ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রাবণের দেশে পথিকের বেশে || ফিরোজ আলম

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২২, ২৩ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাবণের দেশে পথিকের বেশে || ফিরোজ আলম

শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের তৃতীয় দিন অর্থাৎ ১৮ মার্চ সকাল ৯টায় ঘুম ভাঙলো। তাড়াহুড়ো করে  তৈরি হয়ে মাঠের দিকে ছুটলাম। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ট্যাক্সিওয়ালাকে পি. সারা ওভাল স্টেডিয়াম চেনাতে কিছুটা বেগ পেতে হলো! শ্রীলঙ্কায় এই বিষয়টি অবাক করেছে আমাকে। অনেক ট্যাক্সিওয়ালা রাস্তার নাম আর হোল্ডিং নাম্বার ছাড়া শুধু স্থাপনার নাম বললে চেনেন না। হোক সেটা কোনো পার্ক বা শপিংমল। আমাদের এখানে ‘বসুন্ধরা সিটি যাবো’ বললে সব ট্যাক্সিওয়ালাই চেনেন, কিন্তু শ্রীলঙ্কার প্রেক্ষাপটে অবশ্যই আপনাকে ‘পান্থপথ’ বলতে হবে। তা না হলে অনেক অনেক কথা খরচ করে তাকে জায়গাটা আগে চেনাতে হবে। চিনতে পারার পর ‘আগে বলবেন তো’ টাইপের সুন্দর হাসি উপহার দেবে আপনাকে। তবে চিনতে না পারলেও আপনাকে পথে পথে ঘোরাবে না তারা। অন্য কোনো চালককে জিজ্ঞেস করে ঠিকই পৌঁছে দেবে।

বিকেলে মাঠ থেকে বেড়িয়ে সরাসরি চলে গেলাম মাউন্ট লাভিনিয়া বিচে। এটি কলম্বো শহরের দক্ষিণের দেহিওয়ালা অঞ্চলে অবস্থিত ছোট্ট একটা বিচ। দেহিওয়ালা-লাভিনিয়া এলাকাটি দক্ষিণ উপকূল বরাবর বিস্তৃত গল রোডের ঠিক পাশেই। খুব যে সাজানো কিংবা পরিচ্ছন্ন তা বলবো না, তবে তেমন কোনো হকার কিংবা ফেরিওয়ালার অত্যাচার নেই। সাগর দেখতে গিয়ে পাশ দিয়ে ভুস করে চলে যাওয়া স্কুটারের শব্দে চমকে লাফিয়েও উঠতে হবে না আপনাকে। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় দেখলাম অনেক বয়স্ক একজন বৃদ্ধা কাঁচা আম কেটে লবণ মেখে বিক্রি করছেন। যতটা না আম খাওয়ার ইচ্ছায় তার চেয়ে বৃদ্ধাকে সহযোগিতা করার ইচ্ছায় আম কিনতে গেলাম। কিন্তু ভাষা নিয়ে পড়লাম বিপত্তিতে। এই দাদী ইংরেজির কিচ্ছু বোঝেন না। অহেতুক হিন্দি বলায় আমার ঘোর আপত্তি থাকা সত্তেও ট্রাই করে দেখলাম। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে হিন্দি যে বেশ চলে তার প্রমাণ অনেক পেয়েছি। তবুও তাকে আমার কথা বোঝাতে পারলাম না। আবার তিনি যা বলেন তা শুনে আমার পপকর্ন ফোটার শব্দ মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমি যত বার ইংরেজিতে বলি, দাম কত? তত বার তিনি কেটে রাখা আমের ঠোঙ্গায় আরেকটু লবণ মাখিয়ে দেন।
 



