ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

মা আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০২, ৫ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মা আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক

|| জাহাঙ্গীর আলম বকুল ||

একজন মানুষের জীবনে যে ক’জন ব্যক্তির অবদান বেশি থাকে, তাদের মধ্যে শিক্ষক অন্যতম। মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক শিক্ষকের সহচার্যে আসে, তাদের কাছ থেকে সৃজনশীলতা, মহানুভবতা, নীতি-আদর্শের শিক্ষা পেয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে এবং সেই শিক্ষা দ্বারা সারাজীবন পরিচালিত হয়। মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে শিক্ষাঙ্গন এবং শিক্ষকের সহচার্য গুরুত্বপূর্ণ।

শিশু যখন অচেনা-অজানা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়, তখন সে থাকে অসহায়। কোনো শিক্ষা সে মায়ের গর্ভ থেকে নিয়ে আসে না। এরপর বাবা-মা, স্বজনদের স্নেহ-মমতায় একটু একটু করে বড় হতে থাকে এবং প্রতিনিয়ত শিখতে খাকে। সে শেখে পরিবার, সমাজ এবং পারিপার্শ্বিকতা থেকে। শেখে শিক্ষালয় এবং শিক্ষকের কাছ থেকে। এই শিক্ষাই তার সারা জীবনের পাথেয়। শিক্ষার বড় অংশই লাভ করে শিক্ষকের কাছ থেকে। সেই শিক্ষক তার কাছে সারা জীবনই শ্রদ্ধেয়।  

মধ্যযুগের কবি শাহ মুহম্মদ সগীর কবিতার পঙ্‌ক্তিতে লিখেছেন: ‘ওস্তাদে প্রণাম কারো পিতা হন্তে বাড়।/দোসর-জনম দিলা তিঁহা সে আক্ষার॥’  কবি জ্ঞান বা বিদ্যার্জনের জন্য শিক্ষকদের ভূমিকায় তিনি তাদের দ্বিতীয় জন্মদাতার মর্যাদা দিয়েছেন। সত্যিই তাই, জন্মদাতা পিতা জন্ম দিয়ে থাকেন, কিন্তু তাকে সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে উঠতে বেশি সহযোগিতা করেন শিক্ষক। এ সম্পর্কে নবী করিম (স.) যথার্থই বাণী দিয়েছেন: ‘দুই ব্যক্তি ব্যতিত অন্য কারো পদ-গৌরব লোভনীয় নয়। তা হলো: ১. ধনাঢ্য ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন এবং তা সৎপথে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন। ২. ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ বিদ্যা দান করেছেন এবং সেই অনুসারে সে কাজ করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’

আজ আমাদের সমাজে অনুসরণীয় মানুষের অভাব। শিশু তার কোমল মনোজগতে কিছু মানুষকে আদর্শ মেনে নেয়। নিজের অজান্তে তাকে অনুসরণ করতে থাকে। সেই মানুষটি তার শিক্ষক। সে তাকে অনুকরণ এবং অনুসরণ করে। সেই জন্য একজন শিক্ষককে অন্য দশজনের থেকে আলাদা হতে হয়। এ জন্য এখনো সমাজে শিক্ষকেরা মর্যাদার এবং শ্রদ্ধেয়। শিক্ষকেরা শিক্ষা দেন এবং শিশুদের অন্তরের অন্ধ চোখ খুলতে সহযোগিতা করেন। তারা জ্ঞানের আলোয় যুগের সব অন্ধকার দূর করে মানুষের জন্য সভ্য জগৎ সৃজন করেন। শিশুরা শিক্ষকের উপর সবচেয়ে আস্থা রাখে এবং শিক্ষকের নীতি-আদর্শকে নিজের মধ্যে ধারণ করে। 

ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহ.) শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা কেমন হওয়া উচিত, তা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার শিক্ষক ইমাম হাম্মাদ (রাহ.) যত দিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন আমি তার বাড়ির দিকে পা মেলে বসিনি। আমার মনে হতো, এতে যদি শিক্ষকের প্রতি আমার অসম্মান হয়ে যায়।’ হাদিস শরীফে আল্লাহ এবং রসুলের পর বিদ্যা অর্জনকারী এবং প্রচারকারীকে মহানুভব ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হাদীস শরিফে বর্ণিত আছে: ‘আল্লাহর পরে, রাসুলের পরে ঐ ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব, যে বিদ্যার্জন করে ও পরে তা প্রচার করে।’

আমরা যারা প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন পেরিয়ে এসেছি, তারা বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছি। সেই ব্যক্তিই ভাগ্যবান যিনি আদর্শবান শিক্ষকের সহচার্য পেয়েছেন। সেই বিচারে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা প্রত্যন্ত গ্রামে। উপজেলা শহর থেকে কয়েকটি গ্রাম পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। যে সময় আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে, যা আজ থেকে দু’-আড়াই যুগ আগে, যখন বিদ্যুতের ঝলমলে আলো দেখতে হলে হাঁটু কাদা মাড়িয়ে কয়েক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে শহরে আসতে হতো। গ্রামে বড় হওয়ার সুবাদে প্রকৃতির কাছে থাকতে পেরেছি এবং গ্রাম-বাংলার মাঠ-প্রান্তর, বৃক্ষ-বনানী, সহজ-সরল মানুষের ভালোবাসা হৃদয়ে গেঁথে ফেলেছি। আজ যত দূরে যাই না কেন, মাটি মানুষের সেই টান অনুভব করি।

আমার গ্রামের মধ্যে খেলার বিশাল মাঠ আছে। এই মাঠ ঘিরে হাইস্কুল, সরকারি প্রাইমারি স্কুল, ডাকঘর এবং ইউনিয়ন পরিষদ ভবন অবস্থিত। পরে সেখানে বাজারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা যারা গ্রামে পড়াশোনা করতাম, ওই খেলার মাঠ ঘিরে ছিল আমাদের জগৎ। খেলাধুলা, আড্ডা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সেখানে হতো। বহু স্মৃতি এই স্কুল এবং মাঠ ঘিরে রয়েছে।

আমি যখন ওই সরকারি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র, তখন প্রতিদিন সকালে বগলে বই এবং ছোট মাদুর নিয়ে স্কুলে যেতাম। ক্লাসে ওই মাদুর বিছিয়ে বসতাম। ক্লাস থ্রি থেকে মিলত বেঞ্চ। আগের দু-তিন ক্লাস মাদুর। গ্রামের স্কুল। ভালো ছাত্র না হলেও সহপাঠীদের থেকে ক্লাসে কিছুটা পড়া পারতাম। আর তাতেই শিক্ষকদের নজরে পড়ে গেলাম। ফলে ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকের স্নেহ-ভালোবাসা কী, সেটা আমি সেই প্রাইমারি স্কুল জীবনে দেখেছি। সেদিন ছোট ছিলাম, বুঝতে পারিনি। আজ যখন পিছনের দিকে তাকাই, তখন দেখি- দুষ্টুমি, দস্যিপনা করেছি, আমার সেদিনের শিক্ষকেরা অপত্য স্নেহে হাসতে হাসতে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

আমার একজন শিক্ষক ছিলেন, রহিম স্যার, আমাদের গ্রামেরই, তিনি আমাকে বাড়াবাড়িমাত্রায় স্নেহ করতেন। আমি ক্লাসে প্রথম বা দ্বিতীয় বেঞ্চে বসতাম। প্রথম দিকে আমাকে ক্লাসের পড়া দিতে হতো। আমি যেদিন ক্লাসে পড়া পারতাম, রহিম স্যার সেদিন আমার সহপাঠীদের পড়া না পারার জন্য শাস্তি দিতেন। আমি পড়া না পারলে কাউকে শাস্তি দিতেন না। তা না হলে যে আমাকে দিয়ে শুরু করতে হবে।

আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। স্কুলের জন্য কয়েকটি নতুন বেঞ্চ এলো। যেহেতু নতুন বেঞ্চ, সব ক্লাসের ছাত্ররা ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজেদের ক্লাসে বেঞ্চ নেওয়ার জন্য। আমরাও। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে শিক্ষকেরা প্রয়োজন অনুসারে আমাদের ক্লাস ছাড়া বাকি সব ক্লাসে দু-একটি করে বেঞ্চ ভাগ করে দিলেন। এটা আমাদের খুব লাগল। বিশেষ করে আমার। স্যার এমন কেন করবেন? যথারীতি হেড স্যার ক্লাস নিতে এলেন। আমি তখন ক্ষোভে-কষ্টে জ্বলছি। প্রতিবাদ তো করতেই হবে। সেদিন আমি বসেছিলাম প্রথম বেঞ্চে। স্যার ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন আর আমি বেঞ্চে রাখা বইয়ের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করলাম। কিছুক্ষণ হলো স্যার কিছু বলছেন না। তিনি কিছু না বললে আমার প্রতিবাদও মাত্রা পায় না। হয়ত স্যার খেয়াল করেননি। কিছুক্ষণ পরে নজরে আসতেই জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কী হয়েছে? মাথা তুলে মিথ্যা বললাম, মাথা ব্যথা করছে। স্যার সম্ভবত আগেই সব বুঝতে পেরেছিলেন। শুধু একটু হাসলেন। আর কিছু বললেন না। এই হলেন আমার ওদুদ স্যার। ‍যিনি সেদিন পিতৃস্নেহে ছোট মনের ক্ষোভ জয় করেছিলেন। স্যার আজ আর আমাদের মধ্যে নেই।

সেদিনের সেই শিক্ষকদের ছাত্রের প্রতি কতটা ভালোবাসা ছিল, তা অনুধাবন করতে পারি আরেকটি ঘটনায়। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন কাশেম স্যার। স্যারের বাড়ি স্কুল থেকে দূরে হওয়ার তিনি পরিবার নিয়ে স্কুলে থাকতেন। আমার এক বন্ধু ছিল আরিফুল, দূরের একটি গ্রাম থেকে স্কুলে আসত। একদিন ক্লাসে কোনো এক কারণে কাশেম স্যারের সঙ্গে তর্ক করায় আরিফুলকে মার খেতে হয়েছিল। সেদিন আরিফুল প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। ছুটির পর আমরা বাড়ি চলে আসি। যথারীতি বিকেলে মাঠে খেলতে গিয়ে কাশেম স্যারের সঙ্গে দেখা। স্যার আমাকে দেখে নিজে থেকেই অভিমানী কণ্ঠে বললেন, দেখছো বকুল। ওই বেয়াদবটা স্কুল শেষে ওর দামি কলমটা (তখন কালি ভরা যায় এমন কলম বেশ দামি ছিল) ক্লাসে ভেঙে রেখে গেছে।

আমি বুঝতে পারছিলাম না। স্যারের দিকে তাকিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। স্যার আবার বললেন, ওই আরিফুল। বুঝলাম ছাত্রকে শাস্তি দিয়ে স্যারের মধ্যে অনুশোচনা কাজ করছে। তারপর আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে শুধু বললেন, ওকে এভাবে না মারলেও পারতাম। বলেই স্যার দ্রুত পায়ে চলে গেলেন।

