ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘ভোলা সাইক্লোন’ খ্যাত ভয়াল ১২ নভেম্বর

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১২ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ভোলা সাইক্লোন’ খ্যাত ভয়াল ১২ নভেম্বর

ছবি- রশিদ তালুকদার

শাহ মতিন টিপু : ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের গল্পে আজও শিউরে ওঠে উপকূলের মানুষ। এই ভয়ঙ্কর মহাপ্রলয় উপকূলীয় অঞ্চলে অবর্ণনীয় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিল। ইতিহাসে যা আজো ‘ভয়াল ১২ নভেম্বর’ নামে চিহ্নিত ।

কাগজে কলমে ‘ভোলা সাইক্লোন’ নামে খ্যাত এই ঘূর্ণিঝড় ছিল একটি শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, যা সিম্পসন স্কেলে 'ক্যাটাগরি ৩' মাত্রার ছিল।১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী এই ভোলা সাইক্লোনকে সর্বকালের সবচেয়ে মারণাত্মক চরম আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ।

সেই স্মৃতি বয়ে আজও যারা বেঁচে আছেন, কেবল তাদের মনেই গেঁথে আছে সেদিনের ভয়াবহতা। ধারণা করা হয়, সেই দুর্যোগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এর মধ্যে ভোলা জেলাতেই লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেদিন উত্তাল মেঘনা নদী আর তার শাখা-প্রশাখাগুলো লাশের নদীতে রূপান্তরিত হয়েছিল ।

ঘূর্ণিঝড়টি বঙ্গোপসাগরে ৮ নভেম্বর সৃষ্টি হয় এবং ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৮৫ কিমি (১১৫ মাইল) এ পৌঁছায় এবং সে রাতেই তা  আঘাত হেনে উপকূলে বিপর্যয় ঘটায়।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৭০ সালের ১১ নভেম্বর ছিল বুধবার। সারাদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে থাকে। পরদিন ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার আবহাওয়া আরো খারাপ হতে থাকে এবং মধ্যরাত থেকেই ফুঁসে উঠতে থাকে সমুদ্র। তীব্র বেগে লোকালয়ের দিকে ধেয়ে এল পাহাড়সমান উঁচু ঢেউ। ৩০-৪০ ফুট উঁচু সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে মানুষের ওপর। আর মুহূর্তেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষ, গবাদিপশু, বাড়িঘর এবং খেতের ফসল। পথে-প্রান্তরে উন্মুক্ত আকাশের নিচে পড়ে ছিল কেবল লাশ আর লাশ। কত কুকুর, শিয়াল আর শকুন খেয়েছে সেই লাশ, তার কোনো ইয়ত্তা ছিলনা।

সত্তরের সেই কালো রাতের কথা মনে হলে ধূসর স্মৃতিতে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে বলে স্মৃতি রোমন্থন করেন ভোলার দৈনিক বাংলার কণ্ঠ সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান।

তিনি তার স্মৃতি কথায় বলেন, ‘দেখেছি সাপ আর মানুষ দৌলতখানের চৌকিঘাটে জড়িয়ে পড়ে আছে। স্নেহময়ী মা তার শিশুকে কোলে জড়িয়ে পড়ে আছে মেঘনার পাড়ে। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে এক মহিলার লাশ ঝুলছে। এমনিভাবে মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সমগ্র জেলায় মানুষ আর গবাদিপশু বঙ্গোপসাগরের উত্তাল পানিতে ভেসে গেছে। জনশূন্য হয়ে পড়েছিল দ্বীপ ভোলা।’

সেই সময়কার প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভোলার সমস্ত জনপদ বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল আর নদীতে গবাদিপশুসহ বনি আদম সন্তান সারিবদ্ধভাবে পড়ে ছিল। তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকার ভোলা প্রতিনিধি ও বর্তমান দৈনিক বাংলার কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান প্রেরিত সচিত্র প্রতিবেদন ছিল ‘বাংলার মানুষ কাঁদো ॥ ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে মানুষের লাশ’। আর এ সংবাদ বিশ্ব জানতে পেরেছিল চার দিন পর। সেই চিত্রটি আজও ঢাকা প্রেস ইনস্টিটিউট-এ কালের সাক্ষী হিসেবে বাঁধানো রয়েছে।

