ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মাদক নির্মূলের যুদ্ধে জিততে হবে

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৩, ২৯ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাদক নির্মূলের যুদ্ধে জিততে হবে

জাফর সোহেল : কিছুদিন হলো বংলাদেশে একটা যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে এরই মধ্যে নিহতের সংখ্যা শতক ছুঁইছুঁই। পুলিশের ভাষায় এর নাম ‘বন্দুকযুদ্ধ’। গণমাধ্যমের ভাষায়ও তাই। পুলিশের ভাষা আর গণমাধ্যমের ভাষা কী করে এক হলো তা কিছুটা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তবে একটা পক্ষের কাছে এর নাম ঠিক বন্দুকযুদ্ধ নয়। তারা বলছেন, এটি একপক্ষীয় যুদ্ধ, বন্দুকযুদ্ধ  হয় দুই পক্ষের মধ্যে। মতদ্বৈততার সাহস দেখানো পক্ষটিতে আছে দুই ধরনের লোক। এক, যাদের লোক মারা যাচ্ছে; দুই, যারা মানবাধিকারের কথা বলেন। যাদের লোক মারা যাচ্ছে তারা তো বলবেনই, আমার হলে আমিও বলতাম। কিন্তু মানবাধিকারের পক্ষে যারা কথা বলেন, তাদের একটু গুরুত্ব দিতেই হয়। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ কয়েকবার বলেছেন, ‘‘আমরা কাউকে ‘ক্রস’ দিচ্ছি না, আমাদের বাহিনী আত্মরক্ষার্থে গুলি করছে।”

সুতরাং পত্রপত্রিকার ভাষ্যমতে ১৫ মে শুরু হওয়া এই যুদ্ধের আরেক নাম আসলে ‘আত্মরক্ষার যুদ্ধ’। বন্দুকযুদ্ধ, আত্মরক্ষার যুদ্ধ, একপক্ষীয় যুদ্ধ- যাই হোক, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে এই যুদ্ধ এখন আলোচনার বড় খোরাক। দেশের গণমাধ্যমও নিরুত্তাপ রমজানে উত্তাপ ছড়ানো কিছু খবর পাচ্ছে। প্রতিদিন সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটা এক ধরনের খেলা। প্রশ্ন হলো, এই খেলা মাঠে গড়ানোর দরকার কতটা ছিল? কিংবা থাকলেও যথাযথ উপায়ে খেলাটা হচ্ছে কি না? বাংলাদেশে মাদক যে কতটা থাবা ছড়িয়েছে তা সম্ভবত এদেশের প্রতিটি নাগরিক মাত্র স্বীকার করবেন। গতকালও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, মাদকাসক্ত সন্তানের আচরণে টিকতে না পেরে পুলিশে দিয়েছেন বাবা। এমন বাবা বাংলাদেশে অনেক আছেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে ভারী অস্ত্র চালানো এক মুক্তিযোদ্ধা বাবা আমাকে একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে হানাদার আর রাজাকার মেরে সাফ করে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু নিজের মাদকাসক্ত সন্তানকে কিছুই করতে পারছেন না। এটা তার কাছে জীবনের একটা বড় ধরনের পরাজয়। তার আফসোস, পরাজিত জীবন নিয়েই তাকে মরতে হবে!

