ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

মেয়েরা ঠিক যেখানে টিপ পরে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১১, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মেয়েরা ঠিক যেখানে টিপ পরে

(ভিয়েতনামের পথে: ৪২তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: দুই জনের মাথায় দুইটি হেলমেট, ফুটফুট শব্দে এগিয়ে চলছে আমাদের স্কুটি। এই ফুটফুটির স্বপ্ন সেই থাইল্যান্ডের পাই থেকে। আজ এত দিন পর তা বাস্তবায়ন হলো। সুজিতের মোটর সাইকেল চালানোর হাতেখড়ি অল্পদিন আগে। তাই মুখ ভরা খুশি আর সর্বাঙ্গ বেয়ে যেন ঝরছে উচ্ছ্বাসের জোয়ার। মোটর সাইকেল চালনায় যত রকম দক্ষতা জানা আছে ঢেলে দিচ্ছে তার সবটুকু। আশপাশ দিয়ে চলাচল করা প্রতিটি স্কুটির মাইল মিটারের উপর বিশেষ কায়দায় একটি করে মোবাইল ফোন রাখা। পর্দায় ভেসে আছে চলতি পথ ও গন্তব্যের নকশা। মানচিত্রই তাদের পথ চিনিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পথের দিকনির্দেশনা চেয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই সাহায্যের জন্য ফোনের পর্দায় খোঁচাখুঁচি শুরু করে দেয়। আমাদের ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। আপাতত কাগজের মানচিত্র ভরসা।

পেছনে বসে সুজিতের পিঠের ওপর বিছিয়ে ধরে দিকনির্দেশনা খুঁজে বের করছি। সামনে পেট্রোল পাম্প থেকে তেল ভরে নিতে হলো। কত লিটার তেল ধরল জানি না, তবে যন্ত্রের পর্দায় মূল্য ভেসে উঠল চব্বিশ হাজার রুপাইয়া। মানচিত্র বলছে শহর ভেদ করে গিয়ে উঠতে হবে প্রধান সড়কে। শহরের প্রায় সকল রাস্তার পাশে বৃক্ষের শোভা। যানবাহনের সংখ্যা সীমিত। সংকেত বাতি অনুযায়ী চলাচলে প্রত্যেকের মধ্যে সচেতনাতার বিষয়টি সত্যিই লক্ষণীয় একটি ব্যাপার। নিয়ন্ত্রণে কোন পুলিশ নেই, লাল-সবুজের সংকেত বাতিই যথেষ্ট। এই পথে, সেই পথে শুধু প্যাঁচ মারছি। কখনও বা ঘুরেফিরে একই পথে বারবার আসছি। শহর থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। এ পর্যাযে মানচিত্রের নির্দেশনা গুলিয়ে গেছে। পথের সন্ধান করতে বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল। মানুষের সংখ্যাও তেমন নয় যে, কারও কাছ থেকে জেনে নেব। মাঝে মধ্যে পথ এতটাই ফাঁকা আমাদের ফুটফুটি পঙ্খিরাজ ছাড়া অন্য কোন বাহণের চিহ্নটি নেই। আর এই পথেই আমাদের যত বাহাদুরি, যেন রাষ্ট্রের বিশেষ অতিথি আগমনের খবর জেনে সকলে সসম্মানে পথ ছেড়ে দিয়েছে। এক পর্যায়ে মানচিত্রের গুলিয়ে যাওয়া মাথা পূনরুদ্ধার করতে সক্ষম হলাম।



