ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ভিয়েতনামের পথে: শেষ পর্ব

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪১, ৪ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভিয়েতনামের পথে: শেষ পর্ব

ফেরদৌস জামান: মেঘেদের অনড় অবস্থানের পরিবর্তন আজ আশাতীত। কোলের মধ্যে এসেও দেখা গেল না মাউন্ট আগুং আগ্নেয়গিরির সুস্পষ্ট চেহারা। তবে বিশেষ অভিজ্ঞতা হিসেবে অর্জিত হলো বালি দ্বীপে মন্দির সমগ্রের মাতৃপুরা বেসাকির সান্নিধ্য। পুরা বেসাকি আমাদের পেয়ে কতটা খুশি জানি না, তবে আমরা ধন্য। মন্দিরের প্রায় প্রতিটি কোণায় পদচিহ্ন রেখে নেমে এলাম। সিঁড়ির গোড়ায় বাম পাশে স্তরে স্তরে সাজানো মূর্তির সারি। ছোট্ট খুকি এক গোছা ফুল নিয়ে সামনে এসে বলল, নেবে?

আমরা তো মন্দির দেখে নেমে এলাম, এখন ফুল দিয়ে কী হবে? অমনি পথপ্রদর্শকের স্বস্নেহ  ধমকে বেচারা দূরে পালালো। বিদায় বেসাকি, বিদায় মাউন্ট আগুং! একই পথে ফিরছি। চলে এসেছি অনেকটা পথ। মাঝে মধ্যে স্কুটি থেকে নেমে জমির আইল ধরে হেঁটে যাচ্ছি কোন সুবিধাজনক জায়গায়, যেখান থেকে আগুং এর দু’চারটি ছবি তোলা যায়। যাওয়ার পথে তো ভেবেছিলাম ওর কোলের মধ্যে যাচ্ছি। অতএব, ছবি যা তোলার সেখানে গিয়েই তোলা যাবে। কিন্তু বেরশিক মেঘ যে এমন আড়ি ধরে বসবে তা কে জানতো? পথ থেকে বামে পাথারের মাঝ দিয়ে এগিয়ে গেছে লিকলিকে একটি পথ। কয়েক মিটার পরেই একটি খাবারের দোকান। পাশেই সবুজ ক্ষেতজুড়ে সবুজের সুদৃশ্য গালিচা। তার মাঝ থেকে ফুটে বেরিয়ে আছে লাল টকটকে ফুল। এটা নিছক কোনো ফুল বাগান নয় বরং শস্য ক্ষেত। ক্ষেতে কাজ করছে কয়েকজন কৃষক। ঠিক তার মাঝ দিয়ে চিকন আইল পথ। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো নিজ দেশের কোন প্রত্যন্ত গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। দোকানের ছাউনির নিচে হাতে গোনা দুই-চারজন মানুষ। নিতান্তই বিশ্রামের উদ্দেশ্যে বসে থাকা। কেউ পানি পান করছে তো কেউ চা-বিস্কুট। পাশে প্রশস্ত একটি মাচা আছে। আর তারই ধারে একটি পানির কল। নলের মাথায় লাগানো কলটি ঘুরালেই বেরিয়ে আসছে সুপেয় ঠান্ডা পানি। প্রাণ ভরে পানি পান শেষে দুই পেয়ালা কফি দিতে বললাম। সাথে চুবিয়ে চুবিয়ে খাওয়ার জন্য বিস্কুট। আহ, কি আরাম! মাথার উপর গাছের ছায়া। মাচায় বসে থাকতে ভালোই লাগছে। ইচ্ছা হচ্ছে আজকের দিনটা এখানেই থেকে যাই। দোকানের একমাত্র বিক্রেতা নারী যারপর নেই ব্যস্ত। দুই হাতে সামাল দিচ্ছেন সব কিছু। কাউকে চা-কফি বানিয়ে দেয়া তো কাউকে গ্লাস ভরে বরফের টুকরো এগিয়ে দেয়া। এরই মাধ্যে পরিশ্রান্ত এক কৃষক ঘাম মুছতে মুছতে এসে কি এক খাবার দিতে বললেন। সাথে সাথে খাবারটি তৈরি শুরু হলো। কালো পাথরের চওড়া পাত্রে একের পর এক কাচা মরিচ ও মশলা উপকরণ রাখা হলো। তারপর লাম্বা পাথরের অন্য একটি দণ্ড দিয়ে সব কিছু পিষে মিহি করা। মশলার টুকরোগুলিতে কয়েকটা ডলা পরতেই চারপাশ দিয়ে মন মাতানো এক সুগন্ধ ছড়িয়ে পরল। জানতে চাইলে দোকানি হাস্যজ্জল মুখে বললেন, লনটং। মশলা মিশ্রণ তৈরির পর যুক্ত করলেন জমাট বঁধানো ভাতের টুকরো। ধারালো ছুরি দিয়ে কাটা ভাতের টুকরোর পর ছেড়ে দিলেন তেলে ভাজা মুচমুচে এক মুঠো বীজ। দেখতে ঠিক বরবটি কালায়ের মত। এরপর যোগ করা হলো মুখ ফেটে সবে অংকুর বের হয়েছে এমন এক ধরণের বীজ। এই তিন প্রধান উপকরণ যোগ করার পর তার মধ্যে আরও কি কি যেন দিলেন। সব শেষে কাঠের চামচ দিয়ে নারা দেবার পর বাটিতে তুলে পরিবেশন করলেন। লোকটি চামচ দিয়ে মুখে পুরে খাওয়া শুরু করলেন। প্রথম চাবানিতেই মুখের মাঝে উৎপন্ন হলো কটরমটর ধরনের এক লোভনীয় ধ্বনি। আহা, কি তৃপ্তির ধ্বনি! সুজিতের এতে আগ্রহ নেই তা আগেই জানিয়ে দিয়েছে। আমি তো ছাড়বার পাত্র নই। পুরো প্রস্তুত প্রণালী প্রত্যক্ষ করার পর আমার আগ্রহ এত দূর পৌঁছে গেছে; ইচ্ছা হচ্ছে দোকানিকে অনুরোধ করে নিজ হাতেই তৈরি করে নেই।



