ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের পথে

রাজিব-সজিব, অন্যরকম বন্ধুত্ব

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২৮ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাজিব-সজিব, অন্যরকম বন্ধুত্ব

রফিকুল ইসলাম মন্টু : স্কুলে নয়, ওদের বন্ধুত্ব হয়েছে কাজে এসে। একজন হোটেল শ্রমিক, আরেকজন কাজ করে ওয়ার্কশপে। ফুলটাইম চাকরি; থাকা-খাওয়া মালিকের; তারপর মাস শেষে হাতে কিছু টাকা। মাত্র দশ-বারো বছর বয়সেই বেড়েছে কাজে দক্ষতা। স্কুলের চৌকাঠ পেরোতে পারেনি ওরা। ইচ্ছে থাকলেও পরিবেশ কিংবা সুযোগ হয়নি। হয়তো সকালে হোটেলের বাসন মাজতে মাজতে কিংবা ময়লা-কালি হাতে ওদের চোখ পড়ে বইখাতা নিয়ে স্কুলগামী শিশুদের দিকে। তখন মন খারাপ হয় ওদের।

এটা রাজিব-সজিবের গল্প। ওদের সাথে আমার দেখা হয় ভোলার চরফ্যাসনের দক্ষিণে দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচরের প্রাণকেন্দ্র আবদুস সালাম হাওলাদার বাজারে। রাজিবের বয়স ৯ বছর আর সজিবের ১২। বয়সে তিন বছরের ব্যবধান হলেও ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিবিড়। বয়সে ছোট রাজিব বেশ চটপটে, দুরন্ত; অপেক্ষাকৃত শান্ত সজিব। বেশ কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করায় ওদের সঙ্গে আমারও  বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সময় পেলেই আলাপ করি, আড্ডা দেই। কথা বলি, আর ভাবতে থাকি, ওরাই তো আমার খবরের ব্যতিক্রমী চরিত্র। ওদের বৃত্তান্ত তুলি নোটবুকে। সরকার থেকে যে দেশে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার ওপরে এতটা জোর দেওয়া হয়, সে দেশে রাজিব-সজিবরা খবরের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠতেই পারে। কিন্তু নানা কারণেই ওদের এই গল্পগুলো নীরবে গুমড়ে কাঁদে। এর কারণও আছে বিস্তর। দারিদ্র্য, অভিভাবকদের অসচেতনতা, শিক্ষার পরিবেশের অভাব, ইত্যাদি কারণে যেখানে এমন অসংখ্য শিশু স্কুলে যেতে পারছে না; সেখানে ক’জনের কথা আমরা তুলে আনতে পারি? রাজিব-সজিব দ্বীপাঞ্চলের হাজারো শিশু শ্রমিকের প্রতিনিধি। ওদের এই খবরটুকুই পাঠকের সামনে হাজির করে অসংখ্য শিশুর প্রতিচ্ছবি।

