ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

ভুট্টো হঠাৎ ঢাকায়, ইয়াহিয়ার সঙ্গে গোপন বৈঠক

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১২, ২১ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভুট্টো হঠাৎ ঢাকায়, ইয়াহিয়ার সঙ্গে গোপন বৈঠক

একান্ত বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও জুলফিকার আলী ভুট্টো (ছবি : সংগ্রহ)

শাহ মতিন টিপু : একাত্তরের  ২১ মার্চ ছিল রবিবার।  এদিন সকালেই পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো হঠাৎ করেই ঢাকায় আসেন।

ঢাকায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই সংগ্রামী জনতা তার বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কড়া সামরিক নিরাপত্তায় তিনি হোটেলে পৌঁছেন। ভুট্টোর সঙ্গে ছিল ১৩ জন উপদেষ্টা এবং প্রায় একডজন সশস্ত্র দেহরক্ষী।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত ভুট্টো জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাতে গেলে সংগ্রামী জনতা তার প্রতি জুতা নিক্ষেপ করে এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

রাতে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া দু’ঘণ্টা স্থায়ী এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন এবং ২৫ মার্চের গণহত্যার নীলনকশা চূড়ান্ত করেন। রাতে বিদেশি সাংবাদিকদের ভুট্টো বলেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’

দেশবসীর কাছে তখন এটাই স্পষ্ট যে, ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে ভুট্টোর এই আগমনের পেছনে নিশ্চয়ই কোন ষড়যন্ত্র আছে। তারা নতুনভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকে। সবকিছুর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলন চলতেই থাকে।

আজ লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ২০তম দিবস অতিবাহিত। উত্তাল-অগ্নিগর্ভ সারাদেশ।যথারীতি আজও রাজধানীর সকল সরকারি-বেসরকারি বাসভবন এবং যানবাহনসমূহে কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল। পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি এবং বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগের সমর্থনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল ও স্লোগানে আগের মতোই প্রকম্পিত থাকে রাজধানী ঢাকা সহ সারাদেশের রাজপথ।

অপরদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আজ এক অনির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হন। প্রায় ৭০ মিনিট স্থায়ী আজকের বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একমাত্র সহকর্মী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। অন্যপক্ষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ছিলেন তাঁর আইন উপদেষ্টা বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস এবং সামরিক উপদেষ্টাগণ।

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাগত স্বরে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।” সাংবাদিকগণ আলোচনার ফলাফল জানতে নেতাকে চাপাচাপি করতে থাকলে তিনি আর কিছু বলতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে স্বীয় বাসভবনের উদ্দেশে যাত্রা করেন।

বাসভবনে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে ৪টি শর্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওনারা আমার কাছে একটা কথাই বার বার বলছেন যে, আগে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসুক। আমি স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছি, এত কিছু হওয়ার পরে আমার কাছে ওই ৪ দফা ছাড়া আর অন্য কোন কথা নেই। আমি আমার জনগণের কাছে যা বলেছি, বার বার তাই আমি আপনাদের কাছেও বলছি। এ ভিন্ন আমার অন্য কোন কথা নেই। আলোচনা সফল করতে হলে এখন প্রেসিডেন্টকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” খুবই ক্ষুব্ধ এবং রাগান্বিত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের উদ্দেশে কথাগুলো বলছিলেন।

সাংবাদিকদের একাধিক প্রশ্নের উত্তরে এক পর্যায়ে উত্তপ্ত স্বরে এ কথাটি ছাপতে নিষেধ করে নেতা বলেন, “এটি অব দ্য রেকর্ড। কার সঙ্গে আলোচনা করব? গিয়ে দেখি কালা কুত্তা (ব্ল্যাক ডগ মদ) নিয়ে চুর হয়ে আছে।”

আজ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তাঁর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে মিলিত হন। ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুকে এমন কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন যাতে বঙ্গবন্ধু তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তখনই সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, “আমি আমার জনগণকে পাকিস্তানের শেয়ালদের হাত থেকে মুক্ত করে আমেরিকান বাঘদের হাতে তুলে দিতে পারি না।”

দেশে একদিকে আলোচনা, অসহযোগ আন্দোলন চলছে- অন্যদিকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী তাদের ঘাঁটিগুলোকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে থাকে। প্রতিদিনই পাকিস্তান থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ, সৈন্য আসতে থাকে। আলোচনার আড়ালে তারা নিজেদের এ দেশের নিরীহ মানুষের ওপর হিংস্র জন্তুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সেনা সদস্যদের প্রস্তুত করতে থাকে।

বাংলা নামের ভূখন্ড তখন তপ্ত। পেশাজীবী গ্রুপগুলো সভা, সমাবেশ, মিছিলে মুখর। সবার কণ্ঠে একটি মাত্র ধ্বনি, একক একটি উচ্চারণ- স্বাধীনতা। জয়দেবপুরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গুলি চালিয়েছে নিরীহ জনগণের ওপর। তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জে। মিরপুর, চট্টগ্রাম, পার্বতীপুর, সৈয়দপুরে বাঙালী-বিহারী দাঙ্গায় রক্তপাত হয়েছে। বাঙালীরা ক্ষুব্ধ, জঙ্গী। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে জাতির সত্তা ও চৈতন্য।

চট্টগ্রামের পলো গ্রাউন্ডে ন্যাপ প্রধান আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিশাল এক জনসভায় পরিষ্কার ঘোষণা দেন, এসব আলোচনা করে কোন ফল আসবে না। এ দেশের আজ কেউ আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে মানে না।

এই প্রেক্ষাপটে এগিয়ে চলছিল রণপ্রস্তুতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে ছাত্র ইউনিয়ন, গণবাহিনীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় কুচকাওয়াজ। মোট কথা, জাতি সেই উত্তাল সময়ে ছিল স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ মার্চ ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়