ফেরার সময় বেশ কিছু দূর আসার পর খেয়াল করলাম আমরা আগের পথে নেই, চলে এসেছি অন্য পথে। এ পথে ঘরবাড়ি বা বসতির পরিমাণ খুবই কম। আবার কোথাও কোথাও নেই বললেও চলে। দু’পাশে শুধু পাথার আর তার পরেই পাহাড়। অন্য পথে চলে এসেছি তো কি হয়েছে? এ নিয়ে মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। পরে আছে অর্ধেক বেলা। পথ যেদিকে খুশি নিয়ে যাক, স্কুটি বাহাদুরের পেট যতক্ষণ ভরা আছে ততোক্ষণ চিন্তা নেই। পথ এসে যুক্ত হলো মহাসড়কে। এখান থেকে যদি ঠিক ঠিক কুতায় গিয়ে পৌঁছতে পারি তাহলে পরবর্তী গন্তব্য হবে পুরা তানাহ লট। বহু পুরনো মন্দির তানাহ লট ডেনপাসার থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে সৈকতে অবস্থিত। কীভাবে কোন পথ দিয়ে সৈকতে উপস্থিত হলাম তা বলা বড় কঠিন। গন্তব্যে পৌঁছতে পারাটাই আপাতত স্বার্থকতা। বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেতের পর একটি প্রবেশ দ্বার। এর ভেতর দিয়েই ঢুকতে হবে সৈকত এলাকায়। তার আগে জনপ্রতি ষাট হাজার এবং স্কুটি রাখার জন্য বিশ হাজার দিয়ে সংগ্রহ করতে হলো তিনটি টিকেট। ভেতরে ঢুকে দেখি সে এক বিশাল আয়োজন। নির্দিষ্ট স্থানে স্কুটি রেখে এগিয়ে যেতে হয় সৈকতের দিকে। ডানে-বামে স্থানীয় হস্তশিল্প আর খাবারের বহু দোকান। বার ও রেস্টুরেন্টগুলির শতভাগ জুড়ে স্থানীয় সংস্কৃতির অসামান্য বহিঃপ্রকাশ। আগাগোড়া বাঁশ দিয়ে তৈরি। চেয়ার টেবিল থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুর মধ্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে চমৎকার শিল্প ভাবনা। মাথার উপর ছনে ছাওয়া চাল। বসলেই গা শীতল হয়ে যায়। আরাম এবং বিলাসে আরও একটু উপভোগ যোগ করতে চাইলে সেই আয়োজনেরও কমতি নেই। ভেসে বেড়াচ্ছে রং-বেরঙের মাছ। জলের বুকে চমৎকার বসার ব্যবস্থা। সারি করে স্থাপন করা চালাগুলির নিচে বাঁশের চকি এবং তাকে কেন্দ্র করে চার দিকে বসার বন্দবস্ত। পর্যটক চাইলে রঙ্গিন মাছে ভরা স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে উপভোগ করতে পারে সমস্তটা সময়। সাথে ক্ষণে ক্ষণে সুরার পেয়ালায় দু’একটি তৃপ্তির চুমুক।

