ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

উপকূলের পথে

মেঘনাতীরে খেয়াতরীর অপেক্ষা

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৪, ১৪ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মেঘনাতীরে খেয়াতরীর অপেক্ষা

রফিকুল ইসলাম মন্টু : তবুও অপেক্ষা ফুরোয় না। কখন আসবে নৌকা! নারী-পুরুষ ও শিশুরা তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে। প্রায় সকলের সাথেই বোঝা। নারিকেল, চাল, ডাল, তরকারি, মোটা পাতার হোগলা, ছাগল, সয়াবিন তেল, মুরগির খাঁচা- আরো অনেক কিছু। মানুষের সঙ্গে এগুলোও উঠছে ট্রলারে। সকলেই মেঘনার ওপারে যাবে; কেউ নিজের বাড়ি, কেউবা স্বজনের খোঁজ নিতে। মেঘনার বুকে জেগে ওঠা ভোলার দৌলতখানের দ্বীপ মদনপুর অথবা ভোলা সদরের তুলাতলী। সকাল হলে মেঘনাতীরের ঘাটে ঘাটে খেয়া পারাপারের অপেক্ষা।

ছইবিহিন নৌকাটা কেবল বাত্তিরখাল ঘাটে ভিড়েছে। সূর্যটা তখনও পুবে হেলে আছে। নীল পাঞ্জাবি, চেক লুঙ্গি পরা দাড়িচুল পাকা মানুষটা দৌড়ে ছুটছেন ঘাটের দিকে। মাথায়-হাতে বোঝা, হাতে লাঠি। রোদজ্বলা কালো শরীর। পান খেয়ে দাঁতগুলো তরমুজের বিচি বানিয়ে ফেলেছেন। কঠোর শ্রমে রোদে পুড়ে শরীর কালচে হলেও নিজে শক্তি হারাননি। নৌকাটা খানিক দাঁড়ালো তার জন্য। সিঁড়ির প্রয়োজন হলো না; বোঝা নিয়েই নৌকায় উঠে গেলেন মানুষটা। এক কোণে জায়গা নিয়ে বসলেন। উঠলেন আরও কয়েকজন।

ট্রলার চলে। আবার ভিড়ে সাহেবের হাট ঘাটে। সেখান থেকেও ওঠে আরও কিছু মানুষ। নারী-পুরুষ; সঙ্গে কোলে কাঁধে শিশু। কারও মাথায় বোঝা। খেয়ার সময়ের খানিক আগেই তারা জড়ো হন এখানে। কমলনগর পাড়ের শেষ ঘাট লুধুয়ায়ও একই চিত্র দেখি। কয়েক বছর ধরে ভাঙনে বিধ্বস্ত বিপন্ন লুধুয়া ঘাট ছেড়ে খেয়া চলে পশ্চিমে; ভোলা জেলার তুলাতলীর দিকে। পথে পড়বে মদনপুর, মুন্সীর চর, পদ্মার পর। দ্বীপ মদনপুরের দক্ষিণ এবং পশ্চিম গা ঘেঁষে পৌঁছাবে তুলাতলী।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার কালকিনি ইউনিয়নের মতিরহাট। ভোরেই হাজির অনেক যাত্রী। ১০টার খেয়া ধরতে হবে। মতিরহাটের ব্লকফেলা তীরে অপেক্ষা অনেকের। ঘাটে ভেরানো মাছধরার ট্রলার থেকে ভেসে আসছে গান- ‘লেংকা বাবা তুমি অলিআল্লা, অলিআল্লা, তুমি যে খোদার দান, ও বাবা সোলেমান।’ একের পর এক চলতে থাকে গান। কিছু মাছধরা নৌকা-ট্রলার যাচ্ছে, আসছে। খেয়ার সময়টাও এগিয়ে আসছে। ঘড়ির কাঁটায় দশটা বাজতেই হানিফ মাঝির ডাক- ‘ভোলা যাইন্না কেডা কেডা আছেন? ট্রলার ছাইড়া দিমু’। অল্প কিছু যাত্রীর সঙ্গে আমিও। ট্রলার চলতে থাকে। ক্যামেরার চোখে চোখ রেখে আমি তাকাই নদীর তীরে। শার্টার টিপে ছবি তুলতে থাকি। এগুলো আমার খুবই চেনা দৃশ্য। কমলনগরের বাত্তিরখাল, সাহেবের হাট, বিশ্বরোড, জগবন্ধু, লুধুয়া, পাটোয়ারী হাট- এসব এলাকা ভেঙেছে বহুবার। অসংখ্য মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চলে গেছেন। প্রতিদিন হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখর থাকতো যে লুধুয়া বাজার; সেখানে ছড়ানো ছিটানো মাত্র কয়েকটা দোকানপাট। ভাঙন তীরের প্রাচীন তুলা গাছটি দেখে বেশ কষ্ট পাই। আর মাত্র ক’দিনেই এটি হারিয়ে যাবে। গাছটির পাশ থেকে দুলাল বেপারী, আতিক মাঝিদের ঝুপড়ি ঘর আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।