হেরেও যে জেতা যায়, তার প্রথম শিক্ষা আমি শিক্ষকদের কাছে পেয়েছি। আমরা তখন ক্লাস টেনে পড়ি। স্কুলের সব ছাত্রদের বড় ভাই। আমাদের মৌলভী শিক্ষক অবসরে যাওয়ায় তার বিদায়ের অনুষ্ঠানের দিন নির্ধারিত হলো। বড় হিসেবে আমরা সব আয়োজন করলাম। শেষ মুহূর্তে কয়েকজন শিক্ষক মত দিলেন, যেহেতু খুব ছোট পরিসরে ঘরোয়া অনুষ্ঠান সেহেতু মাইকের প্রয়োজন নেই। সেই সময় গ্রামে মাইক পাওয়া সহজ ছিল না। বিষয়টা আমাদের মনোঃপূত হলো না। আমাদের ক্লাসের সবাই ওই অনুষ্ঠানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের অভিমান ভাঙাতে দু’-তিনজন শিক্ষক এগিয়ে এলেন। আমরা অনঢ়। বিষয়টা শেষ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের কাছে নিয়ে গেলেন শিক্ষকেরা। প্রধান শিক্ষক শুনেই সোজা বলে দিলেন, ওরা যা বলছে, করতে দিন।

মনে মনে একটু গর্ব অনুভব করলাম। তখন বুঝতে পারিনি- প্রধান শিক্ষক আসলে আমাদের ছোট মন জয় করে নিলেন। অনুষ্ঠান শেষে যখন সবার বাড়ি ফেরার পালা, তখন মনে হলো শিক্ষকের সঙ্গে এমন আচরণ করা ঠিক হয়নি। কয়েকজন বন্ধু মিলে ওই শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাইতে গেলাম। মাথা নিচু করে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক স্যার এগিয়ে এসে হাসতে হাসতে বললেন, সব কিছু তো ভালোভাবে সম্পন্ন করেছ।

বললাম, হ্যাঁ স্যার। আমরা এসেছিলাম আপনার কাছে...
স্যার কথা শেষ করতে দিলেন না। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, যাও বাবা। অনেক পরিশ্রম করেছ, এবার বাড়ি যাও। মাথা নিচু করে সবাই বের হয়ে এলাম।

আমার গ্রামের সেই ভাঙা স্কুল এখনো আছে। আমরা একদিন সেখানে যেমন পড়তাম, আজকের শিশুরাও তেমনই পড়ছে। কিন্তু সেদিনের সেই শিক্ষকেরা নেই। সবাই নতুন শিক্ষক। আজকের আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার মধ্যে সেদিনের সেই ছাত্র-শিক্ষকের মান-অভিমান, স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন, ছাত্রদের প্রতি পিতৃস্নেহ আছে কি না জানি না।

সেই ভাঙা স্কুলের স্বল্প বেতনের শিক্ষকদের কাছ যা পেয়েছিলাম, যা মনে গেঁথে নিয়েছি, যা ভুলিনি এবং আমৃত্যু ভুলতে পারব না। শিক্ষা জীবনের এমন শত শত স্মৃতি আছে, যা স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়, সেই চেষ্টাও করিনি।

শুধু আমার নয়, প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন স্মৃতি আছে। তবে আমি মনে করি সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমার শিক্ষক আমার মা। তিনিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। যে মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, এই অচেনা-অজানা জগৎকে একটু একটু করে চিনতে শিখিয়েছেন, ভালো-মন্দের পার্থক্য জানিয়েছেন, যার ত্যাগে আজ আমি ধরাধামে বিচরণ করছি- তিনিই আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনিই আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।

এই মাকে নিয়ে লেখার সংযত আবেগ এবং উপযুক্ত শব্দ আমার জানা নেই। এতটা ঋদ্ধ নিজেকে করতে পারিনি। শুধু এটুকু জানি, মা-ই আমার আমৃত্যু শিক্ষক। সারা জীবন তার কাছ থেকে ধৈর্য্য, বিনয় এবং সহনশীলতার শিক্ষা পেয়েছি। আর আজ শিখছি- কীভাবে মানুষকে ক্ষমা করতে হয়, সেই শিক্ষা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ অক্টোবর ২০১৮/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়