আমি চুপ করে গেলাম। কারণ আর লবণ দিলে এই আম নির্ঘাত জায়গায় খেয়ে জায়গায় ব্রেক টাইপের কিছু হয়ে যাবে। এবার একটা বুদ্ধি এলো। কার লেখায় যেন পড়েছিলাম-যখন অন্য কোনো ভাষা চলে না সেখানে নাকি বাংলা চলে। আমিও সরাসরি বাংলা বলা শুরু করলাম। আমাকে অবাক করে দাদী এবার আমার কথা বুঝলেন। তিনি তার থলে থেকে একটি একশ রুপির নোট বের করে দেখালেন। বুঝলাম ওটাই দাম। মনে মনে ‘হে বাংলা তোমার জয় হোক’ বলে বৃদ্ধার দাম মিটিয়ে দিলাম। শ্রীলঙ্কান আমের স্বাদ নিতে নিতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। মোটামুটি শান্ত বিচের এক জায়গায় কিছু তামিল যুবক মদ্যপান করছে আর কি একটা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে উদ্দাম নাচছে। ওদের মজা করার ধরনগুলোই নাকি অমন। কোনো রাখঢাক নেই। নেই কোনো মেকি আদিখ্যেতা। কাজের সময় কাজ, মজা করার সময় মজা। এই হলো শ্রীলঙ্কানদের স্বভাব। সন্ধ্যা নামলে বিচ থেকে হোটেলে ফেরার পথ ধরলাম। যদিও দেহিওয়ালাতে আরেকটি দর্শনীয় স্থান হলো শ্রীলঙ্কান ন্যাশনাল জুওলজিকাল পার্ক বা দেহিওয়ালা জু। বিশ্বের অন্যতম একটি প্রাণীসম্পদ সংরক্ষণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৩৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সময়ের অভাবে এবার যাওয়া হলো না। অন্য কোনো দিন পথে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো ঢুকে যাবো ওখানে।

বিচ থেকে বেড়িয়ে একটা সুপার শপে গেলাম। আমাদের মিনাবাজার কিংবা আগোরার মতো চেইন শপ। কিছু আনাজপাতি কিনতে হবে। আমি আগাগোড়া ভেতো বাঙালী। তাই আমরা আসার পরদিন থেকেই আমাদের হোটেল কক্ষের সাথে সংযুক্ত কিচেনে ভাত অথবা খিচুড়ি রান্না করে খাচ্ছি। আমার সফরসঙ্গীরাও আমার সাথে ভাত খাওয়ার মিছিলে যোগ দিয়েছেন। বাঙালী মাত্রই কতটা ভাত কাতর তা আমার যাচ্ছেতাই রান্না করা খাবার হাপুস নয়নে তাদের খেতে দেখেই বুঝতে পারছিলাম।



অন্য রকম এক টেনশনে রাতটা কাটালাম। কারণ পরদিন অর্থাৎ ১৯ মার্চ ২০১৭ বাংলাদেশ দলের শততম টেস্টের পঞ্চম দিনের শেষ অগ্নিপরীক্ষা। প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কার করা ৩৩৮ রানের জবাবে বাংলাদেশ করেছিল ৪৬৫। এরপর ১২৭ রান পেছনে থেকে শ্রীলঙ্কানরা তাদের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে। চতুর্থ দিন পর্যন্ত তারা ৮ উইকেট হারিয়ে ২৬৮ রান করে ১৪১ রানের লিড পায়। পরদিন ২টা উইকেট সকাল সকাল ফেলে দিতে পারলে জয়টা খুব কঠিন হবে না। পুরো বাংলাদেশই সেদিন হয়তো জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছিল। জিততে পারলে আমাদের শততম টেস্টের মাইলস্টোন হয়ে যাবে সুখের এক ইতিহাস! মাঠে এসেই সেদিন সরাসরি চলে গেলাম আমাদের জন্য নির্ধারিত বক্সে। এতদিন তেমন লোকজন না থাকলেও আজ বেশ লোক সমাগম দেখলাম। বক্সে বসেই পরিচিত হলাম সাবেক পেস বোলার ও বর্তমানে শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. রাজন সারার সাথে। স্ত্রীকে নিয়ে শ্রীলঙ্কার বিজয় দেখতে এসেছেন। সেখানে আরেক সাবেক ক্রিকেটার সুরেস মুরুগাসেরের ও শ্রীলঙ্কান স্টেট ব্যাংকের সহকারী গভর্নর কুমুদিনি সারাভানামুত্তুর সাথেও পরিচিত হলাম। পাইকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু স্টেডিয়ামটি যার নামে তার নাতনী এই ব্যাংকার। গর্বভরে নিজের দাদার কির্তী বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বন্ধুত্বটা এমন হয়ে গেল যে, ওরা বাংলাদেশের পক্ষে হাততালি দিতে লাগলো। তার আগে অবশ্য আমাদের জন্য জয়টা কত জরুরি সেটা ওদের বুঝিয়ে বললাম। শ্রীলঙ্কা আমাদের সাথে হারলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু আমরা যদি শততম টেস্ট জিততে পারি তবে তা হবে আমাদের জন্য ইতিহাস। ওদের আন্তরিকতায় আবারো মনে হলো ক্রিকেট একটি মহান খেলা যেখানে প্রতিযোগিতা আছে কিন্তু প্রতিহিংসা নেই।



