ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

মফস্বল সাংবাদিকের পেশাদারিত্ব এবং বাস্তবতা

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৩, ১৫ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মফস্বল সাংবাদিকের পেশাদারিত্ব এবং বাস্তবতা

খায়রুল বাশার আশিক: স্নাতক পড়াকালীন ঝুঁকে পড়েছিলাম লেখালেখিতে। পেশা হিসেবে পছন্দ করেছিলাম সাংবাদিকতা। কিন্তু বাবা-মা মেনে নিতে পারেননি। তাদের চোখে মফস্বল সাংবাদিকতা মোটেই কোনো সম্ভাবনাময় পেশা নয়। আমার বাবা উচ্চশিক্ষিত। সমাজের সব পেশা সম্পর্কে তিনি কম-বেশি ধারণা রাখেন। এই সময়ে এসে সাংবাদিকতাকে তিনি ভালো মানের পেশা হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। মা সরকারি চাকরিজীবী। তিনিও সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের কাজ সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন। তিনিও নিজের ছেলের পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে মেনে নিতে পারেননি।

আমার সচেতন বাবা-মা চান তার সন্তান সৎ পথে থেকে সততার সঙ্গে জীবনযাপন করুক। জীবনে কাড়ি কাড়ি ধন-দৌলতের প্রয়োজন নেই, তবে ন্যূনতম সম্মানজনক উপার্জন যেন থাকে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো— সাংবাদিকতায় সম্মান আছে, সৎ পথে থেকে জীবনযাপন করাও যাবে কিন্তু মোটামুটি সম্মানজনক উপার্জনের সম্ভাবনা এখানে নেই। পরিবার নিয়ে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকা এখানে কষ্টসাধ্য। মায়ের মুখে শোনা একটি ঘটনা তুলে ধরছি। একদিন মা’র অফিসে একজন সাংবাদিক এলেন। পরিচয় দিয়ে অফিসিয়াল কিছু তথ্য জানতে চাইলেন। কাগজপত্র তাকে বুঝিয়ে দেয়া হলো। কোনো গড়মিল না পেয়ে তিনি চলে গেলেন। মিনিট তিনেক পর ফিরে এসে তিনি অফিস সহকারীকে ডেকে বললেন, তার মটর সাইকেলের তেল খরচ বাবদ যদি কিছু টাকা...। কিন্তু অফিস থেকে এভাবে টাকা দেয়ার নিয়ম ছিল না। ফলে তিনি ক্ষুণ্ন মনে ফিরে গেলেন। সেদিনের ঘটনার পর থেকে আমার মা’র মনে ধারণা জন্মেছে সব সাংবাদিক বুঝি এভাবেই জীবন চালান? এই ঘটনা বলেই মা থেমে থাকেননি। জানতে চেয়েছিলেন, আমার বেতন কত? বলার পর তার মুখে হতাশার ছাপ আমি স্পষ্ট দেখেছি।

মফস্বল সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব নেই বলে আমার বাবার অপছন্দের পেশা এটি। পাশাপাশি মফস্বল সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও তার প্রশ্ন রয়েছে। যদিও সবাই যে এমন হবেন, তা তিনি মনে করেন না। অনেক উচ্চশিক্ষিত লোক নিশ্চয়ই মফস্বল সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন এবং তারা ভালোও  করেন। কিন্তু এটা তো এড়িয়ে যাওয়া যায় না যে, কোনো রকমে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেই যদি এদেশে সাংবাদিক হওয়া যায় তাহলে উচ্চশিক্ষিতরা কেন এই পেশায় আসবেন? মোটকথা, আমাকে নিয়ে মা-বাবা গর্ব করতে পারলেও আমার পেশা নিয়ে তাদের গর্বের জায়গা নেই। তারা এ কারণে চিন্তিত। কারণ পেশাদারিত্বের বাস্তবতা আজ কিছু মানুষের কারণে প্রশ্নের সম্মুখীন। কিন্তু আমিও চাই আমার পেশা নিয়ে গর্ব করতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মিডিয়া মালিক বা পরিচালক নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে তৃণমূল সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, আচার-আচরণ, পেশাগত শিষ্টাচার, দক্ষতা চিন্তা করেন বলে মনে হয় না। কোনোরকম রিপোর্ট পাঠাতে পারলেই তাকে আইডি কার্ড দিয়ে দেন। সঙ্গে দেন বুম, লোগো, আর বাইকে লাগোনোর জন্য স্টিকার। আর তারাও এগুলো নিয়ে চষে বেড়ান মাঠ-ঘাট। সংসার কীভাবে চলে নিয়োগদাতা কখনও খোঁজ নেন না। তবু জীবন থেমে থাকে না। অথচ এদের নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো নেই, কোনো ওয়েজবোর্ডও নেই এবং এগুলো মেনে নিয়েই মফস্বল সাংবাদিকরা কাজ করে যাচ্ছেন। এটাই বাস্তবতা। কন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে তারা তাদের জীবন চালাচ্ছেন? কিছু পত্রিকা রয়েছে যারা মফস্বল সাংবাদিকদের সম্মানী দেন। তার পরিমাণ কত শুনবেন? মাসে দুই থেকে পাঁচ হাজার টকা। মনে রাখবেন, এখানে জেলা প্রতিনিধিদের কথা বলছি না। এখন আমার প্রশ্ন হলো- একবার ভেবে দেখেছেন, তাদের পরিবার কিভাবে চলে?  অথচ অনেক সময় সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে নিজের পকেট থেকেই টাকা খরচ করতে হয়। বেতনের টাকায় মোটর সাইকেলের তেলের দামও হয় না। অথচ দিব্যি তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। অল্প বেতনের কথা বাদ দিলাম, মফস্বল সাংবাদিকদের এক টাকাও বেতন দেন না এমন মিডিয়া হাউসের সংখ্যা অনেক। এদের মধ্যে অনেক নামি প্রতিষ্ঠানও আছে। তাহলে যারা একেবারে তরুণ, যারা চোখে স্বপ্ন নিয়ে এ পেশায় আসে, ভালো কিছু করতে চায়, তারা কী করবে? কীভাবে তারা স্বপ্ন দেখবে সাংবাদিকতা নিয়ে?

