ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রাজনীতির ময়দান থেকে বইয়ের রাজ্যে

অলাত এহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৬, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাজনীতির ময়দান থেকে বইয়ের রাজ্যে

অলাত এহসান : আহমদ ছফার ‘পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরান’ উপন্যাসের নায়ক রাজনীতি ছেড়ে জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছিল চিলেকোঠার আঙ্গিনায় পাখিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে। তেমনই একজন দিনাজপুরের মকবুল হোসেন। ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলের জেলা কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেসব ছেড়ে মগ্ন হয়েছেন নিজের গড়া পাঠাগার আর কবিতা চর্চায়। জাতীয় জীবনে পাঠ্য বইয়ের বাইরে পড়ার চর্চা যখন উঠেই গেছে, সেই সময় রাজধানী থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে দিনাজপুর শহরে বাতিঘরের মতো জ্বলছে ১০ হাজারের অধিক বইয়ের সেঁওতি পাঠাগার।

শহরের সর্দার পাড়া এলাকার দুইতলা বাড়ির ছাদের অর্ধেকটা জুড়ে ঘর। ঘরের দেয়াল ঢাকা পড়েছে সেলফে। প্রতিটি তাকে থরে থরে সাজানো বই। সাহিত্য থেকে নৃ-তত্ত্ব, ইতিহাস থেকে অর্থনীতি, ধর্মগ্রন্থ থেকে দর্শন, শিশু সাহিত্য থেকে বিদেশী সাহিত্যে ঠাসা। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব অনেক বই হারিয়েও গেছে। সেলফ ছাড়িয়ে দীর্ঘ টেবিলে জমেছে নতুন-পুরনো বইয়ের ভার। এখানেই প্রতিমাসের জমে সাহিত্য আড্ডা, প্রকাশ হয় দ্বিমাসিক পত্রিকা সেঁওতি। ছাদের বাকি অংশ জুড়ে কবুতরের বাসা ও ফুলের বাগান। এসব নিয়েই কাটে একাত্তরের রণাঙ্গণের যোদ্ধা মকবুল হোসেনের সময়। দেয়ালে ঝুলছে পেন্সিল ও কলমের স্কেচ, ঘরে কোণে দাঁড়ানো কাঠ খোদাইয়ের কাজ তারই করা।

একাত্তরপূর্ব সময়ে আদর্শভিত্তিক সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন মকবুল হোসেন। ১৯৭০ সালে জেলা ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে মুজিববাহিনীতে স্বক্রিয় ছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রথম কাউন্সিলে ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে দিনাজপুর আইন কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জিএস নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশের মতো দিনাজপুর শহরে আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়ে ছিল তাদের অন্যতম ছিলেন মকবুল হোসেন। তবে জেল থেকে ফিরে আর আওয়ামী লীগের যোগ দেননি। তার ভাষায়, ‘বঙ্গবন্ধুর লাশ রেখে যে সংগঠনের নেতারা মোস্তাকের গভর্মেন্টে যোগ দিতে পারে, সেখানে আমি যোগ দিতে পারি না।’

তবে আশির দশকের শুরুতে এরশাদের সামরিক অভ্যূত্থানের পর জাতীয় পার্টির নেতা হিসেবে রাজনৈতিক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চেয়েছিলেন তিনি। সে সময়ের রাজনৈতিক একাধিক শিষ্য এখন জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ নেতা। দেখা হলে এখনো তাকে গুরুতুল্য শ্রদ্ধা করেন। তার এক সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মীরা জানান, মকবুল হোসেনের গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব ও গুণাবলির কারণে বরারবই রাজনৈতিক দলগুলো তাকে সাদরে টেনেছে। তবে আদর্শ চর্চার কারণে শেষ পর্যন্ত দলীয় সব সংশ্রব থেকে নিজেকে বিযুক্ত করেছেন। দিনাজপুর-৫ আসনের এমপি মুস্তাফিজুর রহমান ফিজার বলেন, ‘কে কোন রাজনৈতিক আদর্শ করবেন, এটা একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। তবে তিনি একজন ভালো মানুষ, ভালো সংগঠক ছিলেন। জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়ায় তার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়।’



শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই বিচিত্র পাঠের উজ্জ্বল নেশা তাড়িত হন মকবুল হোসেন। বই পড়া ও সংগ্রহের জন্য শহরের সব বইয়ের দোকানে পরিচিত মুখ তিনি। রাজনীতির প্রয়োজনে কোথাও গেলেও প্রয়োজনীয় বই খুঁজে সংগ্রহ করার নেশা তার এখনো কাটেনি। তবে বয়সের ভারে চলাচল সীমিত হয়ে এসেছে তার। শহরের জজ কোর্ট এলাকার গোটা দশেক পুরনো বই বিক্রেতাই এখন প্রধান উৎস। এই বই বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন স্থান থেকে পুরনো বইয়ের লট এলে প্রথমেই মকবুল হোসেনকে খবর দেন তারা। তিনি পছন্দের বই সংগ্রহ করার পর বিক্রির জন্য উপস্থাপন করেন। এমনকি সঙ্গে পর্যাপ্ত টাকা না থাকলেও তাকে বই দিতে বারণ নেই। এভাবেই ৩০ বছর যাবত বই সংগ্রহ করেছেন তিনি।