পথিকের পথ বৃত্তান্তে বারবার খেলার বর্ণনায় চলে যাচ্ছি। কারণ আমার পথ তো শুরুই হচ্ছে প্রতিদিন খেলার মাঠ থেকে। বাংলাদেশ দলের শততম টেস্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের সাক্ষী হয়ে আবার পথে নামলাম। হোটেলে ফিরে গোসল করে বের হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা। আমাদের হোটেলটি মেরিন ড্রাইভের পাশেই কলম্বো-৩ এ অবস্থিত। তাই দু’কদম হেঁটেই সিংহল সমুদ্রের পাড়ে চলে এলাম। কালো কালো বিশাল পাথর ফেলে সমুদ্রের আক্রোশ থেকে মেরিন ড্রাইভ রক্ষা করা হয়েছে। এগুলো লঙ্কা জয়ের উদ্দেশ্যে হনুমান বাহিনীর ফেলা পাথর খণ্ড কিনা জানি না, তবে তারা বেশ শক্ত হাতেই সমুদ্র শাসন করতে পেরেছে। সাগরের তীর ধরেই চলে গেছে শ্রীলঙ্কার প্রধান রেলপথ। মেরিন ড্রাইভের চকচকে মসৃণ সড়কের পাশেই দুটি ব্রডগেজ লাইনে সারাদিন প্রচুর রেলগাড়ি আপ-ডাউন করে। দেখে রেল যোগাযোগ বেশ জনপ্রিয়ই মনে হলো। আমি যে কয়টি দেশ ভ্রমণ করেছি তার প্রায় সবগুলোতেই রেল যোগাযোগ সবচেয়ে জনপ্রিয় দেখেছি। অথচ অনেক সম্ভাবনা থাকতেও আমাদের দেশের রেলপথ অবহেলিত। যাই হোক ভারত মহাসাগরের নুন মেশানো মিষ্টি বাতাস খেতে খেতে আমি আর সহকর্মী মিলটন হাঁটতে লাগলাম। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর একটি স্থানীয় রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম। আমাদের দেশের পাড়ার চা-সিঙারা বিক্রি হয় যেসব রেস্তোরাঁয় অনেকটা তেমন। ভেতরে তেমন ভিড় নেই, তবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকেই খাবার খাচ্ছিল। নানা রকম ভাজাভুজির ভিড়ে একটা খাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। আমাদের দেশের ডিম চিতই পিঠার মতো। যাদের ডিম চিতই খাওয়ার অভিজ্ঞতা নাই তারা ঢাকার স্ট্রিট ফুডের অনেক কিছুই এখানো চেখে দেখেননি। শ্রীলঙ্কানরা একে বলে ‘ওপাস ওপাস’। আমার বার বার মনে হচ্ছিল এপাশ-ওপাশ। এটি চিতই পিঠার মতো একটি জিনিস যার ওপরে ডিম ভেঙে দিয়ে ভাজা হয়। আমার অন্যতম প্রিয় চ্যানেল ট্র্যাভেল অ্যান্ড লিভিং (টিএলসি)-এ প্রচারিত পিটার কুরুবেদার ‘মাই শ্রীলঙ্কা’ অনুষ্ঠানটি আমার খুব পছন্দের। অনুষ্ঠানটির একটি পর্ব ছিল কলম্বোর স্ট্রিট ফুড নিয়ে। এই দোকানে সেই অনুষ্ঠানে দেখানো প্রায় সব খাবারই বিক্রি হচ্ছে। তার দু’একটি আমরাও চেখে দেখলাম। গুদাম্বা নামের রুটি দিয়ে পেঁচানো টুনা ফিসের একটা আইটেম খেলাম। কিছুটা ঝাল ঝাল কিন্তু খুব সুস্বাদু। রেষ্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে আমরা রাতের কলম্বোর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হোটেলে ফিরে এলাম। এরপর সারাদিনের সুখস্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘুম।