ক্লান্ত দুপুরে জনশূন্য আবদুস সালাম হাওলাদার বাজার। নূরুল ইসলাম ঝান্টু মিয়ার খাবারের হোটেল খোলা থাকলেও ক্রেতা নেই। সকালে একদফা নাস্তার টেবিলে ভিড় থাকে; পরের ভিড় শুরু হয় বিকেলের নাস্তায়। দুপুরের খাবারে ভিড় তেমনটা চোখে পড়ে না। হোটেল থেকে শুরু করে মুদি দোকান, চায়ের দোকান, ওষুধের দোকান- সবকিছু জমজমাট হয়ে ওঠে মাছধরার মৌসুম সামনে রেখে; অর্থাৎ বর্ষাকালে। ক্রেতাশূন্য হোটেলেই আলাপ দুই বন্ধুর সঙ্গে। ওরা কিছুটা বিব্রত। এর আগে কখনো একসঙ্গে এত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়নি ওরা। স্কুলের খাতায় নাম উঠেছিল শুনে আমার নোটবুকে ওদের নাম লিখতে বলি। নামতা লিখতে গিয়ে সজিব একটু ভুল করে ফেললে তার হাতে থাকা বলপেন তুলে নেয় রাজিব। চটপট নামতা লিখে চলে এক থেকে কুড়ি পর্যন্ত। ঝান্টু মিয়ার হোটেলের তিন কর্মীর মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ কর্মী রাজিব। সবার ছোট হলে কী হবে; চটপটে সবার চেয়ে বেশি। যেন প্রশ্ন করার আগেই ওর কাছ থেকে উত্তর আসে। ভোরে উঠে ঘর ঝাড়ু দেওয়া, থালাবাটি ধোয়া, রুটি ভাজা আর ক্রেতাদের টেবিলে চায়ের কাপ তুলে দেওয়া রাজিবের প্রধান কাজ। লেখাপড়ার প্রসঙ্গ তুলতে রাজিব বলে, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিল। এরপর আর এগোয়নি। লেখাপড়ার বিষয়ে অভিভাবকের অভিমত কী? জানতে চাইলে বাবা কাঞ্চন আলীর (আপন বাবা নয়) কথা হুবহু তুলে ধরে রজিব, ‘বর্ষাকালে গাঙে যাইবে, ধুইল্যা কালে পড়তে যাইবে; এ পড়ায় কোন লাভ নাই। কাজকাম করাই ভালো।’
 


‘লেখাপড়া করে চাকরি করতে চাইছিলাম। বাপ দেয় নাই। মা আর কী বলবে? তার মুখে কোন কথা নাই। ক্যামনে পড়মু? কামে আইছি। এহন তারা খুব খুশি।’ যেন এক শ্বাসেই কথাগুলো বলে ফেলে রাজিব। কথা শেষে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। রাজিবের জীবনের গল্পটা একটু অন্যরকম। নিজের বাবাকে আজও চেনে না সে। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর রাজিবকেসহ তার মা জাহানারা বেগমকে বিয়ে করে ঢালচরের কাঞ্চন মাঝি। রাজিব এবং তার মাকে ফেলে রেখে ওর বাবা চলে যায়। কাঞ্চন মাঝিকেই বাপ বলে জানে রাজিব। সে তার আসল বাবার নামটুকুও জানে না। মাস শেষে ঝান্টু মিয়ার কাছ থেকে পাওয়া বেতনের টাকাটা সে কাঞ্চন মাঝির হাতেই তুলে দেয়। রাজিবের সাথে কথা বলতে বলতেই আমার চোখ যায় বাজারের মাঝখানের খোলা মাঠের দিকে। চোখে পড়ে শিশুরা বোঝা টানছে, কাজে যাচ্ছে। ভাবি, সব শিশুকে স্কুলে পাঠানোর দাবি তুলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আওয়াজ তোলেন। শিক্ষায় নানান সুযোগ-সুবিধার কথা ভেসে ওঠে টেলিভিশনের পর্দায়। কিন্তু এই ঢালচরের ক্ষেত্রে তা কতটা প্রযোজ্য! যেখানে মানুষের তিনবেলা খাবার যোগাড়ে হিমশিম খেতে হয়, টিনের চালায় বারবার জোড়াতালি দিলেও চালার ফুটো দিয়ে বর্ষার পানি পড়ে, তাদের সামনে শিশুদের স্কুলে পাঠানোর নীতিবাক্য প্রযোজ্য হয় না। রাজিব সেরকমই দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের সন্তান। ওর স্কুলে যাওয়া অব্যাহত থাকবে কী করে?

