ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মংলা-বুড়িমারী বন্দরে অবৈধ লেনদেন হয় ৩০ কোটি টাকা

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মংলা-বুড়িমারী বন্দরে অবৈধ লেনদেন হয় ৩০ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক : মংলা ও বুড়িমারী বন্দরে সেবা দিতে বছরে প্রায় ৩০ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয় বলে দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলা বন্দর ও বুড়িমারী স্থল বন্দরে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে বলেও দাবি করে সংস্থাটি।

রোববার টিআইবি’র প্রধান কার্যালয়ে মংলা বন্দর ও কাস্টম হাউজ এবং বুড়িমারী স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন: আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়।

সম্মেলনে এ দুটি বন্দর ও কাস্টমসের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির করা গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে কিন্তু দুর্নীতিবাজরা শাস্তি পায়। আমাদের দেশেও এমন নজির দরকার।

তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের কার্যক্রম আরও জোরদার করা দরকার। তবে যদি রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, তাহলে দুর্নীতি কমবে না।’

টিআইবির গবেষণায় বলা হয়, এ দুটি বন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সবগুলো ধাপেই শতভাগ  নিয়ম বহির্ভূতভাবে আর্থিক লেনদেন হয়। ২০১৬-২০১৭ সালে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রাক্কলনে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে কমপক্ষে ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা এবং মোংলা কাস্টমস হাউস থেকে কমপক্ষে ১৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে আদায় করা হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে।

অনুরূপভাবে, সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বুড়িমারী শুল্ক স্টেশনে দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকা এবং বুড়িমারী স্থল বন্দরে ৪৮ লাখ টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে আদায় করা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এছাড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন কর্তৃক বছরে প্রায় ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয় বলে গবেষণায় প্রাক্কলিত হয়েছে।

পণ্য ছাড় ও শুল্কায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া; সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাংশ এবং শ্রমিক, দালাল ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের একাংশের যোগসাজশে গড়ে ওঠা অসৎ চক্র; দুর্নীতির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ঘাটতি এবং পুরোপুরি ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় সেবা প্রদান ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটছে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে অনুযায়ী, আমদানিকৃত প্রায় শতভাগ পণ্যের ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায় করেছে উভয় প্রতিষ্ঠান। সকল নথিপত্র নির্ভুল থাকা সত্ত্বেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ না দিয়ে পণ্যের শুল্কায়ন বা পণ্যছাড় সম্ভব হয় না। নথিপত্রে কোন ভুল থাকলে অথবা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

বন্দরে পণ্য ছাড় ও শুল্কায়নের ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থ প্রদান ছাড়াও সংশ্লিষ্ট আরও কিছু ক্ষেত্রেও পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থ প্রদান করতে হয়। যেমন, মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন ট্রাক-প্রতি ন্যূনতম ৯০০ টাকা চাঁদা হিসেবে আদায় করে থাকে। দালালের সাহায্য ছাড়া বুড়িমারী স্থল বন্দরে ট্রাক ভাড়া পাওয়া যায় না বিধায় ট্রাক-প্রতি দালালকে প্রায় ৪০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়।

গবেষণায় দেখা যায়, মোংলা কাস্টমস হাউসে আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১৬টি এবং রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে ১২টি ধাপে নথি যাচাই-বাছাই ও অনুমোদন সম্পন্ন হয় যার ফলে সময়ক্ষেপণ, দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি ও দুর্নীতির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। আবার আমদানি পণ্যের শতভাগ কায়িক পরীক্ষণের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ, হয়রানিসহ পণ্যের মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী জাহাজ আগমন-নির্গমনে বিভিন্ন অনুমোদন ও মাশুল আদায় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে শুধু কাস্টমস হাউসে ন্যূনতম ৮টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘উভয় বন্দরেই ইতিবাচক কিছু অগ্রগতি ও পরিবর্তন হয়েছে যা সুশাসনের ঘাটতি সামান্য হলেও উন্নতির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পদক্ষেপ ও পদ্ধতির উপস্থিতির বিষটিও ইতিবাচক। কিন্তু এসব ইতবাচক অগ্রগতি ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উভয় বন্দরেই যোগসাজশের দুর্নীতি ও বলপূর্বক ঘুষ আদায়ের দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ গ্রহণ করেছে।’

সেবা প্রদান প্রক্রিয়া যত দীর্ঘ ও জটিল হয় সেবাগ্রহীতাদের দুর্নীতির শিকার হওয়ার ঝুঁকি তত বৃদ্ধি পায় উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, ‘সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সেবার আধুনিকায়ন, ডিজিটাইজেশন ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতার সাথে সেবা প্রদানকারীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের বাধ্যবাধকতা কমিয়ে আনতে পারলে দুর্নীতির সম্ভাবনা ও সুযোগ কমে যায়।’

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র পক্ষ থেকে শুল্কায়ন দ্রুত ও সহজতর করতে মোংলা বন্দর এলাকায় কাস্টমস হাউসের পূর্ণাঙ্গ কার্যালয় স্থাপন এবং প্রযুক্তির ব্যবহারকে প্রাধান্য দিয়ে পণ্যের শতভাগ কায়িক পরীক্ষণের পরিবর্তে দৈবচয়নের ভিত্তিতে আংশিক (১০%-২০%) পণ্যের কায়িক পরীক্ষণ করার সুপারিশ করে টিআইবি।

আট দফা সুপারিশের অপর উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ হলো: প্রয়োজনীয়তা পর্যালোচনা সাপেক্ষে বিভিন্ন স্তরে শূন্য পদের বিপরীতে নতুন জনবল নিয়োগ করা; প্রতি বছর সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর আয় ও সম্পদের বিবরণী প্রকাশ; বৈধ আয়ের সাথে সম্পদের অসামঞ্জস্যতার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ লেনদেন বন্ধে বন্দর ও কাস্টমসের সম্পূর্ণ এলাকা সার্বক্ষণিকভাবে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা ও দৃশ্যমান স্থানে মনিটর স্থাপন এবং সকল প্রকার মাশুল ও শুল্ক অনলাইনে এবং ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রহণ নিশ্চিত করা।

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন, টিআইবির উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান এবং আউটরিচ ও কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।

গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনজুর ই খোদা ও ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. খোরশেদ আলম।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮/এম এ রহমান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়