দিনাপুরের মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চবিদ্যালয়ে পড়েছেন মকবুল হোসেন। পার্শ্ববর্তী জেলা ঠাকুগাঁওয়ের বিডি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। সে সময় কলেজের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। সেদিনের স্লোগান ও বক্তৃতা পারদর্শী মকবুল হোসেন এখন কথা বলেন নরম স্বরে। মাথার ঝাকড়া চুল ঝড়ে গিয়ে এখন বিরল কেশ তার। অতীত সমর্থন করে মুখে ছেয়ে গেছে সফেদ দাড়িতে। বয়সের ভারে থির থির করে কাঁপে শরীর।

বই পড়া শুরু নিয়ে মকবুল হোসেন জানান, শৈশবে তার বিস্তর সময় কেটেছে দিনাজপুরের কালীতলায় অবস্থিত শতবর্ষী আর্য পাঠগারে। এখানেই শৈশবে তার সঙ্গে দেখা হয়ে ছিল দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেবের (জে. সি. দেব) সঙ্গে।

প্রয়াত খলিল উদ্দিন ও মর্জিনা বেগমের ১১ সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ মকবুল হোসেন বড় ভাই চিত্রশিল্পী তোজাম্মেল হোসেনের অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে আসেন। একইভাবে তাকে অনুসরণ করে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন অনুজরা। তার দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে পিতার অনুসরণে এগিয়ে আছেন কন্যা আইনজীবী ও নারী অধিকার কর্মী মৌসুমী ফেরদৌসী।

পিতা সম্পর্কে মৌসুমী ফেরদৌসী বলেন, ছোটবেলা থেকেই পিতার বই সংগ্রহ দেখে বড় হয়েছি, পরে বই পড়ায় আমরাও উদ্বুদ্ধ হয়েছি।’ অনুযোগ নয়, পিতাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এমনকি আমার একমাত্র কন্যা শুভেচ্ছা ইসলাম নানার প্রভাবে পড়ুয়া হয়েছে।’ দুই বছর আগে স্ত্রী প্রয়াণের পর লাইব্রেরিই পিতার বৈরাগ্য সাধনের দুনিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান পুত্র মুনতাসির মিনার।



স্থানীয় ও আঞ্চলিক প্রকাশনায় নিয়মিতই প্রকাশ হয় মকবুল হোসেনের কবিতা ও গদ্য। লিখার আনন্দে প্রকাশ করা হয়নি কোনো বই। প্রায় প্রতিদিনই সেঁওতি পাঠাগারে পা পড়ে গবেষক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও সাহিত্যপ্রেমীদের। স্বরচিত কবিতা পাঠ ও আলোচনায় মুখর মাসিক সাহিত্য আড্ডাগুলোর মধ্যমণি থাকেন মকবুল হোসেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এমনি এক আড্ডায় উপস্থিত হয়ে ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অভ্র বসু ও অধ্যাপক শ্রীলা বসু।

সাহিত্য পত্রিকা সেঁওতি’র সম্পাদনা করেন আড্ডার সঞ্চালক দিনাজপুর সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক গবেষক ড. মাসুদুল হক। তিনি বলেন, ’৯০ দশকের শেষের দিকে রাজনীতিবিমুখ হয়ে লাইব্রেরিতেই মগ্ন হয়েছেন তিনি। আগে শহরে নানা বিষয়ে আড্ডা হতো, পরে সেঁওতি পাঠাগারে নিয়মিত আড্ডা দিতে শুরু করি। ব্যক্তিগত হলেও পাঠাগারটি জেলার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।’ আগামী বছর মকবুল হোসেন কবিতা নিয়ে বই করার পরিকল্পনা জানান তিনি। 

স্থানীয় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে বইপ্রেমী মকবুল হোসেনকে প্রথমবারের মতো পুরস্কৃত করে দিনাজপুর জেলা পরিষদ। ভবিষ্যতে বই সংরক্ষণ সম্পর্কে মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমার পরের প্রজন্মই রক্ষা করবে সেঁওতি পাঠাগার। সে হিসেবেই গড়ে তুলেছি তাদের। আর যদি না পারে ট্রাস্ট করে লাইব্রেরি করবে।’ পাঠাগারটি আধুনিকায়নের পর পাঠক ও গবেষকদের অবারিত করার ইচ্ছে আছে তার।

এ বিষয়ে দেশের বেসরকারি পাঠাগার রক্ষাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ঢাকা অফিসে যোগাযোগ করা হলে ওই পাঠাগারকে প্রথমের তাদের রেজিস্ট্রেশন ভুক্ত করার পরামর্শ দেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/অলাত এহসান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়