২০ মার্চ সকালে ঘুম থেকে ওঠার কোনো তাড়া না থাকলেও সকাল সকাল উঠে পড়লাম আমরা। আজ খেলা নেই। আগামীকাল দেশে ফিরে যাবো তাই আজকের দিন পুরোই ফ্রি। প্রথমে আমরা গেলাম গলফেস গ্রিন নামক জায়গায়। জায়গাটি শ্রীলঙ্কার আরেক সৈকত শহর ‘গল’ এর দিকে মুখ করা সমুদ্র সৈকত। তবে ছবিতে যেমন দেখেছি বাস্তবে সেই সৌন্দর্যের অনেকটাই এখন অনুপস্থিত। এর কারণ সমুদ্র ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ। শ্রীলঙ্কানদের এই একটি কাজই আমার ভালো লাগেনি। জানি না কোন অনিবার্য কারণে তাদের এত সুন্দর জায়গাটি নষ্ট করতে হচ্ছে। এসব দেখে এখানে আর বেশিক্ষণ থাকার ইচ্ছে হলো না। আমরা আমাদের দ্বিতীয় পরিকল্পনার পথ ধরলাম। কোনো দেশে ঘুরতে গেলে সেখানকার গ্রামীণ পথে সাইকেল নিয়ে ঘোরার এক অন্যরকম মজা আছে। নেট ঘেটে সাইক্লিং করা যায় এমন একটি জায়গা খুঁজে বের করলাম। কলম্বো থেকে ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরের বরালেস গামা জংশনের কাছে আত্তিদিয়া নামক জায়গা। সেখানে বিস্তৃত পাখিদের অভয়ারণ্যের পাশাপাশি একটি সাইকেল পার্ক আছে। যেই ভাবা সেই কাজ। আমি ও সহকর্মী মিলটন চলে গেলাম সেই সাইকেল পার্কে। পার্কটি মূলত ওয়েরাস নামের একটি বড় লেকের পাশে অবস্থিত। লেকের চারপাশে বাঁধানো সাইকেল ট্র্যাক আর একপাশে ছাদ দেয়া আর খোলা আকাশের নিচ মিলিয়ে বেশ বড় সাজানো ফুডকোর্ট। সত্যিকারের পাখিদের অভয়ারণ্য বলতে যা বোঝায় এটি আসলে তাই। পথে পথে রাজকীয় ভঙ্গিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে নানা প্রজাতির পাখি। কোনো কোনোটি পার্কের রাস্তার ঠিক পাশেই ডিম দিয়ে তা দিচ্ছে। মানুষের চলাচল তাদের বিন্দুমাত্র বিচলিত করছে না। মানুষের সাথে এমন বিশ্বস্ত বন্ধুত্ব নিশ্চই একদিনে হয়নি। আমরা অবশ্য পুরো কলম্বোতেই মাঠে, পার্কে অবাধে নিঃসঙ্কোচে পাখিদের ঘুরতে দেখেছি। সবচেয়ে অবাক হয়েছি এক প্রজাতির বক দেখে। যারা কাকেদের সাথে মাঠে মাঠে খাবার খুটে খাচ্ছিল। বক সাধারণতো আমরা জলাশয়ে দেখেই অভ্যস্থ কিন্তু কলম্বোর প্রায় সব খোলা মাঠে কিংবা পার্কে এই বকদের চরতে দেখেছি।



পাখিদের না ঘাঁটিয়ে আমরা চলে গেলাম সাইকেলের খোঁজে। এখানে পার্ক কর্তৃপক্ষ যে সাইকেল ভাড়া দেয় তা নিয়ে পার্কের বাইরে যাওয়া নিষেধ। কিন্তু পার্কের বাঁধানো রাস্তায় সাইকেল চালাবো বলে এতদূর আসিনি। আমরা চাই গ্রামীণ রাস্তায় ঘোরার স্বাদ। কাঁচা রাস্তায় সাইকেলের চাকায় যে কিরকির মধুর শব্দ হয় তা কি আর পার্কের রাস্তায় পাবো? পার্কের এক নিরাপত্তা রক্ষী উপায় বাতলে দিলেন। পার্কের বাইরে দুটো দোকান আছে যারা সাইকেল ভাড়া দেয়। তাদের কাছে গিয়ে বিপত্তি বাঁধলো পাসপোর্ট নিয়ে। আমাদের কারো সাথেই পাসপোর্ট নেই। সেগুলো হোটেলের সেফটি লকারে রেখে এসেছি। একবার মালয়েশিয়াতে পাসপোর্ট খুইয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তারপর থেকে বারতি সতর্কতা হিসেবে প্রয়োজন ছাড়া পাসপোর্ট সাথে রাখি না। অনেক অনুরোধের পর ৫০০০ রুপি জামানত দিয়ে আমরা দুটি সাইকেল পেলাম। ভাড়া প্রতি ঘণ্টা মাত্র ১০০ রুপি যা আামাদের টাকায় ৫৪ টাকার মতো।

