাকে রবিনের কাছে নিয়ে যাবেন?

তরুণ শিক্ষক হেসে বলল, স্যার, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। ঠিক ১২টার সময় ভাইয়া ছেলেমেয়েদের দুপুরের খাবার খাওয়াতে আসবেন। এসব দরিদ্র ছেলেমেয়েদের সাথেই রোজ দুপুরের খাবার খান তিনি।

ঘড়ির কাঁটায় তখন পৌনে ১২টা। চরম উত্তেজনায় যামান সাহেবের পনেরো মিনিট, পনেরো ঘণ্টার মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। এরপর সাদা একটা হুডখোলা জিপে রবিনকে আসতে দেখলেন তিনি। গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ‘ভাইয়া’ বলে চিৎকার করে ঘিরে ধরল তাকে। পাশের সিট থেকে বড় বড় টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে নামল কাদের। ততক্ষণে স্কুলের বারান্দায় বসে পড়েছেন যামান সাহেব। তরুণ শিক্ষকটি দৌড়ে গিয়ে যামান সাহেবের কথা বলতেই একরকম উড়ে বারান্দায় চলে এল রবিন। সে যামান সাহেবের পায়ের কাছে বসে পড়ল।

স্যার আপনি এসেছেন? আমি জানতাম একদিন আপনি আপনার স্বপ্ন ছুঁতে ঠিক আসবেন।

কাদের সাহেব কাছে এসে বললেন, স্যার ভালো আছেন?

যামান সাহেব মৃদু হেসে বললেন, চড় খাবি কাদের, যদি আর কোনো দিন স্যার ডেকেছিস। এরপর তিনজন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। দূরে দাঁড়িয়ে স্কুলের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, ড্রাইভার করিম সবার চোখেই আনন্দাশ্রু। এত সুন্দর দৃশ্য তারা কোনো দিন দেখেছে কি না মনে করতে পারল না।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুন ২০১৬/এএন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়