ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

রোহিঙ্গাকেন্দ্রিক অপরাধ বাড়ছে, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

সুজাউদ্দিন রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ১০ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রোহিঙ্গাকেন্দ্রিক অপরাধ বাড়ছে, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

কক্সবাজার প্রতিনিধি : মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ক্রমাগত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এসব রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ-সংঘাতের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।

অভিযোগ আছে যে, রোহিঙ্গারা মাদক ব্যবসা, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে। এ সব অপরাধের পাশাপাশি একটি চক্রের ইন্ধনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টাও করছে বলে দায়িত্বশীল সংস্থার প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এতে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা শঙ্কাও।

সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংস্থার তথ্য মতে, গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এর আগে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা ছিল এদেশে। রোহিঙ্গারা বসবাস করছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে। এসব রোহিঙ্গাদের সর্বোচ্চ মানবিক সহায়তা প্রদান করা হলেও অনেকে হত্যাসহ নানা অঘটন ঘটাচ্ছে।

পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, গত ২১ অক্টোবর টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে কবির আহমদ নামের এক এসআইকে পিটিয়ে আহত করেছে রোহিঙ্গারা। এর আগে ১৯ অক্টোবর রোহিঙ্গারা হামলায় চালিয়ে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের আবু সিদ্দিক নামের এক যুবককে আহত করে। ২১ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান এ যুবক। ৩০ অক্টোবর ডাকাতির প্রস্তুতির সময় উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প সংলগ্ন বাগান থেকে দেশীয় অস্ত্রসহ পাঁচ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে র‌্যাব। ২৭ অক্টোবর রামুর খুনিয়াপালংয়ে আব্দুল জব্বার নামের এক বাঙালি যুবককে কুপিয়ে হত্যা করছে এক রোহিঙ্গা। একই দিন বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের হামলায় চার নলকূপ শ্রমিক আহত হয়েছেন। এ দিন দেশীয় দুটি বন্দুকসহ দুইজন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ। ২৮ অক্টোবর রাতে টেকনাফের হ্নীলায় এক বাড়ি থেকে ছয়টি মোবাইল ফোনসেট চুরি করে পালিয়ে যাওয়ার সময় জাবেদ নামের এক রোহিঙ্গা যুবককে আটক করা হয়।

এ ছাড়া গত এক মাসে রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটিয়েছে ৫০টিরও বেশি। অস্ত্রসহ নানা অপরাধে চলতি মাসে ২০ জন রোহিঙ্গাকে আটকও করা হয়েছে। মঙ্গলবার এক রোহিঙ্গা নারী ইয়াবাসহ আটক হয়েছে। এর আগে গত ৩ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের এক ঘর থেকে ইয়াবা ও গাঁজা উদ্ধার করা হয়।

এদিকে একটি চক্র রোহিঙ্গাদের দিয়ে রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনিকভাবে কঠোর নজরদারির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এনজিও কর্মীর ছদ্মবেশে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্দেহজনক ঘোরাঘুরির সময় পাঁচ বিদেশি নাগরিকসহ ২৬ জনকে আটক করেছে পুলিশ। সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এদের আটক করা হয় বলে জানান কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) খালেদ মাহমুদ।

এডিএম খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করে সোমবার রাতে বহিরাগত কয়েক ব্যক্তি উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া এলাকায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অবস্থান করে সন্দেহজনক আচরণ করছে বলে খবর পেয়ে পুলিশ অভিযান চালায়। এ সময় ক্যাম্পটির ডি-৪ ব্লক থেকে বিদেশি পাঁচ নাগরিকসহ ২৬ জনকে আটক করা হয়।

তিনি জানান, শুরুর দিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ ধরনের আচরণ লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু বর্তমানে স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ ও সংঘাতের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

কিছু-কিছু রোহিঙ্গার কারণে এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ করে  অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন রোহিঙ্গাদের অনেকেই।

এর মধ্যে কুতুপালং ক্যাম্পের আবদুল গফুর নামের এক বৃদ্ধ বলেন, ‘এক শ্রেণির রোহিঙ্গা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এই রোহিঙ্গারা নিবন্ধনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম ও নানা অপরাধে জড়িত রয়েছে।’

 



বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মালেক নামের এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর জন্য চেষ্টা করছে কিছু মহল। এতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা অবহেলার শিকার হতে পারে।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কুতুপালং এলাকার নুরুল হক বলেন, ‘অত্যাচারের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠার কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে আইনশৃঙ্খলা মানে না। এসব রোহিঙ্গা নানা অপরাধ ঘটাচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরেও অনেক রোহিঙ্গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সব রোহিঙ্গাকে তাদের স্বদেশে দ্রুত ফেরত পাঠানো দরকার।’

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই সহজ সরল না। তাদের মধ্যে নানাভাবে অপরাধ প্রবণতা রয়েছে। সব বিবেচনা করেই প্রশাসনকে অত্যন্ত কঠোর হতে হবে। অন্যথায় আরো অপরাধ বাড়তে পারে। যা আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বটে।’

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এখন নয়, অনেক আগে থেকে আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি। নতুন করে পানির ঢলের মতো রোহিঙ্গা আসায় সেই শঙ্কা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ  করা এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের একস্থানে করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ফেরত পাঠানো জরুরি।’

রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সভাপতি নুরুল আবছার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার ইন্ধনেই রোহিঙ্গা বিদ্রোহী আরএসএ তৈরী। বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানপন্থী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে নানাভাবে নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে একই কাজ করার চেষ্টা চলছে। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে নলকূপ শ্রমিকের ওপর হামলা ভয়াবহ ইঙ্গিত। মানবিক বিকবেচনায় আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গাদের এসব আচরণ বন্ধে কঠোর হতে হবে। বিশেষ মহলকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আফরুজুল হক টুটুল বলেন, ‘রোহিঙ্গাকেন্দ্রিক পুলিশি তৎপরতা অনেক বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও। স্থায়ীভাবে পুলিশ ক্যাম্প করার প্রক্রিয়া চলছে। অপরাধ বা অন্যায় কাজ যাতে হতে না পারে তার জন্য সজাগ রয়েছে পুলিশ।’

এদিকে সকল ধরনের সহায়তা দেওয়ার পরও ক্যাম্প থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে মরিয়া কিছু রোহিঙ্গা। এ পর্যন্ত ৩১ হাজার রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করছে- এমন তথ্য রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বুধবার কাজ শুরু করতে যাচ্ছে প্রশাসন। মাইকিং করে এসব রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য ভাড়া বাড়ির মালিকদের অনুরোধ করা হবে। যদি কেউ না মানে নির্দিষ্ট সময় পর বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’



রাইজিংবিডি/কক্সবাজার/১০ নভেম্বর ২০১৭/সুজাউদ্দিন রুবেল/রুহুল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়