বাংলাদেশের বাবাদের এমন অসহায়ত্ব সত্যি বেদনার। এই বেদনা হ্রাসে সরকার অতীতে কী করেছে, না-করেছে তার চেয়ে বড় কথা হলো এখন কী করছে। এখন তারা এর বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছেন। এই অভিযান সমর্থন করছেন দেশের অধিকাংশ নাগরিক। সমর্থকদের এই তালিকায় বহু শিক্ষিত বিদগ্ধজনও আছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটু ঢুঁ দিলে যে কেউ এর প্রমাণ পাবেন। সাধারণ মানুষের এই আবেগের প্রতিফলন ঘটছে গণমাধ্যমেও। এখানেও অনেকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ স্টাইলে খবর পরিবেশন চলছে। অবশ্য দুএকটি গণমাধ্যম কিছুটা ব্যতিক্রমী বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করছে। তবে তারা যে প্রশ্ন করছে, বা তুলছে এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মাধ্যমে অন্তত বলা হচ্ছে যে, মানবাধিকারের পক্ষের লোকেরা যে আপত্তি বা প্রশ্ন তুলছে তার একটা ভিত্তি আছে। তবে আশপাশের মানুষ, চা দোকানের আড্ডা কিংবা ইফতারির মিলন মেলায় নানা শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপে যতটুকু বুঝতে পারলাম- এদেশের বেশিরভাগ মানুষ চায় কিছু একটা সরকার করুক, যার মাধ্যমে মাদকের অভিশাপ থেকে জাতি কিছুটা হলেও মুক্ত হতে পারে। এই অভিযানেই যে সব ঠিক হয়ে যাবে তা তারা কেউ মনে করছেন না। তবে মাদকের কারবারিদের মধ্যে যে ভীতি সঞ্চার হবে বা হচ্ছে এটাকেই তারা ইতিবাচক ফল হিসেবে দেখতে চান। এমনকি পরিচিত অনেক পাড়া মহল্লায় মাদকাসক্তদের আড্ডা এরই মধ্যে কমে গেছে বলে অনেকে বিভিন্নভাবে জানাচ্ছেন। সুতরাং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় আত্মরক্ষার এই যুদ্ধকে জনগণও আত্মরক্ষামূলকই মনে করছে।

আবার এই জনগণই সামাজিক মাধ্যমগুলো গরম করে রেখেছে একটা প্রশ্ন দিয়ে- ‘চুনোপুটি মেরে কী হবে, রাঘব-বোয়ালরা কই?’ চলমান অভিযানে এখন পর্যন্ত মানুষের অসন্তুষ্টির জায়গা এই একটাই। কেউ কেউ স্পষ্ট করে বলছেন, কক্সবাজারের একজন সাংসদের সংশ্লিষ্টতার কথা। তার কেন কিছু হচ্ছে না? এই প্রশ্নটি এতটাই উচ্চারিত যে, শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ মুখ খুলেছেন। বলতে বাধ্য হয়েছেন, তার বিরুদ্ধে যা শোনা যায় তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। যাই হোক, মাদক নির্মূলে সম্ভাব্য সব শত্রুর বিপক্ষেই সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ হবে এটাই প্রত্যাশিত।

একটা বিষয় এখানে পরিষ্কার করা দরকার। সাধারণ মানুষের আবেগ অনুভূতিই কিন্তু সবসময় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচ্য নয়। মনে রাখতে হবে, সাধারণের আবেগও নানাভাবে প্রভাবিত হয়। অনেক সময় সেই আবেগে ভুল থাকে। সাধারণের ভুল আবেগকে সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হয় রাষ্ট্রকে বা এর সুশীল সমাজকে। মানুষ সমর্থন করছে বলেই মাদক নির্মূলের এই একটি মাত্র উপায় আছে বলে একেবারে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না। যে মাদকটির কথা বলা হচ্ছে, এদেশের মানুষ তা বানায় না। এদেশে মাদক আসে বাইরের দেশ থেকে। সেসবের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা, কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে? আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী যে সংস্থা আছে সেখানে কি আমরা কোনো নালিশ করেছি? আর সেগুলো দেশের ভেতরে কীভাবে আসে, কারা নিয়ে আসে, কারা সহায়তা করে- এসব নিয়ে গভীরভাবে কাজ হওয়ার কথা। সেই কাজ কতটুকু হয়েছে? মাদক নির্মূল নয়, প্রতিকার-প্রতিরোধ বলেও তো কিছু বিষয় আছে। সেই কাজগুলো তো ঠিকঠাক হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। যদি হতো তাহলে সারাদেশে এভাবে মাদকের রমরমা ব্যবসা চলতে পারত না। যারা উৎস বন্ধের বিষয়ে কাজ করার কথা তারা ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার জবাবদিহিতা কি তারা দিয়েছেন? আমরা সবাই জানি, বাংলদেশে ইয়াবা বলি আর ফেনসিডিল বলি, বেশিরভাগ আসে সীমান্ত দিয়ে। সেখানে আমাদের বিজিবি এবং সীমান্তবর্তী থানা-পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে এগুলো ঠেকানো। কেন সারাদেশে মাদক ছড়িয়ে পড়ল, সীমান্তে তাঁরা কে কী দায়িত্ব পালন করেছে- তার জবাব চাওয়া হোক। আগামীতে যাতে সীমান্তজুড়ে দায়িত্ব পালনে কোন অবহেলা না থাকে সে বিষয়েও এখনই সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হোক।