মেঘনায় ভাটার টান। হানিফ মাঝির ইঞ্জিন ট্রলার চলে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার ভাঙনের তীর ধরে। কালকিনি মতিরহাটের পর বাত্তিরখাল, তারপর বিশ্বরোড, তারপর সাহেবের হাট এবং শেষে লুধুয়া ঘাট। সেখান থেকে ভোলার দিকে। কমলনগর আর ভোলার মাঝখানে বিশাল নদী দেখা গেলেও এর বুকে আছে বড় বড় চর। ভাটায় পানি আরও নেমে গেলে ট্রলার চলতে সমস্যা হবে। তাই তাড়া হানিফ মাঝির। কোন ঝুঁকিতে পড়ার আগেই তাকে পৌঁছাতে হবে তুলাতলী ঘাটে। কমলনগরের শেষ ঘাট লুধুয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে না পৌঁছাতে ট্রলার ভরে যায় লোকজনে। সকলেই সুবিধামত জায়গা নিয়ে বসে। কেউ চালকের পাশের উঁচু বাক্সের ওপরে একটু আরামে বসার সুযোগ নিল। কেউ বসলো ট্রলারে কাঠ বিছানো পাটাতনের ওপরে। কেউ বসলো একেবারে ডেকে। কারও ইচ্ছে হলো মাস্তুলের কাছে; কারও বা গলুইয়ের ধাওে বসার। তীব্র রোদে মানুষগুলো বেশ কষ্ট পাচ্ছিলেন। নারীদের কারও হাতে পাখা দেখি। পাখাটা দিয়ে তাদের কোলে থাকা শিশুদের রোদ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। ডেকের যাত্রীদের কেউ কেউ আবার এরইমধ্যে শুয়ে পড়েছেন। কেউ দিয়েছেন ঘুম। নিয়মিত চলাচলকারী এইসব যাত্রীরা জানেন তুলাতলী যেতে অনেক সময় লাগবে। সে কারণে অনেকে ঘুমিয়ে সময় পার করেন।

মেঘনার পূর্বপাড়ের মতিরহাট ঘাট থেকে পশ্চিম পাড়ের তুলাতলী ঘাটে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় বসে থাকতে নেই ছাউনির কোন ব্যবস্থা। রোদবৃষ্টিতে মানুষ রক্ষা পায় কিভাবে? প্রশ্ন করি হানিফ মাঝিকে। জানালেন, ট্রলারের ওপরে কাপড়ের ছাউনি থাকে। কিন্তু প্রবল বাতাসের সময় সেটা সবসময় রাখা সম্ভব হয় না। কিন্তু বৃষ্টি থেকে যাত্রীরা কিভাবে রক্ষা পায়? মাঝিতে এই প্রশ্ন আর করার প্রয়োজন পড়েনি। বাস্তবেই সেই দৃশ্য দেখা সুযোগ হয়েছে। ট্রলার মদনপুরের মুন্সির চর এলাকায় পৌঁছাতেই আকাশ কালো করে প্রবল বেগে বৃষ্টি আসে। ট্রলারের একজন একটি বড় পলিথিনে মুড়ে দিলেন ট্রলারটি। যাত্রীরা সবাই বসে গেলেন ডেকে। এখানেই বৃষ্টি থেকে বাঁচলেন সকলে। বৃষ্টির সঙ্গে ছিল প্রবল ঝড়। কেউ কেউ ভয় পেলো; কেউ আবার অনেক সাহস নিয়েই বসেছিলেন।

