ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

রিকশাচালক থেকে উদ্ভাবক!

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৮, ৭ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রিকশাচালক থেকে উদ্ভাবক!

নিজের তৈরি যন্ত্রে আমলকি প্রক্রিয়াজাত করছেন ধর্মবীর সিং

|| ফিরোজ আলম ||

আমাদের দৈনন্দিন শহুরে জীবনে বিভিন্ন প্রয়োজনে যাতায়াতের জন্য রিকশা অতি পরিচিত সহজ বাহন। মফস্বল শহরেও এর ব্যতিক্রম খুব একটা চোখে পড়ে না। মধ্যবিত্তের যাতায়াতের এই অন্যতম বাহনের চালকদের আমরা সাধারণত ‘অশিক্ষিত’ অথবা শিক্ষা বঞ্চিত হিসেবেই মনে করি। আপনি কি ভাবতে পারেন, যে আপনাকে বহন করছে সেই রিকশাচালকের ভেতরেও রয়েছে এমন কোনো উদ্ভাবনী শক্তি, যা বদলে দিতে পারে অনেকের ভাগ্য। শুনতে সিনেমার গল্পের মতো মনে হয়। কিন্তু একাগ্রতা আর দমে না যাওয়ার ইচ্ছা কাউকে কাউকে এমন নিয়ম ভাঙ্গা চমকে দেয়া সফল মানুষে পরিণত করে।

আপনি হয়তো শুনেছেন, সত্যিকারের কঠোর পরিশ্রম আর দৃঢ়তাই সাফল্যের মূল স্তম্ভ। কিন্তু ধর্মবীর সিং কামবোজের গল্প শুনলে আপনি একথা বিশ্বাসও করবেন। দিল্লির এই রিকশাচালক শুধুমাত্র বুদ্ধিমত্তা দিয়ে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন। আবিষ্কার করেছেন এমন এক যন্ত্র যা দিয়ে ৫০টির বেশি কৃষি ও ভেষজ পণ্য প্রক্রিয়াজাত করা যায়। বানানো যায় ভেষজ সাবান, শ্যাম্পুর মতো প্রসাধনী। একটিমাত্র আবিষ্কারে হতদরিদ্র রিকশাচালক থেকে আজ ধর্মবীরের প্রতি মাসের  আয় কয়েক লাখ টাকা। পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারসহ নানা সম্মানজনক পদক।

পাঁচ ভাইবোনের মাঝে ধর্মবীর সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রকৃতিপ্রেমী। তার মার কাছ থেকে তিনি এই গুণ পেয়েছিলেন। এই প্রকৃতিপ্রেম তাকে তাদের গ্রামে ভ্রমণে আসা একজন ধর্মগুরুর কাছ থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে চিকিৎসা পদ্ধতি শিখতে আগ্রহী করে। এরপর জীবিকার সন্ধানে তিনি দিল্লি চলে যান। তেমন লেখাপড়া না জানা মানুষটি সেখানে গিয়ে রিকশা চালাতে থাকেন। তিনি তার পেশা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তবে অন্য সাধারণ দশজন মানুষের মতো নিজের ভাগ্য মেনে চুপচাপ বসে থাকার লোকও তিনি ছিলেন না। নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের জন্য তিনি সুযোগ খুঁজতে থাকেন।

 