এবার একটু বলি শহুরে সাংবাদিকতার কথা। সেখানে মেধাবী, শিক্ষিত, সৃজনশীল না হলে এই পেশায় টিকে থাকা কষ্টকর। তাই দক্ষতা দিয়েই সংবাদমাধ্যমে টিকে থাকতে হয়। ফলে সেখানে মোটা অঙ্কের সম্মানীর ব্যবস্থা থাকে। কেউ কেউ ওয়েজবোর্ডও দেন। কিন্তু খোঁজ নিলে জানা যাবে, একই প্রতিষ্ঠানে একজন সাংবাদিক ওয়েজবোর্ড পাচ্ছেন, অন্যজন পাচ্ছেন না। কি হাস্যকর! অনেক প্রতিষ্ঠান তো নিয়মিত সাংবাদিকদের বেতনও দিতে পারে না। তারপরও মিডিয়া চলছে। প্রতিদিন সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। আমার এই কথাগুলো অনেকের হয়তো ভালো লাগবে না। কিন্তু বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমরা চাইব, সব মিডিয়া হাউস যেন মফস্বল থেকে শুরু করে সম্পাদক পর্যন্ত সবাইকে মানসম্মত সম্মানী দেয়। তবেই তো পেশাদারিত্ব আসবে। কম সম্মানী দিতে হবে বা সম্মানী দিতে হবে না এ কারণে অযোগ্য লোকের হাতে সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব দিলে শেষ পর্যন্ত মিডিয়ারই ক্ষতি। এই ক্ষতি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। আর যদি আপনি সম্মানী দিতে না পারেন তাহলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিন। কেননা অযোগ্যদের কারণে মিডিয়া তার গৌরব হারাচ্ছে। ‘সাংবাদিক’ শব্দটিও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ এই পেশা সম্মানজনক। মনেপ্রাণে এই পেশাকে ভালোবেসেছিলাম। এখনও সেই ভালোবাসা অটুট আছে বলেই কথাগুলো বলছি। 

মফস্বলে কর্মরত সবাই যে অদক্ষ তা নয়। ভালো মানের অনেক সাংবাদিক রয়েছেন। তবে তারা অন্যদের দাপটে কোণঠাসা। কিসের দাপট এখানে আর বললাম না। মালিকপক্ষের এগুলো অজানা নয়। মা-বাবার মত মেনে নিয়ে আমি হয়তো সাংবাদিকতায় ক্যারিয়ার গড়ব না। কিন্তু আপনারা যারা এখন এই পেশায় আছেন, তাদের উচিত তরুণদের জন্য বিষয়টি নিয়ে ভাবা। চলুন, সেই দিন সৃষ্টি করি যেদিন সন্তান সাংবাদিকতায় আগ্রহী হলে বাবা-মা’র মুখ উজ্জ্বল হবে। প্রতিটি মানুষ সাংবাদিকতাকে যেন সম্মানের চোখে দেখে, চলুন সেই পরিবেশ ফিরিয়ে আনি। এজন্য সবার আগে আপনাদেরকেই সচেতন হতে হবে।

লেখক : সংবাদকর্মী

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ মে ২০১৯/তারা/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়