সৈকতে আছড়ে পরা ঢেউগুলির শব্দ অনেক দূর থেকেই কানে ভেসে আসছে। সারা পৃথিবীর অগুনিত পর্যটক এসে ভিড় জমিয়েছে। অপেক্ষায় আছে সূর্য ডুবে যাওয়ার মুহূর্তগুলিকে হৃদয়ে এবং ক্যামেরায় ধারণ করার জন্য। সৈকত বলতে সাধারণত যা বুঝি এ ঠিক তেমনটি নয়, দক্ষিণের ধেয়ে আসা ঢেউ আছড়ে পরছে পাথরের অমসৃণ দেয়ালে। দেয়ালটি ধরে তৈরি করা হয়েছে হাঁটার পথ এবং নিরাপত্তা রেলিং। কালো পাথরের আঁকাবাঁকা দেয়াল চলতে চলতে তার বুক থেকে একটি অংশ যেন সসুদ্রের মধ্যে বাড়িয়ে দিয়েছে। দেয়ালের নিচ দিয়ে প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে তৈরি করে নিয়েছে একটি এপার-ওপার সুরঙ্গ। সুরঙ্গবিশিষ্ট পাথরের দেয়ালের ঠোঁটে পনের শতকে নির্মিত হিন্দু ধর্মের পুরা বাতু বোলং। কি অসাধারণ দেখতে! স্থানীয় ভাষায় সুরঙ্গ বা গর্তের মানে বোলং আর এখান থেকেই মন্দিরের নাম পুরা বাতু বোলং। আমাদের লক্ষ্য ছিল পুরা তানাহ লট কিন্তু এসে উপস্থিত হয়েছি এখানে। জানতে পারলাম তানাহ লটের দূরত্ব বেশি নয়, মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। প্রকৃতির ঈর্ষণীয় সৌন্দর্য আর তাকে ঘিরে সৃষ্ট সমাগমে হারিয়ে গেছি। এর মাঝ থেকে নিজেকে খুঁজে বের করে এই মুহূর্তে অন্য কোন জায়গায় নিয়ে হাজির করার সাদ্ধ আমার নেই। সুতরাং, কীভাবে এমন ঘটল অর্থাৎ তানাহ লটে না গিয়ে হাজির হলাম তানাহ বোলং-এ তা খণ্ডানোর দায়িত্ব প্রকৃতির হাতেই ছেড়ে দিলাম। নীল জলরাশির বুক থেকে একেকটি ঢেউ এসে সজোরে আঘাত হানছে পাথরের কালো দেয়ালে। মনে হবে মন্দিরসহ পাথরের স্তুপটাকে নিমিশেই খানখান করে দেবে। কিন্তু না, শত সহস্র বছর ধরে এমনই করে চলছে পাথর আর জলরাশির দুরন্তপনা। আছড়ে পরা ঢেউয়ের কণাগুলি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আবারও ফিরে যাচ্ছে অতল সমুদ্রের অসীমতায়। এমনি করে চলে এলো প্রতীক্ষার সেই মূল্যবান সময়। পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্য ক্রমেই হেলে পরছে সমুদ্রের বুকে। সে সাথে আকাশজুড়ে অঙ্কিত হলো সিঁদুর আর নীলের মিশ্রণে এক নান্দনিক চিত্রকলা। সৈকতে নেমে এলো নীরবতা, ক্যামেরাগুলি থেকে বেরিয়ে আসছে অজস্র খুটুস খুটুস শব্দ, প্রেমিক যুগলেরা জরিয়ে ধরল পরস্পরকে, কয়েক মুহূর্তেই সমুদ্রের কম্পিত জলে ডুব দিল ডিমের কুসুমের মত লাল টকটকে একটি সূর্য।