দীর্ঘ সময়ের এই ট্রলার যাত্রায় চোখে পড়ে নানান কিছু। ভাটার সময়ে নদীর পানি যখন শুকাতে থাকে; তখন বহু মানুষ চিংড়ির রেণু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন নদীতীরে। মতিরহাটের কাছে যে দৃশ্য চোখে পড়ে; তাতে মনে হয় চিংড়ি রেণু ধরার এক উৎসব চলছে। চিংড়ির রেণু ধরা যে নিষিদ্ধ; তা অনেকে জানেন। তবে জীবিকার তাগিদে এটা তাদের করতে হয়। নদীর ভাঙন, ভাঙা রাস্তার মাথা, নদী ভেঙে যাওয়ার পর ফসলের মাঠে বসানো মাছের আড়ৎ, নদীর মাঝখানে হেলে পড়া আস্ত পাকা ব্রীজ- আরও অনেক দৃশ্য চোখে পড়ে। খেয়া ট্রলারের পাশ দিয়ে চলে যায় কয়েকটি নৌকা। এতে নারী-শিশুরা কাজে ব্যস্ত। কমলনগরের মেঘনাতীর থেকে বহু মানুষ ভাঙনের শিকার হয়ে অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে আবার এখনও মাটি আঁকড়ে আছেন নদীর তীরেই।

খেয়া ট্রলারের একজন যাত্রী নূর আলম। বয়স ৩৫। ছেলে হাসানকে নিয়ে নোয়াখালী থেকে এসেছে। সাথে চারটি নারিকেল, কিছু চাল এবং আরও কিছু মালামাল। যাবে মদনপুরে। তাদের মূল বাড়ি ছিল কমলনগরের কাঁকড়ার চরে। সে এলাকা অনেক আগেই নদীতে হারিয়েছে। তার বাবা নোয়াখালীর মাইজদীতে একখণ্ড জমি কিনেছিলেন। সেখানেই ভাইদের সাথে নিয়ে থাকেন তার মা রেনু বিবি। নদীতে মাছ ধরার কাজে এসে নূর আলম থেকে যান মদনপুরে। এখানে সরকারি কলোনিতে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এক ব্যক্তি। যদিও সে কলোনী নদীভাঙনের মুখে পড়েছে। স্থান বদল করে কলোনী অন্যত্র সরানো হয়েছে। নূর আলমসহ অনেকেই থাকেন সেখানে গাদাগাদি করে।



টেইলারিং দোকানের জন্য এক বস্তা কাপড় নিয়ে সাহেবের হাট ঘাট থেকে ট্রলারে উঠেছিলেন আবদুল মজিদ। বয়স ৫৫। যাবেন মদনপুর। সেখানে রয়েছে তার একটি টেইলারিং দোকান। উপার্জনের আর কোন বিকল্প অবলম্বন নেই। ওই দোকানেই তার জীবিকা চলে। মূল বাড়ি কমলনগরে থাকলেও প্রকৃতি তাকে অবশেষে ঠাঁই করে দিয়েছে মদনপুর চরে। সময় সুযোগ হলেই কমলনগরের মিয়ার বেড়ির নিকটে স্বজনের বাড়ি যান; একই সঙ্গে নিয়ে আসেন দোকানের কাপড়চোপড়। আলাপ হলো হানিফ মাঝির সাথে; যিনি বহু দিন ধরে এই রুটে খেয়া ট্রলার চালাচ্ছেন। তিনি জানালেন, বহুবার এই রুটে ঝড়-ঝাপটায় পড়েছে খেয়া ট্রলার। কিন্তু বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। মানুষজন এপার থেকে ওপারে পৌঁছাচ্ছে নিরাপদে। তিনি জানান, এই খেয়া রুটের বয়স প্রায় ৫০ বছর। তখন মেঘনা ছিল অনেক ছোট। এপার থেকে ওপার দেখা যেতো। তবে মেঘনা তখন আরও বেশি উত্তাল ছিল। চর পড়ে যাওয়ার কারণে সেই উত্তাল চিত্র এখন আর নেই। এই রুটে প্রতিদিন রয়েছে দুটি ট্রলার। দুটোই দু’প্রান্ত থেকে ছাড়ে সকাল ১০টায়। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মে ২০১৮/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়