যে কথাটি এখনও বলা হয়নি তা হলো, আজকের গন্তব্য পৃথিবীখ্যাত বালির উবুদ বাজার ও প্রত্ননিদর্শন গোয়া গাজা বা হাতি গুহা। কুতা বালি থেকে উবুদের দূরত্ব বত্রিশ কিলোমিটার। যেতে কতক্ষণ লাগবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না কারণ ফুটফুটির গতি খুব একটা সুবিধার নয়। এর মধ্যে আবার বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেছে শুধু এলোমেলো ঘোরাঘুরিতে। শহর ছেড়ে তিন রাস্তার মোড়। মোড়ের কেন্দ্রে সড়ক দ্বীপে অনেক মূর্তির সমন্বয়ে এক বিশাল ভাস্কর্য। এখানকার দেব-দেবীর সবই অচেনা এবং মিশ্র ধরণের। তারা কোন ধর্মের অনুসারী মূর্তি দেখে তা আন্দাজ করা বেশ মুশকিল। তবে মূর্তির আকৃতিগত দিক ভালোভাবে লক্ষ করলে সনাতন হিন্দু ধর্মের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মুসলিম প্রধান ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। এর আগমন যে সুদূর ভারতবর্ষ থেকে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ভারতবর্ষ থেকে আগত হলেও এই হিন্দু ধর্ম মতের স্বতন্ত্র একটি রূপ রয়েছে, যা স্থানীয়ভাবে আগামা হিন্দু ধর্ম বলে পরিচিত। আগামা হিন্দু মতবাদ মূলত শিববাদ ও গৌতম বুদ্ধের মতবাদের সংমিশ্রণ। সুতরাং, বিভিন্ন দেব-দেবী মূর্তির কদর থাকা অস্বাভাবিক নয়। যেমন- পথের বিভিন্ন স্থাপনা, বাড়ি এমনকি পুল বা সেতুর রেলিং-এর উভয় প্রান্তে মূর্তি স্থাপন করা। সর্বত্র মূর্তিকেন্দ্রীক শিল্প বেশ উন্নত ও চাঙ্গা।

রাস্তার ধারে কিছুদূর পরপরই মূর্তির কারখানা। পাথর কেটে অথবা সিমেন্ট-বালির ঢালাই করা মূর্তি। কোন কোন কারখানায় শত শত মূর্তি বানিয়ে রাখা। সুক্ষ্মকারুকাজের মূর্তিগুলি দেখে সহজেই আন্দাজ করা যায় এই শিল্পের পেছনে তাদের শিল্পী মানসের কতখানি নিয়োজিত এবং সমাজে এর চাহিদা বা চর্চা কি পরিমাণ হয়ে থাকতে পারে। পাথর দিয়ে তৈরি আর এক শিল্পের কলেবর এখানে আরও বৃহৎ। বাড়ি ঘরের অবস্থা যেমনই হোক তাতে বাহারি একটি প্রবেশদ্বার থাকা চাই। আর এই প্রবেশদ্বার এবং ঘরের বহিরাংশ অলঙ্করণে উক্ত শিল্পজাত পণ্য ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি দরজা অথবা মন্দির যন্ত্র দিয়ে নকশা কাটা ইট অথবা পাথরের পাতলা ও পুরু টুকরোর সমন্বয়ে তৈরি। প্রধান দরজায়  সাধারণ খুঁটি বা স্তম্ভে দাঁড় করানো কোন ছাদ বিশেষ নয় বরং অল্প উঁচু ভিত্তির উপর একের পর এক স্থাপন করা নকশা কাটা ইট/পাথর টুকরো। বাহারি টুকরোগুলির বিন্যাস উপরের দিকে ক্রমেই সরু করে তুলে দেয়া। আকার ভেদে উভয় পাশে গোড়ার অংশ দুই-তিন থেকে সাত/আট ফুট পর্যন্ত চওড়া তারপর গোড়ালিকে কেন্দ্র করে খানিকটা যে অনুচ্চ সীমানা প্রাচীর তাতেও একই কারুকাজের প্রাধান্য। বিভিন্ন কার্যালয় বা দপ্তরের সম্মুখেও এমন দরজা দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরের বেলাতে বিষয়টি আরও অধিক মাত্রায় ব্যবহৃত। তবে রঙের ক্ষেত্রে খয়েরির প্রাধান্য লক্ষণীয়। সামনেই তিন মাথার একটি মোড়। এখান থেকে ডান দিকের পথেই উবুদ।



