ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মৌখিক ইতিহাসের ধারণার প্রচলন করেন সালাহ্উদ্দীন আহ্‌মদ

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ১৯ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মৌখিক ইতিহাসের ধারণার প্রচলন করেন সালাহ্উদ্দীন আহ্‌মদ

মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে ‘কওমি শিক্ষা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখছেন অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহ্‌মদ

হাসান মাহামুদ : জাতীয় অধ্যাপক এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহ্‌মদ ছিলেন দেশবরেণ্য ইতিহাসবিদ। ধর্মান্ধতা ও বৈজ্ঞানিক সত্যান্বেষণকে তিনি অনায়াসে সাহসের সঙ্গে পৃথক করে রাখতে পেরেছিলেন। আর তিনি শুধু ইতিহাসবিদ ছিলেন না, ছিলেন ইতিহাস-পুরুষও।

সালাহ্উদ্দীন আহ্‌মদ ছিলেন ইতিহাসের নতুন রূপকার ও আধুনিক বিশ্লেষক। বিকৃত ইতিহাসচর্চার পুরোহিত হননি। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ও জাতীয় মনমানসের বিবর্তনকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, যা জাতির বিবেককে জাগায় ও সামনের দিকে তাকাতে শেখায়। প্রচলিত ধারার ইতিহাস লেখার ধরনকে তিনি বদলে মৌলিক লেখার আদলে ইতিহাস রচনা শিখিয়েছেন।

ইতিহাস রচনায় মৌখিক ইতিহাস বা ওরাল হিস্ট্রি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিকে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি বিশাল সংগ্রহ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর স্থানীয়ভাবে যেসব মৌখিক ইতিহাস সংগ্রহ করছে সেগুলো প্রত্যেক এলাকার আঞ্চলিক ইতিহাস হয়ে উঠছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আছে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠিত প্রায় ২৩ হাজারের মতো ঘটনার একটি সংগ্রহ। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এসব ঘটনা। তাই এগুলোকে বলা হচ্ছে ‘ওরাল হিস্ট্রি’ বা মৌখিক ইতিহাস।

ওরাল হিস্ট্রি হলো যেকোনো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অডিও, ভিডিও, কাগজে লিখে, কম্পিউটারে বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে সংরক্ষণ করা। এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহ্‌মদ এ দেশে মৌখিক ইতিহাসের ধারণার প্রচলন করেন।

এমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান একবার অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহ্‌মদ সর্ম্পকে বলেছিলেন, ‘তিনটি বিশেষ গুণকে ধারণ করেছিলেন তিনি। সেগুলো হলো যুক্তিবাদ, মানবিকতা ও সহনশীলতা। তার অন্য গুণগুলোও বিকশিত হয়েছে এই তিন গুণের ভেতর থেকে। আর ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন খুব নরম স্বভাবের মানুষ। এ কারণেই অন্যের মধ্যেও সব সময় গুণ খুঁজে বের করতেন। সব কিছুর মধ্যেই ভাল কিছুর সন্ধান করতেন। তার সামনে কারও নিন্দা করা হলে তিনি তার গুণগুলোকে সবার মাঝে উপস্থাপন করতেন। এটা ছিল তার স্বভাবজাত। আবার যেখানে প্রতিবাদের প্রয়োজন সেখানে ঠিকই প্রতিবাদ করেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক যে কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন। তিনি চলে গেলেও তার চিন্তা আমাদের মাঝে রয়ে গেছে। দেশের প্রতি তার ভালবাসা আমাদের পথ দেখাবে। তাঁর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের ভাবনা আমাদের উদ্দীপ্ত করবে।

অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯২২ সালে, ফরিদপুরে। তবে তার শিক্ষা সনদে জন্ম সাল উল্লেখ রয়েছে ১৯২৪। ১৯৩৮ সালে কলকাতার তালতলা হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন, রিপন কলেজ থেকে ১৯৪০ সালে উচ্চমাধ্যমিক, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে ইতিহাসে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপানে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণা করেন। পিএইচডি করেন লন্ডনে।

