ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মায়ের ঠিকানা যখন বৃদ্ধাশ্রম

ঝুমকি বসু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ১২ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মায়ের ঠিকানা যখন বৃদ্ধাশ্রম

ঝুমকি বসু : ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার,
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার আর ওপার।
নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি,
সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি।
ছেলে আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম-
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’ – নচিকেতার বিখ্যাত একটি গানের কথা।

আরিফা বেগম। বয়স আশি ছুঁই-ছুঁই। এক ছেলে, এক মেয়ে। স্বামী মারা গেছেন একুশ বছর আগে। মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে পাকাপাকিভাবে সংসার গড়েছে। আর ছেলে উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার। সাজানো-গোছানো এক সুখী সংসার ছিল একসময় তার। ছেলে-মেয়েকে মানুষ করেছেন মনের মতো করে। কিন্তু আসলেই কি ছেলে-মেয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়েছে? স্বামী মারা যাওয়ার পর একদিন তার উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী ছেলে তাকে পাঠিয়ে দেয় বৃদ্ধাশ্রমে। তার বিরুদ্ধে নাতি-নাতনি, পুত্রবধূর হাজারো অভিযোগ। তাদের তথাকথিত আধুনিকতার সঙ্গে নিজেকে মানাতে পারেন না আরিফা বেগম। ফলে তার জায়গা হলো না তাদের দুই হাজার স্কয়ার ফিটের বাসায়।

বৃদ্ধাশ্রমে বসেও মন মানে না আরিফার। ছেলের জন্য কাঁদেন। একটিবার ছেলেকে দেখার জন্য ছটফট করেন। কিন্তু ছেলে খুব ব্যস্ত। একদমই সময় পান না মাকে দেখতে আসার। প্রতি বছর মা দিবস এলেই এই অপেক্ষার অবসান হয়। নামকরা অফিসার ছেলে মা দিবসে আসেন মাকে দেখতে। এই দিনটি তাই আরিফার খুব প্রিয় একটি দিন। সারা বছর তিনি অপেক্ষা করেন এই দিনটির জন্য।

‘রাত থম থম স্তব্ধ, ঘোর-ঘোর আন্ধার,
নিশ্বাস ফেলি, তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,
করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।
শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,
তারই সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরান দোলে।’

জসীমউদদীন তাঁর কবিতায় কোনো একজন মায়ের কথাই বলেননি, সব মা আসলে এমনই। মা এমন একজন মানুষ, যিনি সন্তানের সুখের জন্য নিজের সব সুখ বিলিয়ে দেন। নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান, অসুখ হলে দিন-রাত সেবা করেন। মায়ের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সব মায়া-মমতা-ভালোবাসা। হুমায়ুন আহেমেদের কথায়, ‘মা হল পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক যেখানে আমরা আমাদের সব দুঃখ-কষ্ট জমা রাখি এবং বিনিময়ে নিই বিনা সুদে অকৃত্রিম ভালোবাসা।’

আজকাল অনেকেই এই মাকেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে। সারা জীবন কষ্ট করে যে সন্তানকে একজন মা মানুষ করে তোলেন, সেই সন্তান বৃদ্ধ বয়সে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে আয়েশী জীবন কাটায় নিজের ফ্ল্যাটে। এমনকি খোঁজখবর পর্যন্ত রাখে না মায়ের। বৃদ্ধ মা মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সন্তানদের মুখ দেখার জন্য প্রতিদিন পথ চেয়ে থাকেন। পথ চাইতে চাইতে প্রায়ই তার চোখ ভিজে যায় জলে। বুকে জমে কষ্টের পাহাড়। তবু তিনি তার সন্তানের ভালো চান। কারণ তিনি তো আর কেউ নন, তিনি যে মা।

মায়ের ভালোবাসাকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালন করা হয় মা দিবস। এবারের মা দিবসে আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, আমরা যেন শুদ্ধ মানুষ হই, আদর্শ সন্তান হই। আমরা আমাদের মায়ের হাসিমুখ দেখতে চাই। মাকে কষ্ট দেব না। আঘাত দেব না। আমাদের মাকে পাঠাবো না কোনো বৃদ্ধাশ্রমে। মা যেমন তার বুকে আগলে রেখে আমাদের মানুষ করেন, আমরাও মাকে আগলে রাখবো পরম শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায়।

 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ মে ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়