সন্ধ্যা নেমে এলে সকলেই যে যার পথ ধরল। পথের অনেকটাজুড়ে যানজট। রাতের অন্ধকার আর যানজট ঠেলে চলে এলাম কুতায়, স্কুটি ফেরত দিতে হবে। মহাজন অনেক খুশি। অথচ ভেবেছিলাম চিন্তায় তার সারা মুখে বিরূপ কোন চিত্র ফুটে থাকবে। আজকের রাতটাই এখানে শেষ রাত। আগামীকাল বেলা এগারটা পয়ত্রিশ মিনিটে এই দীর্ঘ ভ্রমণের সমাপ্তি টেনে ফিরতি ফ্লাইট ধরতে হবে। স্কুটি ফেরত দেয়ার পর অন্য কোন উপায়ে যেতে হবে হোটেলে। সারাদিন বালির এই প্রান্ত থেকে সেই প্রান্ত ছোটাছুটিতে শরীর বেশ ক্লান্ত। একবার অনুরোধ করে দেখি না- স্কুটিটা হোটেলে রেখে গেলাম, কাল সুবিধা মত সময়ে গিয়ে তিনি নিয়ে আসলেন! কিন্তু আর একটি বাক্যও যে ব্যয় করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সুজিত সবে মুখ থেকে বের করেছে অমনি রাজি, অনুরোধ পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজনই পড়ল না। এই ঘটনা ইন্দোনেশিয়ার বাস্তবতার ছোট্ট একটি উদাহরণ হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। তারা মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে, সমাজ তাদেরকে অন্যের প্রতি বিশ্বাসী ও আস্থাভাজন হতে শিখিয়েছে।



হোটেল ভিনাকা বালী অভিমুখে ছুটে চললো ভ্রমণের নির্বাক সহযাত্রী ফুটফুট শব্দের ছোট্ট স্কুটি। ওর পিঠে চেপে চষে বেড়ালাম বালির পড়তে পড়তে। পথ ভোলা পথিককে কত পথ আর অলিগলি দেখিয়েছে তার ঠিক ঠিকানা নেই! আরও দেখিয়েছে পাহাড়, সমুদ্র এবং বৈচিত্রে ভরা জনপদ। কালই হয়তো আবারও একই দায়িত্বে নিয়োজিত হবে। আসবে ভিন্ন ইচ্ছা, ভিন্ন স্বপ্নের নতুন কোন অতিথি। কত মানুষের ইচ্ছা পূরণের সহযাত্রী সে যে হয়, তা কি বলে শেষ করা যায়? পথে পরে থাকা এরূপ অতি নগণ্য স্মৃতি আর অভিজ্ঞতাগুলি আমার কাছে একেকটি মূল্যবান অর্জন। অর্জনের থলে থেকে একটি একটি করে তুলে নেই আর যত্ন করে পুঁথির মত সুতার মধ্যে গেঁথে রাখি। তাতে প্রাণের সঞ্চালনে আমি যে নেহায়েতই অযোগ্য সে আমার ভালো করে জানা। তুবুও গেঁথে রাখি, গেঁথে চলি।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়