সালাহউদ্দীন আহমদ জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৪৮ সালে। এখানে তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে ১৯৫৪ সালে ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন এবং এখানে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন ১৯৭৮ সালে এবং ১৯৮৪ সালে নিয়মিত চাকরি থেকে অবসর নেন। তবে পরে তিনি সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন।

বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটি, ইতিহাস পরিষদ, জাতিসংঘ সমিতি, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ইত্যাদি। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘সোশ্যাল আইডিয়াজ অ্যান্ড সোশ্যাল চেইঞ্জ ইন বেঙ্গল ১৮১৮-৩৫’, ‘বাংলাদেশ : ট্র্যাডিশনাল অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন’, ‘বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ’, ‘বাঙালীর সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘ইতিহাসের সন্ধানে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য বই।

স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদকসহ বিভিন্ন পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। আজ এই মনীষীর তৃতীয় প্রয়াণবার্ষিকী। ২০১৪ সালের আজকের দিনে (১৯ অক্টোবর) ৯২ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন।

সালাহ্উদ্দীন আহ্‌মদ ছিলেন একজন স্বাধীন মানুষ। যে কারণে কখনই তিনি উচ্চাকাঙ্খার দাসত্ব করেননি। তার সমগ্র জীবন পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, তিনি সব সময় স্বাধীন চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। কোন পদের প্রতি মোহ ছিল না। সে কারণেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কিংবা সরকারী কর্মকমিশনের চেয়ারম্যানের পদের প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলেন।

তার জীবনের মূল সাধনা ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধেও তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। রাজা রামমোহনের দর্শনকে ধারণ করেছিলেন। সব মিলিয়ে তিনি সহনশীলতার উদাহরণ রেখে গেছেন। এই ইতিহাসবিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালী। অনেক কাজ করে গেছেন অগোচরে।

পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা যে ঐক্য রচনা করেছিলেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ ছিলেন অন্যতম। এ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তফা নূর-উল ইসলাম সম্পদিত ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় বুদ্ধিজীবীদের রচনা প্রকাশিত হতো। অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ রচিত ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘সংস্কৃতির সংকট’, ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ ইত্যাদি রচনা তথ্য ও তত্ত্বে সমৃদ্ধ। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সুশোভন সরকারের কৃতী ছাত্র অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ মানুষ ও মানবতার বিজয়ের চিন্তায় নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। তিনি এম এন রায়ের র‌্যাডিকেল হিউম্যানিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে ডক শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়নের কাজ করেছেন। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর তিনি আর সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে জাতীয় সংকটেও তাকে অগ্রগামী ভূমিকায় দেখা গেছে।

অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ জাতীয় জাদুঘরে কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন দীর্ঘদিন। তার সহযোগী ছিলেন সরদার ফজলুল করিমসহ একাধিক অধ্যাপক বুদ্ধিজীবী। জাতীয় জীবনে যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের সাক্ষাৎকার অডিও ভিডিওতে ধারণ, সাক্ষাৎকারের লিখিত রূপ প্রকাশ করার বিষয়টি তার নিষ্ঠাবান কর্মযজ্ঞের স্মৃতি আজো অনেকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রকাশ করে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করতে যে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, তাদের মধ্যে পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ। এ দেশে মৌখিক ইতিহাসের ধারণার প্রচলন করেন তিনি। এ ছাড়া লেখা ও কাজের চেয়ে মানুষ হিসেবে অনেক বেশি মহৎ ছিলেন তিনি।

অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ ছিল, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মত-মতান্তর থাকে; কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধীরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাভাবিক গতিধারায় বিঘ্ন ঘটায়। এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সতর্ক থাকা জরুরি’।

যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্মরণ করবো আমরা। আর এ জন্য স্মরণ করতে হবে অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদকেও।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ অক্টোবর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়