দীর্ঘ দিন পর এত লাম্বা সময় ধরে মোটর সাইকেল সফর করা। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে স্কুটি যে গতিতে চলছে বলা যায় তার চেয়ে অধিক গতি আমাদের মনে। মাঝে মধ্যে তো মনে হচ্ছে দুই চাকার এই যন্ত্রটাকে পথের পাশে রেখে দেই এক দৌড়। এ পর্যায়ে পথের সবটাই উঁচু-নিচু হালকা টিলাময়। পথের সৌন্দর্য অবলোকনে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং, মানচিত্র এখন ভাঁজ করে পকেটে বন্দি। প্রত্যন্ত এলকার পথ সাধারণত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে তবে এই মুহূর্তে যে পথ দিয়ে যাচ্ছি তার মত কমই হয়। সামনে রাস্তার উভয় পাশে সাজিয়ে রাখা মূর্তির সমাহার। এর মাঝ দিয়েই পথ আলাদা হয়ে চলে গেছে দুই দিকে। আমাদের পথ ডানে। দুপুরের রোদ মাথার ঠিক উপরে বসে আছে সেই কতক্ষণ থেকে! ওর যেন সরা-নরার কোন অনুমতি নেই। পথের ধারে পাতলা বসতি। তার আগে বেশ ব্যবধানে তিনটি দোকান। প্রতিটি দোকানের প্রধান পণ্য ফলের শরবত।  তাক ও কাঁচের ভেতর সাজানো আকর্ষণীয় রঙের ফলগুলি দেখে মনে হচ্ছে সবগুলির রস এক ঢোকে খেয়ে ফেলি। সুজিতকে বললাম দেখে আসি কি কি শরবত আছে আর দামই বা কয় লাখ?

মটর থামিয়ে নেমে গেলাম। দামদর মেটানো পর্ব শেষে এখন শরবত প্রস্তুত চলমান। বিদেশি মানুষ পেয়েছে তাই বোধহয় শরবত তৈরিতে একটু বাড়তি মনোযোগ। ফালি করা এ্যবোক্যাডোর ভেতর থেকে চামচ দিয়ে তুলে নিল নরম অংশ। এই দৃশ্য দেখতে যে কতটা আকর্ষণীয় তা স্বচক্ষে না দেখলে কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। এরপর কনডেন্সড মিল্ক, বরফের কুচি এবং আরও কি কি যেন যোগ করা হলো। প্রস্তুত প্রণালী ও একের পর এক উপকরণ যোগ করায় সময় অনেকটা পেরিয়ে যাচ্ছে। এসব দেখে আমাদের তৃষ্ণার মাত্র কয়েক গুণ বেড়ে গেল। দোকানির স্বামী এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে শুধু আমাদের চেহারা দেখছিলেন। পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরে তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। এসে নিজেও হাত লাগালেন। আমাদের দুই জোড়া চোখের অনড় দৃষ্টি প্রস্তুত প্রণালীর ভেতরে যেভাবে ঢুকে গেছে, তাতে তিনি বোধহয় ঠিকই বুঝতে পেরেছেন আর একটু দেরি করে ফেললে নিশ্চিৎ বুক ফেটে মারা পরব। পেয়ালায় ঢালার আগে তার ভেতর চকোলেট জাতীয় কোন কিছুর আঁকিবুকি করে নিলেন। তারপর হালকা সবুজাভ থকথকে এ্যাবোক্যাডোর শরবত পেয়ালায় ঢেলেই মুখের সামনে এগিয়ে ধরলেন। চুমুক দিতেই ঠান্ডার শিরশির করা অনুভূতি তড়িৎ গিয়ে পৌঁছে গেল কপালের নিচে দুই ভ্রুর মধ্যখানে। মেয়েরা ঠিক যেখানে টিপ পড়ে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়