রাজিবের খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু সজিব। স্কুলে যাওয়ার সুবাদে সাধারণত এমন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ওরা কাজের ক্ষেত্রে এসে বন্ধু হয়েছে। অবসরে, রাজিবের দোকানে যখন ক্রেতা থাকে না কিংবা সজিবের ওয়ার্কশপে যখন কাজ থাকে না, তখন ওরা বাজারের মাঠেই ফুটবল-ক্রিকেট খেলে। নদীর পাড়ে যায়, গল্প করে। ভালোমন্দে একে অপরের কাছে ছুটে যায়। এ যেন দুই প্রান্ত থেকে আসা দুই সারথী। সময় পেলেই সজিব ছুটে যায় রাজিবের হোটেলে; আবার রাজিব ছুটে যায় সজিবের ওয়ার্কশপে। সজিবের বাবাসহ পরিবারের সবাই ঢালচরেই ছিল এক সময়। একখণ্ড জমিও ছিল তাদের। বাবা মো. শাহজাহান গৃহস্থালি আর ঘাটের মজুরি করে যা পেতেন, তাতেই চলে যেতো সংসার। কিন্তু নদীর ভাঙনের কারণে সেসব এখন অতীত। তিন বছর আগে চরফ্যাসন উপজেলার আটকপাট নামক স্থানে একটি কলোনিতে ঠাঁই হয়েছে শাহজাহানের পরিবারের। তিনবোন শাবনুর, রেক্সনা আর ফারজানা বাবা-মায়ের সঙ্গে সেখানে চলে গেলেও রয়ে গেছে সজিব। সালাম হাওলাদার বাজারে তপন বণিকের ওয়ার্কশপে কাজ করে। বাবাই তাকে এখানে রেখে গেছে। মাস শেষে বেতনের টাকাটা বাবার কাছে পাঠিয়ে দেয় সজিব। ওর জীবনের যুদ্ধটা যেন এখান থেকেই শুরু হয়েছে।
 


আলাপে জানা গেল, বাবার যখন মোটামুটি সংসার চালানোর সুযোগ ছিল, তখন সজিব পড়তো ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রথম শেণীর পর দ্বিতীয় শ্রেণীর গণ্ডি পেরোনো আর সম্ভব হয়নি। তবে সজিবের বড় ভাই মনির হোসেন লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিল পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। অন্যদিকে, ওপারে আপটকপাট কলোনীতে বাবা-মায়ের সাথে থাকা তিন বোনও লেখাপড়া করছে। বাবার দারিদ্র্য সজিবকে স্কুল ছেড়ে কাজে এনেছে। ওয়ার্কশপে থাকা-খাওয়া, যখন যে কাজ থাকে তা করা এবং মাস শেষ হলে যে টাকা ক’টি হাতে পায়, সেটা নিয়ে খুশি সজিবের বাবা। এভাবেই হয়তো সজিবের বেতন বাড়তে থাকবে, আর টাকা পেয়ে তার বাবার হাসির রেখা আরও স্পষ্ট হতে থাকবে। ছেলের কামাইয়ের টাকায় ঘরের সদাইপাতি, চালডাল কেনা হবে। বাবাদের এই কল্যাণটুকুর জন্যই অসংখ্য সজিবেরা ছিটকে পড়ে লেখাপড়া থেকে। সজিবের বন্ধু রাজিবের চাকরিদাতা হোটেল মালিক ঝান্টু মিয়ার সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন কারণে ওরা লেখাপড়ায় টিকতে পারে না। বাবা-মায়েরা মনে করেন, স্কুলের যাওয়ার সময়টুকু নদীতে জাল নিয়ে নামলে, কিংবা একটা কাজ জুটিয়ে দিতে পারলে সংসারের চাকায় গতি পায়। বাবার কষ্ট একটু কমে। সালাম হাওলাদার বাজারসহ ঢালচরের অন্যান্য বাজার এবং নদীতে-মাঠে বহু শিশু কাজ করে। আমাদের কাছে যারা কাজ করতে আসে, তাদের যথাযথ বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দেই।’

স্কুলছুট শিশুদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ঢালচরের বাতিঘর বলে পরিচিত ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আজাহার উদ্দিন বলেন, ‘শিশুদের স্কুলমূখী করতে অভিভাবকদের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। বাবা-মাকে বুঝতে হবে তার শিশুর কাজে যাওয়াটা জরুরি, নাকি স্কুলে যাওয়া? অভিভাবকেরা সচেতন হলে স্কুলছুট শিশুর সংখ্যা কমে আসবে।’  




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়