এই সেই যন্ত্র যা দিয়ে ধর্মবীর সিং নিজের ভাগ্য ফিরিয়েছেন


ভাগ্য পরিবর্তনে কেউ আন্তরিক হলে সৃষ্টিকর্তাও তাকে পথ দেখান। ২০০৪ সালে ভারতের হরিয়ানা রাজ্য সরকারের হর্টিকালচার বিভাগ একদল কৃষককে রাজস্থানের একটি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা পরিদর্শনে নিয়ে যায়। নিজের আগ্রহের কারণে ধর্মবীর সিং সেই দলে যোগ দেন। এটি ছিল এ্যালোভেরা ও আমলকি প্রক্রিয়াজাতকরণের ছোট একটি কারখানা। কারখানাটি পরিদর্শন করে তিনি নিজেও এ ধরনের ব্যবসা করার জন্য উৎসাহিত হন। কিন্তু যন্ত্রপাতির দাম দেখে তিনি দমে যান। কিন্তু অর্থাভাব তাকে বেশিদিন দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি যন্ত্রপাতিগুলো কেনার ইচ্ছা বাদ দিয়ে নিজেই এমন কিছু বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৬ সালে ধর্মবীর সিং তার যন্ত্রের প্রথম প্রোটোটাইপ বানিয়ে ফেলেন। যা মূলত ছিলো এলোভেরা জুস বানানোর যন্ত্র। এরপর আরো কিছুদিন গবেষণা করে তিনি এটাকে একটি বহুমাত্রিক ভেষজ ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রে রূপান্তরিত করেন। সহজে স্থানান্তরযোগ্য বহুমুখী প্রক্রিয়াজাতকরণের এই যন্ত্রটি একটি সিঙ্গলফেজ মোটর দ্বারা চলে এবং এটি দিয়ে খুব সহজেই বিভিন্ন ফল, ভেষজ এবং বীজ প্রক্রিয়াজাত করা যায়। এটিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং ঘনত্ব প্রক্রিয়াজাতকরণের মতো বৈশিষ্ট্যও রয়েছে, যা ফুল এবং ঔষধি উদ্ভিদ থেকে সার এবং নির্যাস নিষ্কাশনে সাহায্য করে। যন্ত্রটি একটি গোলাকার ফুডগ্রেড স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে তৈরি। এর উপরে একটি ঢাকনাযুক্ত মুখ আছে যেখান দিয়ে ফল, ফসল ও অন্যান্য ভেষজ প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রবেশ করানো হয় আর অন্য পাশ দিয়ে অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করা হয়।

এই যন্ত্রটি একটি ইলেক্ট্রিক মোটর দ্বারা পরিচালিত হয়। এই মোটরের ক্ষমতার উপর যন্ত্রের ক্ষমতা নির্ভর করে। অর্থাৎ এই মোটর যত শক্তিশালী হবে তত বেশি ফসল ও ফুল-ফল এটি দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা যাবে। যন্ত্রটি এমনভাবে তৈরি করা যাতে করে বাইরের তাপ ও চাপ কোনোভাবেই ভেষজ পণ্যগুলোর গুণগত মানের ক্ষতি না করে। এটি আম, আমলকি, এলোভেরা, তুলসী, অশ্বগন্ধা (দম্বল) এবং গোলাপ, চামেলী ও ল্যাভেন্ডারের মতো ফুলের প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমানে ৫০ কেজি ও ১৫০ কেজি ধারণ ক্ষমতার দুটি মডেলে এই মাল্টিপারপাস যন্ত্রটি পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের ন্যাশনাল ইনোভেশন ফাউন্ডেশন (এনআইএফ) এই কাজে ধর্মবীরের পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা এই মেশিনের ব্যবহার যোগ্যতা ও নান্দনিকতা উন্নত করার জন্য ডিজাইনার যুক্ত করে দিয়েছে।

নিজের তৈরি মেশিনের সামনে ধর্মবীর সিং


শুরুতে ধর্মবীর সিং শুধুমাত্র মুখের কথার ভিত্তিতেই ভারতের কিছু রাজ্যে বেশ কয়েকটি যন্ত্র বিক্রি করেন। এমনকি কেনিয়াতেও একটি যন্ত্র রপ্তানি করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যে দিল্লিতে তিনি রিকশা চালাতেন সেই দিল্লিতেই ৫৪টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের এক সম্মেলনে তার আবিষ্কৃত মেশিন প্রদর্শনের সুযোগ পান। তার কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে জিম্বাবুয়ের রাষ্ট্রপতি তাৎক্ষণিক  একটি মেশিন কিনে নেন। এ ছাড়াও ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে ২০ দিনের জন্য অতিথি হিসেবে বসবাসের সম্মানজনক সুযোগও পান তিনি।

বর্তমানে ধর্মবীর সিং কামবোজ যন্ত্রটিকে আরো উন্নত করার কাজের পাশাপাশি গ্রামের সাধারণ মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি তার গ্রামে ২৪ জন মহিলার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, যারা এই মেশিন ব্যবহার করে প্রক্রিয়াজাতকৃত আমলকি ও অ্যালোভেরা পণ্য তৈরি ও বিক্রি করে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়