বেড়িয়ে পড়লাম সাইকেল নিয়ে। আত্তিদিয়া এলাকাটি ছোট মফস্বল শহরের মতো। তবে রাস্তাঘাট খুব সাজানো গোছানো। পুরো এলাকাটিতে একটি বিশাল লেক ও খালবেষ্টিত। লেকের কিছু অংশের পার ধরে সুন্দর সুন্দর ভিলা গড়ে উঠেছে। ভিলাগুলো পাশ কাটিয়ে লেকড্রাইভ রোড ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর পাকা রাস্তা থেকে নেমে পড়লাম লাল মাটির কাঁচা রাস্তায়। এমনটাই তো চেয়েছিলাম। প্রথমেই চোখে পড়লো একটি জেলে পাড়া। লেক থেকে তাজা তেলাপিয়া মাছ ধরে বাজারে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল কিছু লোক। নেমে ওদের সাথে কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও অনেকগুলো ঘেউ ঘেউরত কুকুরের ভয়ে নামার সাহস পেলাম না। কারণ ইতোমধ্যেই একটি কুকুরের তাড়া খেয়ে সাইকেলের ফ্রেমের উপর পা তুলে কোনো রকমে রক্ষা পেয়েছি। রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর দেখতে দেখতে আমরা কিছুটা নির্জন এলাকায় চলে এলাম। কাঁচা রাস্তা শেষ হয়ে আবার পাকা সড়ক। এরপর কিছুদূর গিয়ে পথের ধারে একটি ছোট্ট জুসের দোকান পেলাম। গরমে সাইকেল চালিয়ে এমনিতেই আমরা অনেক তৃষ্ণার্ত ছিলাম। জুসের দোকান দেখে তৃষ্ণা অনেক বেড়ে গেল। লবণ মসলা দিয়ে বানানো মুসাম্বির জুস খেয়ে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। জুসের দোকানের একটু দূরেই একটি খাল বয়ে গেছে। নাম তার ‘নেদী মালা’। নামের মাঝে বেশ নদী নদী গন্ধ আছে। সেটার পাড় ধরে চলে যাওয়া কাঁচা রস্তায় নেমে পড়লাম আমরা দুজন। একপাশে ১৫ ফুটের মতো উঁচু ঘন জলজ বন, অন্য পাশে পরিষ্কার পানির ধারা। সেই পানিতে অনেক রকমের জলচর পাখি খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। খালের নির্জন পাড়েই ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা শান্তির এক নীড় দেখতে পেলাম। বাড়ির দাওয়ায় গাছের নিচে একটি শিশু ঘুমাচ্ছিলো। কি পরম নিশ্চিন্ত আর শান্তির সে ঘুম! বাড়িটিতে বিত্তের ছোঁয়া না থাকলেও সুখ যেন থই থই করছিল।



বিকেলে হোটেলে ফিরে এলাম। এসে গোসল সেরে টুকটাক কিছু কেনাকাটার জন্য বেড়িয়ে পড়লাম। শ্রীলঙ্কায় কেনাকাটা করতে চাইলে কলম্বো ভালো জায়গা। এখানে বেশ কিছু বড় শপিংমল আছে। ম্যাজিসটিক সিটি, অর্কেড ইনডিপেনডেন্ট স্কয়ার, কলম্বো সিটি সেন্টার, লিবার্টি প্লাজা, ওডেল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব জায়গা থেকে তৈরি পোশাক, চা-পাতা, ভেসজ প্রসাধনী, বিভিন্ন ধরনের পাথর এবং নানা রকম মসলা কিনতে পারেন। তবে একই দোকানের ছাদের নিচে সব কিছুর জন্য আমাদের কাছে ‘বেভারলি স্ট্রিট’ শপিংমলটি ভালো লেগেছে। ৯, আর এ ডি মেল মাওয়াথা, কলম্বোতে অবস্থিত এই দোকানটিতে আমাদের প্রয়োজনীয় সব কিছুই পেয়ে গিয়েছিলাম।

সময় স্বল্পতার জন্য আমরা কলম্বোর বাইরে কোথাও যেতে পারিনি। তবে যেটুকু পেরেছি শ্রীলঙ্কার মানুষদের বুঝতে মোটামুটি যথেষ্ট ছিল। দেশের সীমারেখা তো বদলে যেতেই থাকে কিন্তু মানুষগুলো আদিম ও অকৃত্রিম থেকে যায়। তাই তো দেশ দেখার চেয়ে মানুষ দেখতেই ভালোবাসি। মানুষ চিনতে হলে পথে নামতে হবে। আর তাই পর্যটক হওয়ার চেয়ে পথিক হতেই ভালোবাসি। (সমাপ্ত)
 

ছবি: লেখক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মার্চ ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়