প্রলয়ংকরী সেই  ঘূর্ণিঝড়ের পর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধ্বংসযজ্ঞ ও বেদনাহতদের দেখতে উপকূলে ছুটে যান, এসব দৃশ্য দেখে শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন।

বলা হয়, এটাই ছিল দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস। সেদিন ভোলা ছাড়াও উপকূলীয় হাতিয়া, রামগতি, চর আবদুল্লাহ, সন্দ্বীপ, বরগুনা, পটুয়াখালী ও চট্টগ্রামে ছিল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের স্বাক্ষর।

প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম এম সানাউল্লাহ্ নূরী তখন দৈনিক বাংলায় (প্রাক্তন দৈনিক পাকিস্তান ) সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন।

তিনি লেখেন, (সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পর)  ‘আমরা  রামগতি বাজারের নিকটবর্তী চর এলাকায় পৌঁছালাম। সেখানে স্তূপীকৃত লাশ এবং মৃত গবাদিপশুর যে হাল দেখলাম, তা ভাষায় অবর্ণনীয়। রামগতি বাজারের একজন শৌখিন ফটোগ্রাফার আমাকে ফুলের মতো ফুটফুটে চারটি শিশুর ছবি দিয়েছিলেন। সেটি আমি ছেপেছি দৈনিক বাংলায়।’

তিনি আরো লেখেন, ‘আমি আমার পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতার দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে থেকে একটানা কয়েক দিন ঢাকায় দৈনিক বাংলার জন্য রিপোর্ট পাঠাচ্ছিলাম। এতে কাগজের প্রচার সংখ্যা ত্রিশ হাজার থেকে এক লাখে উঠেছিল। চট্টগ্রামে সে সময় এক টাকা দামের কাগজ পাঁচ-ছয় টাকা বিক্রি হচ্ছিল। আমরা চর বাদাম, চর সীতা এবং চর জব্বরে ধানখেতগুলোতে  নাকেমুখে লোনা পানি লেপ্টানো হাজার হাজার লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি। সাগরে ভাসতে দেখেছি অসংখ্য লাশ। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা ও পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। একটি গাছের ৩০ ফুট উঁচু মাথায় অসহায় দুর্গত কুকুরকে দেখেছি হাহাকার করতে। কোথাও পানি উঠেছে ৪০ ফুট ওপরে। সারা দুনিয়ায় সংবাদপত্রের প্রধান সংবাদ হয়েছিল এই প্রলয় ভয়াল দুর্যোগের খবর।’

দেশের বরেণ্য রাজনীতিক বর্তমান বানিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ভয়াল ১২ নভেম্বরের পরদিনের দৃশ্যপট তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করে বলেন, ‘সকাল বেলা আমি নদীর পাড়ে গিয়ে অবাক ও বিস্মিত হলাম। শুধু কাতারে কাতারে মানুষের মৃতদেহ। অসংখ্য লোকের মৃতদেহ আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। আমরা দিশেহারা হয়ে গেলাম। এখনো স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে শিবপুর ইউনিয়নে রতনপুর বাজারের পুকুর পাড়ে শত শত লোককে দাফন করার দৃশ্য! এতো মৃতদেহ যে, দাফন করে আর কুলাতে পারছি না। যতদূর যাই শুধু মানুষের হাহাকার আর ক্রন্দন। এই শিবপুর ইউনিয়নে একটা বাড়ি যেখানে ৯০ জন লোক ছিল। কিন্তু বেঁচে ছিল মাত্র ৩ জন। সকলেই মৃত্যুবরণ করেছে। তখন তজুমদ্দিনের খবর পাই- শুনি যে, ৪০% লোকের মৃত্যু হয়েছে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ নভেম্বর ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়