সাঁড়াশি অভিযানের বিষয়ে মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্ন সেটি হলো, খুচরা বিক্রেতাদের দমন করে কী হবে? বড় বড় ডিলাররা তো ঠিকই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এমনকি অনেকে অভিযানের প্রকাশ্য ঘোষণায় আগেই সতর্ক অবস্থানে চলে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, খুচরা বিক্রেতা নয় শুধু, যারা মাদক সেবন করে তাদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত। তাহলে যে কাজটি হবে, বড় ডিলাররা আর ইয়াবা বিক্রির লোক খুঁজে পাবে না, খুচরা বিক্রেতারা ক্রেতা খুঁজে পাবে না। ব্যবসা লাটে উঠবে। তবে হ্যাঁ, সবার প্রতি সমান বিচারের প্রত্যাশা মানুষের থাকতেই পারে। সে প্রত্যাশা মেটাতে গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। আবার সমাজে প্রায়ই দেখা যায়, বড়দের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলে ছোটরা এমনিতেই চুপসে যায়। এই চিন্তা থেকেও বড় বড় উইকেটের পতন হওয়া দরকার।

যে কোনো কর্মেরই একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। আবার সব কর্মই সুচারুরূপে সম্পাদন নাও হতে পারে। সুতরাং এই অভিযানেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম নয়। যে অভিযোগগুলো উঠে এসেছে সেগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত। আশার কথা, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সেসব তদন্ত করে দেখবে বলে জানিয়েছেন। তারপরও কথা থেকে যায়। এই ধরনের একটি বড় অভিযানের আগে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের কতটা সতর্ক করা হয়েছে বা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে- সে প্রশ্নটিও থেকে যায়। প্রশ্ন আছে গোটা অভিযানের সমন্বয় ঠিকঠাক হচ্ছে কি না তা নিয়েও।  এটা সাফল্যকে ম্লান করবে। এই ধরনের অভিযানে সমন্বয় না থাকলে, একটাও নিরাপরাধ মানুষ মারা গেলে বা অন্যায়ভাবে হয়রানির শিকার হলে তার দায় কে নেবে? টেকনাফের যে কাউন্সিলর মারা গেলেন ইতিমধ্যে এই মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জেগে ওঠা প্রশ্নগুলোকে মাটিচাপা দেয়ার চেষ্টা না করে সতর্ক হতে দোষ নেই। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে চালু হওয়া এই অভিযানের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে ভালো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সত্যিকার অর্থেই তারা একটি শুদ্ধি অভিযানে নেমেছেন, যার বিকল্প এই মুহূর্তে তাদের কাছে নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তাদের আন্তরিকতারও অভাব নেই এ ক্ষেত্রে। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটছে। সুতরাং মাঠ পর্যায়ের  কর্মকর্তাদের আরেকটু সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। দুর্নীতিপরায়ণদের বিরুদ্ধে বেশি সতর্ক থাকতে হবে এবং বিভাগীয় নজরদারি বাড়াতে হবে। এমন একটি অভিযানের পরও যেন দেশে আগের মতোই মাদকের বিস্তার ঘটার সুযোগ না থাকে সে পথগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। মাদক সমাজের ভয়াবহ ব্যাধি। সমাজ থেকে এই ব্যাধি অবশ্যই নির্মূল করতে হবে। এবং তা আমাদের তরুণ প্রজন্মের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে।

লেখক: সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়